চীনের বিরল খনিজের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ, বৈশ্বিক অটোমোবাইল শিল্প আতঙ্কে কেন

চীনের বিরল মৃত্তিকা খনিজ (রেয়ার আর্থ মিনারেল) ও শিল্প চুম্বক রপ্তানিতে কড়াকড়ির কারণে ইউরোপীয় গাড়ি নির্মাতা ও যন্ত্রাংশ সরবরাহকারীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। জার্মান ম্যাগনেট নির্মাতা ম্যাগনোস্পেয়ার প্রধান নির্বাহী ফ্রাংক একার্ড বলেন, "পুরো গাড়ি শিল্প এখন সম্পূর্ণ আতঙ্কে, এগুলো পেতে আমরা যেকোনো মূল্য দিতেও প্রস্তুত।"
বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় কারখানা ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। আবার অনেক সংস্থা সতর্ক করছে, বিকল্প ম্যাগনেটের সরবরাহ না মিললে জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
চীন বর্তমানে বিশ্বের বিরল মৃত্তিকা খনিজের ৭০ শতাংশ উত্তোলন, ৮৫ শতাংশ পরিশোধন এবং প্রায় ৯০ শতাংশ ম্যাগনেট বা চুম্বক উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এসব খনিজ ও ম্যাগনেট আধুনিক গাড়ির ইঞ্জিন থেকে শুরু করে সাইড মিরর, অয়েল পাম্প, ব্রেক সেন্সর, উইন্ডশিল্ড ওয়াইপার, স্পিকারসহ ডজনখানেক যন্ত্রাংশে ব্যবহার হয়।
গড়ে একটি বৈদ্যুতিক গাড়িতে প্রায় ৫০০ গ্রাম বিরল খনিজের উপাদান লাগে, যা প্রচলিত জ্বালানিচালিত গাড়ির দ্বিগুণ। ফলে এই সংকট মূলত ইভি (বৈদ্যুতিক গাড়ি) শিল্পকেই সবচেয়ে বেশি আঘাত করছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিরল খনিজ উপাদান ও ম্যাগনেট যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করার প্রতিশ্রুতি দিলেও, শিল্প বিশ্লেষকরা এটিকে ক্ষণস্থায়ী আশ্বাস হিসেবে দেখছেন। আজ সোমবার দুই দেশের কর্মকর্তারা লন্ডনে বৈঠকেও অংশ নিচ্ছেন, তবে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের বিষয়ে টেকসই সিদ্ধান্ত আসা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
শিল্পখাতের নেতারা আশঙ্কা করছেন, রপ্তানিতে চীনের কড়াকড়ির কারণে বিরল খনিজের সংকট—সাম্প্রতিক ইতিহাসের তৃতীয় বড় সরবরাহ সংকটে পরিণত হতে পারে। এর আগে ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারিতে এবং ২০২১-২৩ সালের কম্পিউটার চিপ বা সেমিকন্ডাক্টর সংকটে শিল্প উৎপাদনে ব্যাপক ধস নেমেছিল।
গাড়ি নির্মাতারা অতীতে 'জাস্ট-ইন-টাইম' পদ্ধতিতে খরচ কমালেও, এই সংকট তাদের বিরল খনিজ মজুত করে রাখার প্রয়োজনীয়তা—নতুন করে উপলদ্ধি করতে বাধ্য করছে। তবুও ম্যাগনেট সংকট নিয়ে তাদের প্রস্তুতির ঘাটতি স্পষ্ট।
সিএলইপিএ নামের একটি ইউরোপীয় গাড়ি সরবরাহকারী সংস্থার মতে, "এই সংকট শেষ পর্যন্ত সবাইকে ঘিরে ধরবে।"
চীন ২০১০ সালেও জাপানের সঙ্গে বিরোধে বিরল খনিজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। জাপান তখন বিকল্প উৎস খুঁজতে বাধ্য হয়, এবং ২০১৮ সাল নাগাদ চীন থেকে আমদানি ৫৮ শতাংশে নামিয়ে আনে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিওকর্পসহ বিভিন্ন খনি কোম্পানি চীনের বিকল্প হিসেবে বিরল খনিজের খনি উন্নয়নকাজ করছে, তবে সেগুলোতে উৎপাদন শুরু হতে আরও কয়েক বছর লাগবে।
বিএমডব্লিউ, জেনারেল মোটরস, জেডএফ, বর্গওয়ার্নারের মতো বড় নির্মাতারা বিরল খনিজ ছাড়াই মোটর তৈরির চেষ্টা করছে। ইংল্যান্ডের ওয়ারউইক অ্যাকুস্টিকস বিরল খনিজবিহীন স্পিকার তৈরি করেছে, যা চলতি বছর একটি বিলাসবহুল গাড়িতে ব্যবহৃত হবে।
তবে এইসব বিকল্প প্রযুক্তি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে, এবং বৃহৎ উৎপাদনের জন্য আরও সময় ও বিনিয়োগ লাগবে।
এদিকে ম্যাগনেট পুনর্ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠান হেরাউস জানিয়েছে, তাদের কার্যক্রম মাত্র ১ শতাংশ সক্ষমতায় চলছে এবং বিক্রি না বাড়লে আগামী বছর কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
মার্কিন প্রতিষ্ঠান নাইরন ইতোমধ্যে বিরল খনিজ ছাড়াই ম্যাগনেট তৈরি করেছে এবং জিএম, স্টেলান্টিস, ম্যাগনা'র মতো বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ২৫ কোটি ডলারের বেশি তহবিল সংগ্রহ করেছে। তারা ২০২৯ সালে ১ বিলিয়ন ডলারের একটি প্ল্যান্ট চালু করার পরিকল্পনাও করেছে।
স্বল্পমেয়াদে এসব খনিজের সংকট এড়াতে বিভিন্ন সংস্থা– চীন থেকে এগুলোর রপ্তানির পারমিট জোগাড়, বিকল্প উৎস খোঁজা ও মজুত গড়তেই ব্যস্ত।
বিশ্লেষকদের মতে, ম্যাগনেট সংকটের কারণে গাড়ি নির্মাতারা চিপ সংকটের মতো আবারও অসম্পূর্ণ গাড়ি তৈরি করে গুদামে রাখতে বাধ্য হতে পারে।
তবে বিরল খনিজ দিয়ে চীনের নিয়ন্ত্রণ এখানেই শেষ নয়। ইউরোপীয় কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন বিশ্বের ১৯টি গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের অর্ধেকের বেশি সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে— যার মধ্যে রয়েছে ম্যাঙ্গানিজ, গ্রাফাইট ও অ্যালুমিনিয়াম।
"এটি আসলে একটি সতর্কবার্তা মাত্র," বলেন সরবরাহ শৃঙ্খলা বিশ্লেষক অ্যান্ডি লেল্যান্ড। তাঁর মতে, "এর পর আরও কিছু আসতে পারে।" অর্থাৎ, পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে দ্বন্দ্বের মধ্যে বেইজিং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্প কাঁচামাল, যন্ত্রাংশ রপ্তানিকেও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে এমন আশঙ্কাই তিনি করছেন।