ইরান পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের কতটা কাছাকাছি?

ইরান অনেক বছর ধরেই পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আন্তর্জাতিক সন্দেহের মুখে রয়েছে। দেশটি আসলেই কি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে কিনা—তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে, ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্রদের। ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরান সম্প্রতি পারমাণবিক অস্ত্রে ব্যবহৃত উপাদান ফিসাইল ম্যাটেরিয়াল উৎপাদন অনেকগুণ বাড়িয়েছে। এখন তারা এক সপ্তাহেরও কম সময়ে পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন করতে সক্ষম বলে মনে করা হচ্ছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে ইরানের সঙ্গে করা বহুপাক্ষিক পারমাণবিক চুক্তি (জেসিপিওএ) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। এরপরেই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের এই হার বাড়ায় তেহরান। অথচ চুক্তিটি ইরানকে তার পরমাণু কর্মসূচি সীমিত রাখার বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল।
দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার পর ট্রাম্প বলেছেন, তিনি ইরানের সঙ্গে নতুন একটি চুক্তি করতে চান। তবে পাশাপাশি তিনি আগের 'সর্বোচ্চ চাপের' নীতিও আবারো কার্যকর করেছেন—যার আওতায় রয়েছে, তেহরানের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ও সামরিক অভিযানের হুমকি।
এই অবস্থায়, গেল এপ্রিলের মাঝামাঝি ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে পারমাণবিক আলোচনায় বসে। তবে এই আলোচনা চলতি জুনে ষষ্ঠ দফায় গড়ানোর আগেই ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনায় বিমান হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনাকে তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে এবং তেল আবিব বিশ্বাস করে না যে তেহরান ওয়াশিংটনের সঙ্গে কূটনৈতিক চুক্তিকে মানবে।
ইরান কীভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে?
২০১৫ সালের ঐতিহাসিক জয়েন্ট কমপ্রেহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) চুক্তি অনুযায়ী, ইরান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ১৫ বছরের জন্য ইউরেনিয়াম ৩.৭ শতাংশের বেশি মাত্রায় সমৃদ্ধ করবে না। এই মাত্রায় সমৃদ্ধ পারমাণবিক জ্বালানি মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো বেসামরিক কাজে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া তারা ৩০০ কেজি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রাখতে রাজি হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানায়, ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তি থেকে সরে আসার আগপর্যন্ত ইরান এসব শর্ত মেনে চলছিল। সেসময় ইরানের বোমা তৈরির পর্যাপ্ত ফিসাইল উপাদান তৈরি করতে কমপক্ষে এক বছর সময় লাগত।
কিন্তু জেসিপিওএ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার এবং নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের পর এক বছর পেরোতেই ইরান তাদের পরমাণু কর্মসূচি জোরদার করে। তারা শুধু যে ২০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করাই শুরু করে তাই-ই নয়, বরং প্রথমবারের মতো তা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করেছে। আইএইএ'র মতে, এই হারে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের জন্য দরকারি মানের কাছাকাছি পর্যায়ের।

ইরানজুড়ে ছড়িয়ে আছে ডজনখানেক পারমাণবিক স্থাপনা
২০২৫ সালের মে মাসে প্রকাশিত আইএইএ-র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের ৬০ শতাংশ মাত্রার ইউরেনিয়ামের মজুত ফেব্রুয়ারি থেকে ৫০ শতাংশ বেড়ে ৪০৯ কেজি হয়েছে। এই পরিমাণ ইউরেনিয়াম ৯০% মাত্রায় বিশুদ্ধ করলে প্রায় ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি সম্ভব।
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
পারমাণবিক বিদ্যুৎ বা অস্ত্র তৈরি করতে ইউরেনিয়াম-২৩৫ আইসোটোপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—যা ইউরেনিয়াম আকরিকের মাত্র ১ শতাংশেরও কম। এই আইসোটোপ আলাদা করতে লাগে সুপারসনিক গতির হাজার হাজার সেন্ট্রিফিউজ। এটি পুরো প্রক্রিয়ার সবচেয়ে কঠিন ধাপ।
ইরান বলছে, তারা শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করতে চায়, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বশক্তিগুলো সেই দাবি মানতে নারাজ। আইএইএ প্রতিটি দেশের ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডারের প্রতিটি গ্রামের হিসাব রাখে, যেন কেউ উপাদান গোপনে অস্ত্র উৎপাদনে না যায়।
আইএইএ গত জুনে জানায়, ইরান তার নন-প্রলিফেরেশন ট্রিটি লঙ্ঘন করছে, ফলে ইরানের কর্মসূচি এখন "সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ" এবিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।
এই উদ্বেগ নিরসন নাহলে আইএইএ ইরানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে অভিযোগ করতে পারে। তখন জেসিপিওএ চুক্তির "স্ন্যাপব্যাক মেকানিজম" চালু হতে পারে, যার ফলে আবার আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যাবে তেহরানের ওপর।
আইএইএ'র এই বক্তব্যের জবাবে ইরানের পারমাণবিক সংস্থা জানায়, তারা একটি নতুন ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র স্থাপন করবে, যা সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়াবে।
পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপের জন্য ইরানের আর কী দরকার?
