১০০ বছর পর আবারও সাঁতারের জন্য উন্মুক্ত প্যারিসের সিন নদী, উল্লাস নগরবাসীর

এক শতাব্দীরও বেশি সময় পর, অবশেষে সিন নদীতে সাঁতার কাটার সুযোগ পেলেন প্যারিসবাসী ও পর্যটকেরা। ১.৪ বিলিয়ন ইউরো ব্যয়ে ব্যাপক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানের ফলে আবারও দুষণমুক্ত হয়েছে নদীর স্রোতধারা। ফলে পানিতে স্নান নিরাপদ হওয়ায় দীর্ঘদিন পর এই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটির অংশ হলেন উচ্ছ্বসিত প্যারিসিয়ানরা।
গত বছর হয়ে যাওয়া প্যারিস অলিম্পিককে সামনে রেখে বছরজুড়ে ফ্রান্সের কিছু নদী পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তারই অংশ হিসেবে সিন নদীও পরিষ্কার করা হয়।
গতকাল শনিবার নদীর পাড়ে তিনটি নতুন সুইমিং সাইট খুলে দেওয়া হচ্ছে—একটি নতরদামের কাছে, আরেকটি আইফেল টাওয়ারের পাশে এবং তৃতীয়টি প্যারিসের পূর্ব অংশে।
প্যারিসের পৌর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইউরোপীয় মানদণ্ড অনুযায়ী পানি পরীক্ষার ফলাফল— ধারাবাহিকভাবে ইতিবাচক আসায় জনগণকে নদীতে সাঁতার কাটার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
এখন নদীটির তিনটি নির্ধারিত স্থানে রোজ ১ হাজারের বেশি মানুষ বিনা খরচে সাঁতার কাটতে পারবেন। আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এই সুযোগ থাকছে।
দূষণ ও নৌযান চলাচলের ঝুঁকির কারণে, ১৯২৩ সাল থেকে সিন নদীতে সাঁতার কাটা আইনত নিষিদ্ধ ছিল। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে নির্ধারিত এলাকাগুলোর বাইরে এখনও সাঁতার কাটা নিষিদ্ধ।
স্পোর্টস কোচ ও সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার লুসিল উডওয়ার্ড বলেন, "এটা এক প্রতীকী মুহূর্ত, আমরা আমাদের নদী ফিরে পাচ্ছি।" আজ রোববার সিন নদীতে প্রথম অপেশাদার উন্মুক্ত সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সময় এসব কথা বলেন তিনি।
উডওয়ার্ড অলিম্পিক শুরুর আগে প্যারিসের মেয়র আনে ইদালগোর সঙ্গে সিন নদীতে ডুব সাঁতার কেটেছিলেন, তিনি আশাবাদী যে নদীর পরিস্থিতি ভালোই থাকবে।
"আমরা সবাই মিলে নদীতে মজা করব, সাঁতার কাটব, আর এর মধ্য দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করব। মানুষ দেখবে, শত শত মানুষ কীভাবে উপভোগ করছে, তখন সবাই চাইবে সিন নদীতে সাঁতার কাটতে," বলেন উডওয়ার্ড।
তিনি আরও বলেন, "পরিবার নিয়ে ছোটদের সঙ্গে পানিতে ঝাঁপ দেওয়া, নদীর মধ্যে একটু পানির ছিটা-ছিটি—প্যারিস শহরে এমন সুযোগ দারুণ ব্যাপার।"
@অলিম্পিকের সৌজন্যে নদীর নতুন প্রাণ
২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিকে সিন নদী হয়ে উঠেছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু—উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে ট্রায়াথলন ও ম্যারাথন সাঁতার প্রতিযোগিতার মঞ্চ ছিল এই ঐতিহাসিক নদী। যদিও অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে নদীতে জীবাণুর মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় কিছু প্রতিযোগিতা স্থগিত করতে হয়েছিল।
