জিনপিংয়ের সঙ্গে ‘দারুণ’ ফোনালাপের পর চীন সফরের ঘোষণা ট্রাম্পের

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর দেশটিতে সফরে যাবেন বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি জানিয়েছেন, 'দারুন' ওই ফোনালাপের সময় তিনি শি জিনপিংকে হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। খবর বিবিসি'র।
তবে দুই পক্ষের কেউই এখন পর্যন্ত এমন সফরের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কিছু নিশ্চিত করেনি।
ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বৃহস্পতিবার (৫ জুন) দুই নেতার মধ্যে প্রথমবারের মতো ফোনালাপ হয়। চীনা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, হোয়াইট হাউজের অনুরোধে এই আলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, দেড় ঘণ্টাব্যাপী এই আলাপের মূল বিষয় ছিল বাণিজ্য এবং এর মাধ্যমে 'উভয় দেশের জন্যই অত্যন্ত ইতিবাচক একটি পরিণতি' এসেছে।
জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেৎর্সের সঙ্গে ওভাল অফিসে সাক্ষাৎ করার সময় ট্রাম্প বলেন, 'তিনি (শি জিনপিং) আমাকে চীনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আর আমি তাকে এখানে আমন্ত্রণ জানিয়েছি।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা দুজনেই সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি। ফলে আমি ওখানে ফার্স্ট লেডিকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি, আর আশা করি—তিনি চীনের ফার্স্ট লেডিকে নিয়ে এখানে আসবেন।'
এদিকে, চীনের পক্ষ থেকে প্রকাশিত আলোচনার বিবরণে আমন্ত্রণের বিষয়টি উল্লেখ করা হলেও হোয়াইট হাউজের পাল্টা আমন্ত্রণের কথা তাতে বলা হয়নি।
চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা সিনহুয়ার বরাতে জানা যায়, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের চীনের বিরুদ্ধে নেওয়া নেতিবাচক পদক্ষেপগুলো প্রত্যাহার করা উচিত।'
খবরে আরও বলা হয়, শি ট্রাম্পকে জানান, চীন তার প্রতিশ্রুতি সবসময়ই রক্ষা করে। যেহেতু দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো হয়েছে, উভয় পক্ষেরই উচিত সেই চুক্তি মেনে চলা। জেনেভায় চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সদ্য স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির প্রতি এটি ছিল ইঙ্গিত।
তবে উভয় দেশই পরস্পরের বিরুদ্ধে ঐ চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ তুলেছে। উল্লেখ্য, চুক্তিটির লক্ষ্য ছিল দ্বিপক্ষীয় শুল্ক হার নাটকীয়ভাবে কমিয়ে আনা, যেটিকে ট্রাম্প 'একটি সম্পূর্ণ পুনর্গঠন' হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
ট্রাম্প একাধিক দেশের আমদানির ওপর শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এই পরিস্থিতি শুরু হয়। তবে তিনি চীনের ওপরই সর্বোচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করেন। এর পাল্টা জবাবে বেইজিং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করে। এতে পাল্টাপাল্টি শুল্ক বৃদ্ধি এক সময় সর্বোচ্চ ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছায়।
মে মাসে একটি প্রাথমিক সমঝোতার পর যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক কমিয়ে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনে। অপরদিকে বেইজিং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর শুল্ক ১০ শতাংশে নামিয়ে আনে এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রপ্তানিতে আরোপিত প্রতিবন্ধকতা তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
এই সমঝোতার আওতায় দুই পক্ষকে একটি বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছাতে ৯০ দিনের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
তবে এরপর থেকে আলোচনার গতি থমকে যায়। উভয় পক্ষ থেকেই চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে, যা এই অচলাবস্থাকে আরও ঘনীভূত করেছে।
চীনের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ ও বিরল মৃত্তিকা চুম্বক (রেয়ার আর্থ ম্যাগনেট) চালান পুনরায় শুরু করতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ আনে যুক্তরাষ্ট্র। এসব উপাদান গাড়ি ও কম্পিউটার শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ অভিযোগ অস্বীকার করে এবং পাল্টা অভিযোগ করে, কম্পিউটার চিপের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই সমঝোতা নস্যাৎ করেছে।
প্রসঙ্গত, ট্রাম্প প্রশাসন সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন সফটওয়্যারের রপ্তানিতে নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করে এবং চীনা শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিলের ঘোষণাও দেয়।
ফোনালাপের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, 'বিরল মৃত্তিকা পণ্যের জটিলতা নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন থাকা উচিত নয়।'
হোয়াইট হাউজে সাংবাদিকদের তিনি আরও বলেন, 'চীনা শিক্ষার্থীরা আসতে পারে, কোনো সমস্যা নেই, কোনো সমস্যা নেই—সত্যি বলতে গর্বের বিষয়। তবে আমরা তাদের যাচাই করে নিতে চাই।'
চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, তাইওয়ান ইস্যুতে ওয়াশিংটনকে 'সতর্কতার সঙ্গে' আচরণ করার ব্যাপারে হুঁশিয়ার করেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ তাইওয়ানকে ঘিরে চীনের 'আসন্ন হুমকি'র বিষয়ে মন্তব্য করার কয়েকদিন পরেই শি এ মন্তব্য করেন।
সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত শাংরি-লা সংলাপে হেগসেথ বলেন, 'ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তনে সামরিক শক্তি ব্যবহারের জন্য বিশ্বাসযোগ্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বেইজিং।'
চীন তাইওয়ানকে তাদের বিচ্ছিন্ন এক প্রদেশ মনে করে, যেটিকে একসময় ফের একত্র করা হবে বলে তারা বিশ্বাস করে। এই লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের বিষয়টিও তারা অস্বীকার করেনি। যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে সামরিক সহায়তা দিলেও, 'এক চীন' নীতির কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দেয় না।
বৃহস্পতিবারের ফোনালাপের যে সারসংক্ষেপ চীনা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে বলা হয়—শি জিনপিং যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে বলেন, 'তাইওয়ান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রকে বিচক্ষণতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে কয়েকজন তাইওয়ান স্বাধীনতাপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে সংঘাত ও মুখোমুখি অবস্থানের মতো বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ঠেলে না দেয়।'
ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম সপ্তাহ থেকেই হোয়াইট হাউজ দাবি করছিলো, এই দুই নেতা শিগগিরই কথা বলবেন। তবে চলতি সপ্তাহের শুরুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রাম্প নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তিনি লিখেছেন, 'আমি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে পছন্দ করি, সব সময়ই করেছি, ভবিষ্যতেও করব। কিন্তু তিনি বেশ কঠোর, তার সঙ্গে কোনো চুক্তি করা খুব কঠিন।'
ট্রাম্প স্পষ্ট করেছেন, আলোচনায় তিনি সরাসরি যুক্ত থাকতে চান। তবে চীনের ব্যবসা করার ধরণ এ রকম নয়।
বেইজিং সাধারণত বিশ্বাসযোগ্য একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে আলোচনার দল গঠন করে। রাষ্ট্রপ্রধানদের ফোনালাপ বা বৈঠক সব সময় খুব পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।
তাছাড়া চীন চায় না, ওয়াশিংটনের চাপে তারা নতিস্বীকার করছে এমন ভাবা হোক।