ইরানের রহস্যময় ফোর্দো পারমাণবিক কেন্দ্র কী, যেটি যুক্তরাষ্ট্র ধ্বংসের দাবি করেছে

পাঁচটি সুড়ঙ্গ প্রবেশ করেছে পাহাড়ের ভেতরে, সঙ্গে একটি বড় স্থাপনা। চতুর্দিকে নিরাপত্তা বেষ্টনী। স্থাপনাটির প্রধান কক্ষগুলো মাটির প্রায় ৮০ থেকে ৯০ মিটার নিচে। ইরানের রহস্যময় ফোর্দো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্রের স্যাটেলাইট থেকে ছবিতে দেখা গেছে ব্যস এটুকুই। ২০০৯ সালে জনসম্মুখে আসার পর থেকেই, দেশটির পবিত্র নগরী কোমের কাছে নির্মিত এ গোপন কমপ্লেক্সটির প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে জল্পনা-কল্পনা রয়েছে বিশ্বজুড়ে।
ইরানের এ স্থাপনা নিয়ে যতটুকু জানা গেছে তার বড় একটি অংশই ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের চুরি করা নথির মাধ্যমে। সম্প্রতি শুরু হওয়া ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে ইরানের এ ইউরেনিয়াম মজুদ কেন্দ্রটিকে বারবার হামলার লক্ষ্যবস্তু করেছে তেল আবিব। তবে কেন্দ্রটির ক্ষতি করতে ইসরায়েলি বাহিনী অক্ষম বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)।
এরপর মার্কিন বাহিনী ইরানের তিনটি প্রধান পারমাণবিক স্থাপনা—নাতাঞ্জ, ইসফাহান ও ফোর্দোতে হামলা চালিয়েছে। হামলায় এসব কেন্দ্র ধবংসের দাবিও করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।
২০০৯ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক সংবাদ সম্মেলনে ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি ও ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনকে সঙ্গে নিয়ে ইরানের ফোর্দো কর্মসূচির অস্তিত্ব বিশ্ববাসীর সামনে আনেন।
ওবামার এ ঘোষণার কয়েকদিন আগে ইরানের প্রশাসন বুঝতে পারে, পশ্চিমা গোয়েন্দারা স্থাপনাটির বিষয়ে জেনে গেছে। এর পরেই নতুন একটি জ্বালানি সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্র নির্মাণের আগ্রহ জানিয়ে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থাকে (আইএইএ) অবহিত করে তারা। তবে ফোর্দোর কাজ পুরোদমে চলছিলো বহুবছর ধরেই।
এসময় ওবামা বলেছিলেন, স্থাপনাটির আকার ও কাঠামো কোনো শান্তিপূর্ণ অবকাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তবে বরাবরের মতো নিজেদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ বলে দাবি করে তেহরান।
পশ্চিমা দেশগুলোর অভিযোগগুলো প্রত্যাখ্যান করলেও—মিত্র দেশ রাশিয়ার নিন্দা ও চীনের উদ্বেগের জেরে—কেন্দ্রটির কর্মকাণ্ড কৌশলগতভাবে সীমিত করতে বাধ্য হয় দেশটি।
নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০০ সালে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা ফোর্দো নির্মাণ শুরুর সময়কাল নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানায়নি, তবে স্যাটেলাইট থেকে তোলা চিত্রে দেখা গেছে, ২০০৪ সালের আগেই জায়গাটিতে নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল।
সেসময়কার ছবিগুলোয় দেখা গেছে, যেখানে বর্তমানে সুড়ঙ্গের প্রবেশপথ রয়েছে, সেখানে দুটি সাদা বর্গাকার কাঠামো ছিল। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, তারা ২০০২ সালের আগের নির্মাণকাজের ছবিও পেয়েছে।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটির (আইএসআইএস) প্রধান ডেভিড অলব্রাইট জানান, "ফোর্দো আসলে এমন একটি প্রকল্প, যার মাধ্যমে ইরানিদের পরিকল্পনা ছিল সেখানে অস্ত্রমানের ইউরেনিয়াম উৎপাদন করা, এবং বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করে তা ব্যবহার করা।"
২০০৯ সালের অক্টোবরে ইরান এক চিঠিতে আইএইএ'কে ব্যাখ্যা দেয় যে, ইরানে সম্ভাব্য সামরিক হামলার হুমকির কারণে তারা স্থাপনাটিকে ভূগর্ভে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইরান আরও জানায়, ইরানের অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুর সঙ্গে সম্ভাব্য হামলার আওতায় থাকা নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্রের বিকল্প হিসেবেই তৈরি করা হয়েছে ফোর্দো।
