চীনের পরিবহন শিল্পে পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে চালকবিহীন ট্রাক

চীনের বেইজিং ও তিয়ানজিন বন্দরের মাঝের হাইওয়েতে বড় বড় কিছু ট্রাক চলতে দেখা যায়। ড্রাইভার ছাড়াই এসব ট্রাক স্বয়ংক্রিয়ভাবে সড়কে চলাচল করে। ট্রাকগুলোয় ড্রাইভারের প্রয়োজন না থাকলেও দেশটির সরকার এসব ট্রাকে একজন করে 'সেফটি ড্রাইভার' থাকা বাধ্যতামূলক করেছে। আর সেটা কেবল যেকোনো জরুরি কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করেই। খবর বিবিসির।
অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, খুব শিগগিরই এই 'সেফটি ড্রাইভারদেরও' আর প্রয়োজন হবে না।
৩২ বছর বয়সি হুও কাংতিয়ান একজন 'সেফটি ড্রাইভার'। প্রথমবার যখন তিনি চালকের আসনে বসে ট্রাকের স্টিয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছিলেন এবং এটিকে নিজে থেকে চলতে দিয়েছিলেন, তখন তিনি বেশ বিস্মিত হয়েছিলেন ঠিকই, তবে কিছুটা ভয়ও পেয়েছিলেন।
এরপর কাংতিয়ান ট্রাকের স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলার বিষয়টি আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। এখন তিনি মনে করেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলাচলের সময় নিরাপত্তা নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেই।
তিনি জানান, চালকের আসনে তার থাকার কারণ হলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলাচলের সময় কোনো কিছু ভুল হলে কোনো দুর্ঘটনার আগেই যাতে তাৎক্ষণিকভাবে ট্রাকটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
তিনি বলেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে পারার কারণে ড্রাইভাররাও কিছুটা নির্ভার থাকতে পারেন। এতে তাদের ক্লান্তিও কমে।
এই প্রযুক্তির কারণে মানুষের চাকরি হারানোর ভয় আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে কাংতিয়ান বলেন, তার এ বিষয়ে তেমন জানাশোনা নেই।
সফটওয়্যার কোম্পানি পোনি.এআইয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট লি হেংইউ বলেন, তাদের চালকবিহীন ট্রাক এখনো শুরুর পর্যায়েই রয়েছে। তারা কেবল এটিকে পরীক্ষামূলকভাবে সড়কে চালিয়ে দেখছেন।
তিনি আশাবাদী যে ভবিষ্যতে চালকবিহীন ট্রাক ও পরিবহন ব্যবস্থায় অবশ্যই ব্যাপক অগ্রগতি হবে। এটি একদিকে খরচ কমাবে, অন্যদিকে প্রতিকূল পরিবেশ ও দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়াও সহজ করবে।
সাংহাই জিয়াওটং ইউনিভার্সিটির প্রযুক্তি বিষয়ক অধ্যাপক ইয়াং রুইগাং বলেন, আসলে এ সবকিছুই খরচ বাঁচানোর জন্য। কোম্পানিগুলো এমন যেকোনো কিছু চায় যা খরচ কমাবে। তাই তারা চালকবিহীন ট্রাকে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
এক বাক্যে তার ভাষ্য হলো- এর লক্ষ্য ড্রাইভারের খরচ প্রায় শূন্যে নিয়ে আসা।
তবে ট্রাকগুলোকে পুরোপুরি সড়কে নামানোর আগে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে, বিশেষ করে মানুষের ভয়।
এর আগে একবার একটি ট্রাক 'অটো-পাইলট' মুডে চলার সময় দুর্ঘটনা হয়েছিল। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী নিহত হন। সে সময় এই প্রযুক্তি বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়েছিল।
বিশ্লেষক চিম লি বলেন, চীনের মানুষ এখনো সেভাবে চালকবিহীন যানবাহনে ভরসা করে না।
তিনি বলেন, যাত্রীবাহী যানবাহন সংশ্লিষ্ট সাম্প্রতিক দুর্ঘটনাগুলো মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করেছে। আর এটা তো চালকবিহীন ট্রাক। তাই এসব ট্রাক সম্পর্কে মানুষের ধারণা সরকার ও সংশ্লিষ্ট কোম্পানির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অধ্যাপক ইয়াং এ বিষয়ে একমত যে এখনই বিপুল সংখ্যক ট্রাকচালককে চাকরি হারাতে হচ্ছে না। তিনি বলেন, এটা নির্ভর করছে পরিস্থিতির ওপর। উন্মুক্ত বা উচ্চগতির সড়কে চলাচলের জন্য এখনো চালকবিহীন ট্রাক উপযুক্ত নয়। কিন্তু ধীর গতির সড়কে এটি ইতোমধ্যেই ব্যবহার শুরু হয়েছে।
চীনের পূর্বাঞ্চলীয় আনহুই প্রদেশের হেফেই শহরে চালকবিহীন শতাধিক ভ্যান ব্যবহার করে পণ্য পরিবহনের কাজ করা হচ্ছে।
যানবাহন কোম্পানি রিনো.এআইয়ের প্রেসিডেন্ট গ্যারি হুয়াং বলেন, তারা চালকবিহীন ভ্যানের একটি ভালো ব্যবহার খুঁজে পেয়েছেন। আর তা হলো, বড় কুরিয়ার হাব থেকে স্থানীয় স্টেশনে পণ্য পৌঁছানো।
রিনো অন্য দেশগুলোর সাথেও কাজ করছে। এ বছরের শেষ দিকে অস্ট্রেলিয়ার একটি সুপারমার্কেট চেইন তাদের চালকবিহীন ভ্যান ব্যবহার শুরু করবে।
চীনে এখন ৫০টিরও বেশি শহরে ৫০০টির বেশি চালকবিহীন ভ্যান চলাচল করছে। সবচেয়ে বেশি চালকবিহীন ভ্যান চলে হেফেই শহরে।
গ্যারি হুয়াং বলেন, আপনি রাস্তায় ভ্যানগুলোকে দেখতে পাবেন। এগুলো লেন পরিবর্তন করছে, সংকেত দিচ্ছে, লাল বাতি জ্বলে উঠলে থামছে এবং অন্য গাড়িগুলোর সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলছে।
কুরিয়ার কোম্পানিগুলোও বলছে, গাড়িগুলো বেশ ভালো কাজ করছে।
রিনোর আঞ্চলিক পরিচালক ঝাং কিচেন বলেন, পণ্যের ডেলিভারি এখন আরও দ্রুত হচ্ছে। এছাড়াও এক চালকের খরচে তিনটি বৈদ্যুতিক চালকবিহীন ভ্যান কয়েকদিন চালানো সম্ভব হচ্ছে।
অধ্যাপক ইয়াং বলেন, 'মহাসড়কে বড় বড় ট্রাক স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলাচল করতে এখনো অন্তত পাঁচ বছর সময় লাগবে।
এটা সম্ভব কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমি প্রায় নিশ্চিত এটা ঘটবেই। আসলে আমি বিশ্বাস করি এটা অবশ্যই ঘটবে।'
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক