ইসরায়েলে উড়ে যাওয়া ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যক্ষ করলেন বিমানের পাইলট

রাত ২টা ১৫ মিনিট। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রিয়াদগামী শিডিউলড ফ্লাইট নিয়ে আমরা উড্ডয়ন করলাম। ককপিটে দায়িত্বে আমি, পাশে কো-পাইলট রাপসান রিয়াদ। আকাশ শান্ত, আবহাওয়াও অনুকূল। ভারত, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের আকাশসীমা অতিক্রম করে আমরা বাহরাইনের আকাশসীমার কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। স্থানীয় সময় ভোর প্রায় ৫টা।
৪০ হাজার ফুট উঁচু থেকে পৃথিবীকে দেখে সবসময়ই মনে গভীর বিস্ময় জাগে। কিন্তু সে বিস্ময় কিছুক্ষণের মধ্যেই মিলিয়ে গেল। অপ্রত্যাশিত ও ভীতিকর এক দৃশ্য দেখে প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম, আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম।
আমাদের উড়োজাহাজ পারস্য উপসাগরের ওপর দিয়ে উড়ছিল। আমাদের ডান দিকে ইরান, বাঁ দিকে ও কিছুটা পেছনে বাহরাইন। সূর্য তখনও ওঠেনি, তবে পুব দিগন্তে হালকা আলো ফুটতে শুরু করেছে।
অকস্মাৎ ইরানের আকাশজুড়ে ঝলসে উঠল এক উজ্জ্বল আলোর ঝলক।
প্রথমে ভাবলাম, কোনো সাধারণ সামরিক মহড়ার অংশ বুঝি। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ওগুলো দেখতে পেলাম আমরা—মিসাইল। ডজন ডজন, হয়তো তারও বেশি; একের পর এক পশ্চিম দিকে ছুটে যাচ্ছে আকাশ চিরে।
কো-পাইলটও স্তব্ধ। আমরা সঙ্গে সঙ্গে ফ্লাইট রুট পর্যালোচনা শুরু করলাম। একটাই প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল বারবার:
ওই মিসাইলগুলোর একটাও যদি ভুল পথে চলে আসে?
এই চিন্তাটাই মেরুদণ্ডে শীতল স্রোত বইয়ে দিল।
একজন পাইলট হিসেবে আমি বহুবার ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে কোনোকিছুর তুলনা চলে না—জ্বলন্ত তিরের মতো মিসাইল গুলো আকাশ চিরে উড়ে যাচ্ছে, আমাদের বিমান থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূর দিয়ে। আমরা দ্রুত রুট বদলে নিরাপদ দূরত্বে চলে গেলাম। শেষপর্যন্ত নিরাপদেই অবতরণ করলাম রিয়াদে।
মাটিতে নামার পর ফোন অন করতেই একের পর এক খবরের শিরোনামগুলো ভেসে উঠল স্ক্রিনে:
'ইসরায়েলে ইরানের ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা'
এটা স্রেফ সামরিক পদক্ষেপ ছিল না। এ ছিল একটি সম্ভাব্য যুদ্ধের সূচনা—যা হয়তো দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না-ও থাকতে পারে। গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতা এখন হুমকির মুখে।
সেই সকালটায় আমি শুধু একজন পাইলট ছিলাম না। আমি হয়ে উঠলাম ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী—আকাশ থেকে প্রত্যক্ষ করলাম এক সংঘাতের সূচনালগ্ন।
আমরা যে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো দেখেছিলাম, সেগুলো সম্ভবত দীর্ঘপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল—শুধু অস্ত্র নয়; ওগুলো ছিল কৌশলগত বার্তা। এসব ক্ষেপণাস্ত্র শত শত কিলোমিটার ওপরে মহাকাশসীমা স্পর্শ করে আছড়ে পড়ে লক্ষ্যবস্তুতে। মধ্যপ্রাচ্যের আকাশসীমা এখন আর কেবল ট্রানজিট করিডর নয়; এটি হয়ে উঠছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।
ভাগ্যক্রমে, আমাদের যাত্রীরা কোনো বিপদের আঁচ পাননি। তারা টেরও পাননি কী এক ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে দিয়ে তাদের যাত্রা সম্পন্ন হয়েছে। আমরা নিরাপদে অবতরণ করতে পেরেছি বটে, কিন্তু সেই প্রশ্নটি এখনও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়:
আমরা যে আকাশে উড়ি, সেটি আদৌ কতটা নিরাপদ?
- ক্যাপ্টেন এনাম তালুকদার: বিমান-এর পাইলট