ইরানে হামলার সিদ্ধান্ত নিতে ট্রাম্পের দুই সপ্তাহ অপেক্ষার ঘোষণায়—দ্বিধা আর শঙ্কায় ইসরায়েলিরা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে সামরিক হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিতে—দুই সপ্তাহ সময় নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় ইসরায়েল গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের আশা করলেও, ট্রাম্পের দোদুল্যমান অবস্থান জায়নবাদী রাষ্ট্রটির রাজনীতিক ও সামরিক নেতৃত্বকে বিভ্রান্ত করছে।
ইসরায়েলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্ত মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন'কে বলেন, "আমরা বিশ্বাস করি, যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির প্রেসিডেন্টের একটি নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে—এই অঞ্চল যেন একটি ইতিবাচক পথে যায় এবং বিশ্ব যেন পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত ইরান থেকে মুক্ত থাকে।" উল্লেখ্য, গ্যালান্ত ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের চলমান সামরিক অভিযানের পরিকল্পনায় যুক্ত ছিলেন, পরে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাকে বরখাস্ত করেন।
'সতর্ক কৌশল'
ট্রাম্পের নতুন সময়সীমা ঘোষণার পর ইসরায়েলি নেতারা জনসমক্ষে আরও সতর্ক মন্তব্য করছেন। তারা প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি হামলার আহ্বান না জানিয়ে কৌশলীভাবে সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাব্য সুফল তুলে ধরছেন। নেতানিয়াহু ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা এখন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের উপকারিতার কথা বললেও, ট্রাম্পকে চাপ দেওয়ার মতো অবস্থান নিচ্ছেন না।
সিএনএন-এর সঙ্গে আলাপকালে ইসরায়েলের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ইরানের ফোর্ডো পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা অপরিহার্য। কারণ এটি পর্বতের অনেক গভীরে অবস্থিত, যেখানে আঘাত হানতে প্রয়োজন আমেরিকার ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের 'বাঙ্কার বাস্টার বোমা', যা কেবল যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ বোমারু বিমান থেকেই নিক্ষেপ করা সম্ভব।
সাবেক ইসরায়েলি কনসাল জেনারেল ইয়াকি দায়ান বলেন, "ইসরায়েল ফোর্ডোতে হামলা চালাবে, তবে কিন্তু মার্কিন সহায়তা ছাড়া—সেটা অনেক বেশি দীর্ঘমেয়াদি ও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।"
ট্রাম্পের 'ধোঁয়াশার রাজনীতি'?
ট্রাম্পের দুই সপ্তাহ সময় চাওয়ার সিদ্ধান্তকে ইসরায়েলের কিছু কর্মকর্তা দেখছেন 'ধোঁয়াশার খেলা' হিসেবে—মানে, ট্রাম্প আসলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, কিন্তু ইরানকে বিভ্রান্ত রাখার কৌশল হিসেবে এই ঘোষণা দিয়েছেন।
তবে অন্যদের মতে, ট্রাম্পের বারবার অবস্থান পরিবর্তনের কারণে ইসরায়েলের উদ্বেগ বাড়ছে। এক কর্মকর্তা বলেন, "গত কয়েক সপ্তাহের বক্তব্যগুলো দেখলেই বোঝা যায়, তার (ট্রাম্পের) অনেক বেশি দোদুল্যমানতা রয়েছে।"
মাত্র দুই দিন আগেও ট্রাম্প ইসরায়েলকে ইরানের আকাশপথে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সাফল্যের জন্য কৃতিত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন সেই আত্মবিশ্বাসের জায়গায় এসেছে অপেক্ষা ও অনিশ্চয়তা—কারণ এটি (ইরানে হামলা বা তা না করার সিদ্ধান্ত) ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি সিদ্ধান্ত হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্যও ইসরায়েলের চিন্তার কারণ
ট্রাম্পের নিজ সমর্থকগোষ্ঠী 'মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' (মাগা) ঘরানার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে হস্তক্ষেপের বিষয়ে দ্বিধা রয়েছে। একপক্ষ বলছে, এই মুহূর্তেই ইরানে সামরিক অভিযান দরকার; অন্যপক্ষের ভাষ্য, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে যুদ্ধে জড়ানো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। এই বিভক্তির মধ্যেই ইসরায়েল নীরব কূটনীতি চালাচ্ছে, নেতানিয়াহুর উপদেষ্টা রন ডারমার যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থি মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দিয়ে বার্তা দিচ্ছেন।
ইরান, ইউরোপ ও হোয়াইট হাউসের যোগাযোগ
এদিকে, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডে ইউরোপীয় কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। হোয়াইট হাউসও জানিয়েছে, ইরানের সঙ্গে সংযোগ এখনও অব্যাহত রয়েছে—যদিও বিশদ জানানো হয়নি।
'সময় যত গড়াচ্ছে, ঝুঁকি তত বাড়ছে'
ইসরায়েলের অভিযান দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রবেশ করার পর থেকে ধীর হয়ে পড়েছে, বলছেন কর্মকর্তারা। প্রতিদিনই ভুলের সম্ভাবনা বাড়ছে, যা কেবল ইসরায়েলের সামরিক অবস্থানকেই ঝুঁকিপূর্ণ করে না, বরং যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য অংশগ্রহণকেও বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
সাবেক কনসাল জেনারেল আলোন পিংকাস সিএনএন-কে বলেন, "ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের সময়সীমা আসলে দেখায়, এই মানুষটিকে বোঝা যায় না। নেতানিয়াহু হয়তো নিজের কার্ড একটু বেশি খেলে ফেলেছেন— এটি তেমন ইঙ্গিতও দেয়।"
অর্থাৎ, ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে বিলম্ব কেবল ইসরায়েলের কৌশলগত পরিকল্পনাতেই ছেদ ফেলছে না, বরং মধ্যপ্রাচ্যে সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও প্রভাব নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। ইরান যদি পশ্চিমা জোটের অনির্ধারিত অবস্থান দেখে শক্ত অবস্থান নেয়—তাহলে সংঘাত আরও জটিল রূপ নিতে পারে। আবার ইরানের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে— দীর্ঘদিন এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির একটি বড় অংশ অবস্থান করতে বাধ্য হবে। হতাহত ও শক্তিক্ষয় হবে পেন্টাগনেরও। এই অবস্থার সুযোগ নিতে পারে আমেরিকার বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও রাশিয়া।