অলিম্পিকের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে প্রশাসন নতুন জীবাণুনাশক প্ল্যান্ট স্থাপন করে এবং একটি বিশাল স্টোরেজ বেসিন তৈরি করা হয়, যাতে বৃষ্টির পানির সঙ্গে জীবাণুযুক্ত বর্জ্য যতটা সম্ভব সিন নদীতে পড়া ঠেকানো যায়।
নৌযানগুলোকে তাদের যাত্রীদের মানববর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলতে নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি প্যারিসের উজানে থাকা কিছু বাড়িঘরের বর্জ্যও সরাসরি নদীতে যাওয়ার বদলে শোধনাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
প্যারিসের ডেপুটি মেয়র পিয়ের রাবাদান জানান, প্রতিদিনই পানির গুণগত মান পরীক্ষা করা হয়। ফ্রান্সের সৈকতগুলোর মতোই এখানেও বিভিন্ন রঙের পতাকা তুলে দেখানো হবে কখন সাঁতার কাটা নিরাপদ।
"সবুজ পতাকা মানে পানি নিরাপদ, লাল পতাকা মানে পানি দূষিত বা প্রবাহ খুব বেশি," বলেন রাবাদান।
তিনি জানান, জুন মাসের শুরু থেকেই ইউরোপীয় মানদণ্ড অনুযায়ী পানি পরীক্ষার ফলাফল ভালো এসেছে, শুধু দুইবার ব্যতিক্রম হয়েছে—বৃষ্টিপাত ও নৌযানের কারণে।
"আমি বলতে পারব না, গ্রীষ্মে (সাঁতারের অনুমতি) কতদিন বন্ধ রাখতে হবে, কারণ আবহাওয়া পরিবর্তনের ওপর এটা নির্ভর করে। তবে গত বছরের তুলনায় পানির মান বেশ ভালো মনে হচ্ছে," বলেন তিনি।
গত বছর অলিম্পিকের সময়ে ট্রায়াথলন ও ওপেন-ওয়াটার রেসে অংশ নেওয়া বেশ কয়েকজন অ্যাথলেট অসুস্থ হয়ে পড়েন। যদিও এজন্য প্রত্যক্ষভাবে নদীর পানিই দায়ী কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ওয়ার্ল্ড অ্যাকোয়াটিকস জানিয়েছে, প্রতিযোগিতার সময় পরিবেশের মান তাদের গ্রহণযোগ্য সীমার মধ্যেই ছিল।
সংগঠনটি এক বিবৃতিতে জানায়, "পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার এই প্রচেষ্টার সুফল ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান। সিন এখন জনগণের জন্য উন্মুক্ত—এটি ক্রীড়ার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক উন্নয়নের দৃষ্টান্ত।"
তবে সংশয় পুরোপুরি কাটেনি। প্যারিস ও লস অ্যাঞ্জেলসভিত্তিক পানি পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তি সংস্থা ফ্লুইডিওনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী ড্যান অ্যাঞ্জেলেস্কু জানান, সিন নদীতে পানির গুণগত মান খুবই ওঠানামা করে। তিনি বলেন, "আমরা দেখছি, সাঁতারের জন্য পানির নিরাপদ মান পাওয়া যায় এমন দিন খুবই কম থাকে। আমরা শুধু বলতে পারি, বর্তমান বিজ্ঞান যে মূল্যায়ন পদ্ধতি ব্যবহার করছে তা সঠিক নয়। এতে বড় ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে, যা ধরা পড়ছে না।"
প্যারিসবাসীর দ্বিধা
এসব আলোচনার মধ্যে প্যারিসবাসী অনেকের মধ্যে এখনও সিনে সাঁতারের বিষয়ে দ্বিধা রয়েছে। বিশেষত নদীর ঘোলা পানি, ভাসমান আবর্জনা ও পর্যটকবাহী নৌকার কারণে অনেকে অস্বস্তি বোধ করছেন।
স্থানীয় রিয়েল এস্টেট এজেন্ট এনিস মাহদজৌব বলেন, "আমি ভয় পাই না, তবে একটু ঘেন্না লাগে। আসলে ভয় নয়, বরং নোংরা হওয়ার চিন্তাটাই বেশি।"