ইরান আইএইএ-কে আরও জানায়, এই স্থাপনায় সর্বোচ্চ ৩,০০০ ইউরেনিয়াম সেন্ট্রিফিউজ রাখা যেতে পারে। সেন্ট্রিফিউজ এমন যন্ত্র যা ইউরেনিয়ামকে সমৃদ্ধ করার কাজে ব্যবহার করা হয়।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ফোর্দো থেকে ইরান তার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুতকে খুব দ্রুতই পারমাণবিক বোমায় রূপান্তর করতে পারতো।
পারমাণবিক চুক্তি এবং ইসরায়েলের অভিযোগ
এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তির মাধ্যমে ফোর্দো কেন্দ্রের ঝুঁকি কমে এসেছিলো অনেকাংশে। চুক্তি অনুযায়ী, স্থাপনাটিতে থাকা মোট সেন্ট্রিফিউজের দুই-তৃতীয়াংশ সরিয়ে ফেলতে হয় ইরানকে। পাশাপাশি অপসারণ করতে হয় অন্যান্য সব পারমাণবিক উপাদান।
তবে ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের পর—সেই প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে উল্টো পথে যেতে শুরু করে।
২০১৮ সালে ইসরায়েলের গোয়েন্দারা ইরানের পরমাণু কর্মসূচির আর্কাইভ থেকে ৫৫ হাজারের বেশি নথি চুরি করতে সক্ষম হয়। সেসময় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফোর্দো কেন্দ্র সম্পর্কে আরও অনেক তথ্য জনসমক্ষে তুলে ধরেছিলেন।
এসব নথির মধ্যে ছিল ফোর্দোর বিস্তারিত নকশা। নথিতে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচির অংশ হিসেবে, বছরে অন্তত একটি বা দুটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উপযোগী ইউরেনিয়াম উৎপাদনই ইরানের লক্ষ্য।
সেসময় ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন আব্বাস আরাগচি (বর্তমানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী), তিনি নেতানিয়াহুর এ অভিযোগ এবং মন্তব্যকে "শিশুসুলভ" এবং "হাস্যকর" হিসেবে অভিহিত করেন।
অন্যদিকে, তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেই বলেন, তারা অনেক আগেই এসব নথি সম্পর্কে জানতেন, এবং সেগুলোকে সত্য বলে মনে করতেন।
বোমা থেকেও সুরক্ষিত
সাম্প্রতিক আইএইএ রিপোর্টে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, ফোর্দো কেন্দ্রে ইরান ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন বাড়িয়েছে। তাদের দাবি, এখন প্রায় ২,৭০০ সেন্ট্রিফিউজ চালু রয়েছে। এছাড়া, উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের উৎপাদন এবং সঞ্চয় ইরানের মতো একটি অ-পরমাণু অস্ত্রধারী রাষ্ট্রের পক্ষে মারাত্মক উদ্বেগের কারণ বলে ৩১ মে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায় আইএইএ।
ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি (আইএসআইএস) থিঙ্ক ট্যাংকের মতে, ইরান ফোর্দো কেন্দ্রে তার বর্তমান ৬০% সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদকে মাত্র তিন সপ্তাহে ২৩৩ কেজি অস্ত্রমানের ইউরেনিয়ামে রূপান্তরিত করতে সক্ষম — যা নয়টি পারমাণবিক বোমা বা ওয়ারহেডের জন্য যথেষ্ট।
এ কারণেই ইসরায়েলের কাছে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি দুর্বল ও ধ্বংস করার চেষ্টায়—ফোর্দো প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায়।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বিশ্বের আর কোনো দেশের কাছে ইরানের ফোর্দো কেন্দ্রকে লক্ষ্য করে হামলার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতাসম্পন্ন বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্র নেই। এজন্য শেষপর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকেই অভিযান চালাতে হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ইয়েখিয়েল লেইটার গেল সোমবার মেরিট টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "ফোর্দোকে আকাশ থেকে হামলা করে ধ্বংস করতে গেলে বিশ্বের একমাত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সেই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা রয়েছে। এবং তা ব্যবহার করা হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রকেই নিতে হবে।"