শুধু ফিসাইল উপাদান নয়, ইরানের দরকার বোমা তৈরির প্রযুক্তি ও তা নিক্ষেপ করার ব্যবস্থাও। অনুমান করা হয়, ইরান হয়ত একটি সরল ইমপ্লোশন ডিভাইস তৈরি করতে পারে—যেমনটি যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমায় ফেলেছিল।
কিন্তু, এভাবে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করতে হলে নিজ দেশের বিমানকে শত্রুর আকাশসীমায় পাঠাতে হবে, নাহলে বোমাটি জাহাজ বা ট্রাকে পাঠানো যেতে পারে। তবে আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কারণে বিমানে করে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ তেহরানের জন্য কঠিন হবে। জাহাজ বা ট্রাকে পাঠানোও ঝুঁকিপূর্ণ এবং তাতে সফল না হওয়ারই ঝুঁকি বেশি।
সবচেয়ে নিরাপদ হলো, দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারমাণবিক ওয়ারহেড ক্ষেপণাস্ত্রে বসানো। তবে এইক্ষেত্রেও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পর ওয়ারহেডবাহী ভেহিকলকে পুনরায় বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে সক্ষম হতে হবে। ইরান এখনও এমন ওয়ারহেডের পরীক্ষা চালায়নি।
২০০৩ সাল পর্যন্ত ইরান এ নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে, তবে মার্কিন গোয়েন্দাদের মতে, দেশটি এপর্যন্ত সেই গবেষণা পুনরায় শুরু করেনি। গোয়েন্দাসূত্রের ধারণা অনুযায়ী, বর্তমান অবস্থায় পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ করতে ইরানের লাগবে চার মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত।
তখন ইরান ইসরায়েলের পাশাপাশি পুরো ইউরোপকেও তাঁর দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্রের আওতায় আনতে পারবে। ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৫,০০০ কিলোমিটার, যার ফলে পুরো ইউরোপ এর আওতার মধ্যে রয়েছে।
ইসরায়েল কি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করতে পারবে?
ইসরায়েল বারবার বলেছে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি চলে গেলে তারা বিমান হামলা চালাবে—যেভাবে ১৯৮১ সালে ইরাকে ও ২০০৭ সালে সিরিয়ার পারমাণবিক স্থাপনায় করেছে।
কিন্তু ইরানের স্থাপনাগুলোর সংখ্যাই এত বেশি যে, গোয়েন্দা কর্মকর্তারা মনে করছেন একটি হামলা হয়তো কর্মসূচিতে দেরী করাতে পারবে, কিন্তু পুরোপুরি থামাতে পারবে না।
ইরানের মূল সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতানজ মাটির ৪০ মিটার নিচে অবস্থিত। এর ওপর রয়েছে ৮ মিটার পুরু কংক্রিট ও স্টিলের ছাদ। ফোর্দো স্থাপনাটি পাহাড়ের ভিতরে নির্মিত। আইএইএ প্রধান রাফায়েল গ্রোসি বলেন, এটি সম্ভবত ৫০০ মিটার গভীরে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ১৩ জুনের হামলায় "ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির হৃদপিণ্ডে আঘাত হানা হয়েছে" এবং যতদিন এই হুমকি না দূর হয়, ইসরায়েল হামলা চালাতে থাকবে।
তবে আইএইএ বলছে, হামলার পরপরই নাতানজ স্থাপনায় কোনো বিকিরণ বাড়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি—যার মানে হামলা কনটেইনমেন্ট স্তর ভেদ করতে পারেনি।
আইএইএ প্রধান দুই পক্ষকে "সর্বোচ্চ সংযম" প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন।