'বন্দুকের মুখে আমাকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়'

কয়েক দিন আগের স্মৃতিগুলো মনে পড়লেই এখনও কেঁপে ওঠেন সোনা বানু।
৫৮ বছর বয়সী সোনা বানু ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আসামের বরপেটা জেলার বাসিন্দা। তিনি জানান, গত ২৫ মে স্থানীয় থানায় ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। পরে থানার লোকজন তাকেসহ আরও প্রায় ১৩ জনকে সীমান্তের কাছে একটি স্থানে নিয়ে গিয়ে জোরপূর্বক বাংলাদেশে ঠেলে দেয়।
কেন এমন করা হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা তাদের দেওয়া হয়নি। তবে এরকম কিছু ঘটতে পারে—এমন আশঙ্কা সোনা বানুর মনে আগেই ছিল।
সোনা বানু জানান, পুরো জীবনই তিনি আসামে কাটিয়েছেন। তবে দীর্ঘদিন ধরে তিনি মরিয়া হয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে তিনি একজন ভারতীয় নাগরিক, বাংলাদেশ থেকে আগত কোনও 'অবৈধ অনুপ্রবেশকারী' নন।
আটক হওয়ার ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতা মনে করে এখনও শিউরে ওঠেন সোনা বানু। জানান, 'হঠাৎ তারা আমাকে বন্দুকের মুখে ঠেলে দিলো। দুই দিন খাবার-পানির ব্যবস্থা ছাড়াই হাঁটু-গভীর পানিতে ডুবে থাকা, পোকামাকড় আর পিঁপড়েভরা একটি মাঠে থাকতে হয় আমাকে।'
সেই দুই দিন 'নো ম্যানস ল্যান্ড'-এ থাকার পর, তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বাংলাদেশের একটি পুরনো কারাগারে।
সেখানে আরও দুই দিন থাকার পর, সোনা বানু ও কয়েকজনকে—যদিও তিনি নিশ্চিত নন, সবাই একই দলে ছিলেন কিনা—বাংলাদেশি কর্মকর্তারা সীমান্ত পার করিয়ে দেন। পরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের গ্রেফতার করে পুনরায় বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
সোনা বানুকে কেন হঠাৎ করে বাংলাদেশে পাঠানো হলো, আবার কেন ফিরিয়ে নেওয়া হলো—তা এখনো স্পষ্ট নয়।

তবে এই ঘটনা আসামে নতুন নয়, বরং সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া একাধিক ঘটনার মধ্যে একটি, যেখানে দেখা যাচ্ছে ভুক্তভোগীদের অনেককেই আদালত 'বিদেশি' ঘোষণা করেছে। এরপর 'অবৈধ বাংলাদেশি' সন্দেহে তাদের ধরে নিয়ে সীমান্তে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
বিবিসি কমপক্ষে এমন ছয়টি ঘটনার তথ্য পেয়েছে, যেখানে পরিবার সদস্যদের ধরে নিয়ে সীমান্তে নিয়ে জোরপূর্বকভাবে বাংলাদেশে 'ঠেলে দেওয়া' হয়েছে।
তবে ভারতের সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী (বিএসএফ), আসাম পুলিশ ও রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বিবিসির প্রশ্নের কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ থেকে 'অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের' বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান ভারতের জন্য নতুন নয়। প্রায় ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত তুলনামূলকভাবে সহজে পার হওয়া যায়—যদিও সংবেদনশীল এলাকাগুলোতে কঠোর পাহারা রয়েছে।
তবে, এ বিষয়ে কাজ করা আইনজীবীরা বলছেন, কাউকে হঠাৎ বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গোপনে অন্য দেশে ঠেলে দেওয়ার ঘটনা অতীতে খুবই বিরল ছিল। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে এরকম ঘটনার সংখ্যা বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
এই অভিযানে এখন পর্যন্ত কতজনকে সীমান্ত পেরিয়ে পাঠানো হয়েছে, তা নিয়ে ভারত সরকার এখনো কোনও আনুষ্ঠানিক তথ্য প্রকাশ করেনি। তবে বাংলাদেশের শীর্ষ প্রশাসনিক সূত্র দাবি করেছে, শুধু মে মাসেই আসামসহ কয়েকটি রাজ্য থেকে ১ হাজার ২০০ জনের বেশি মানুষকে 'অবৈধভাবে ঠেলে দেওয়া' হয়েছে।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে সূত্রগুলো আরও জানায়, বাংলাদেশ এদের মধ্যে অন্তত ১০০ জনকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে শনাক্ত করে ফেরত পাঠিয়েছে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এ ধরনের অননুমোদিত অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে।
তবে ভারত সরকার এখনো এসব অভিযোগ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেনি।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক এই অভিযানে অন্যান্য রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিমদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
তবে আসামের পরিস্থিতি বিশেষভাবে উত্তেজনাপূর্ণ ও জটিল। সেখানে নাগরিকত্ব ও জাতিগত পরিচয় ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক বিতর্ক ও উত্তেজনা বিরাজ করছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার সীমান্ত ভাগ করে নেওয়া আসামে আশ্রয়ের খোঁজে কিংবা ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে পালিয়ে বহু অভিবাসী প্রবেশ করেছে প্রতিবেশী দেশ থেকে।
এই অভিবাসন নিয়ে আসামের বাসিন্দাদের মধ্যে উদ্বেগ দীর্ঘদিনের। অনেকেরই আশঙ্কা, এতে রাজ্যের জনসংখ্যার ভারসাম্য পরিবর্তিত হচ্ছে এবং স্থানীয় জনগণের সম্পদের ওপর চাপ বাড়ছে।
আসামসহ কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বারবার 'অবৈধ অনুপ্রবেশ' ঠেকানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। এ বিষয়ে তাদের রাজ্যের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ছিল জাতীয় নাগরিক রেজিস্টার (এনআরসি)।
এনআরসি এমন একটি তালিকা, যাতে শুধুমাত্র তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যারা প্রমাণ করতে পেরেছেন—তারা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ বা তার আগে আসামে এসেছেন। সেই দিনটির ঠিক পরদিন বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
তালিকাটি কয়েক দফায় পুনর্বিবেচনার পর ২০১৯ সালে চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশিত হয়, যেখানে প্রায় ২০ লাখ আসামবাসীর নাম বাদ পড়ে যায়। এদের অনেককেই আটক করে রাখা হয়েছে বন্দিশিবিরে। অন্যরা উচ্চ আদালতে নাগরিকত্ব হারানোর বিরুদ্ধে আপিল করেছেন।
এ তালিকায় নাম না ওঠা ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব প্রমাণের সুযোগ দেওয়া হয় 'ফরেনার্স ট্রাইবুনাল' নামে পরিচিত বিশেষ আদালতগুলোতে—যা প্রথাগত বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে পরিচালিত হয়।
সোনা বানু জানান, তার মামলাটি বর্তমানে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে চলমান থাকা সত্ত্বেও, কর্তৃপক্ষ তাকে জোরপূর্বক সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে।
বিবিসি'র সঙ্গে কথা বলা আসাম রাজ্যের আরও অন্তত ছয়জন মুসলিম একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তারা বলেন, পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকার পরেও—এবং বহু প্রজন্ম ধরে ভারতে বসবাস করা সত্ত্বেও—তাদের সোনা বানুর সঙ্গেই বাংলাদেশে পাঠানো হয়।
এই ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত চারজন পরে ফিরে আসেন। তবে তাদের আটক ও ঠেলে দেওয়ার পেছনে কী কারণ ছিল, তা এখনও পরিষ্কার নয়।
আসামের প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান, যাদের অনেকেই ব্রিটিশ শাসনামলে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত অভিবাসীদের বংশধর।
সোনা বানুর মতই আরেক ভুক্তভোগী ৬৭ বছর বয়সী মালেকা খাতুন। তবে তার ভাগ্যে এখনও নিজের বাড়িতে ফেরার সুযোগ আসেনি। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশে রয়েছেন, এক স্থানীয় পরিবারের আশ্রয়ে।
কষ্টে কান্না জড়ানো কণ্ঠে মালেকা বলে ওঠেন, 'আমার এখানে কেউ নেই।'
তিনি ফোনে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন ঠিকই, তবে কখন বা আদৌ ফিরতে পারবেন কিনা, তা জানেন না। ফরেনার্স ট্রাইবুনাল এবং রাজ্যের হাইকোর্টে মামলায় হেরে যাওয়ার পর তিনি আর সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেননি।

এমন অভিযানের কয়েক দিনের মধ্যেই, আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ফেব্রুয়ারি মাসে সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশনার কথা উল্লেখ করেন। সেই নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, যেসব ব্যক্তি 'বিদেশি' হিসেবে ঘোষণা পেয়ে আটককেন্দ্রে রয়েছেন, তাদের বহিষ্কারের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
শর্মা বলেন, 'যারা আদালতে আপিল করেননি, আমরা তাদের ফিরে পাঠাচ্ছি।'
তিনি আরও দাবি করেন, যারা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন, তারা কোনো 'হয়রানির শিকার হচ্ছেন না'।
তবে আসামের নাগরিকত্ব মামলায় কাজ করা আইনজীবী আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া অভিযোগ করেন, এসব ক্ষেত্রে অন্তত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যথাযথ সমন্বয় প্রয়োজন, কিন্তু সাম্প্রতিক বেশিরভাগ ঘটনায় এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি।
তিনি বলেন, 'যা ঘটছে, তা আদালতের নির্দেশের ইচ্ছাকৃত ও বিকৃত ব্যাখ্যা।'
সম্প্রতি ভূঁইয়া একটি ছাত্র সংগঠনের পক্ষে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন দাখিল করেন, যাতে 'জোরপূর্বক ও অবৈধভাবে ঠেলে দেওয়ার নীতি' বন্ধে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়। তবে সুপ্রিম কোর্ট আপাতত তাদের প্রথমে আসাম হাইকোর্টে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

বরপেটা থেকে প্রায় ১৬৭ কিলোমিটার দূরে মরিগাঁও জেলার এক স্কুল শিক্ষক, ৫১ বছর বয়সী খায়রুল ইসলামও সোনা বানুর সঙ্গে একই দলে ছিলেন—যাদের পুলিশ গোপনে ধরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
২০১৬ সালে একটি ফরেনার্স ট্রাইবুনাল তাকে 'বিদেশি' ঘোষণা করে। এরপর তিনি দুই বছর আটককেন্দ্রে কাটিয়ে মুক্তি পান। বর্তমানে তার মামলাও সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন।
খায়রুল ইসলামের স্ত্রী রিতা জানান, তার স্বামীর উচ্চমাধ্যমিকের সনদপত্র ও জমির দলিলসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিল।
'প্রত্যেকটি কাগজ প্রমাণ করে যে আমার স্বামী ভারতীয়,' বলেন রিতা। 'তবুও এগুলো কর্তৃপক্ষের কাছে যথেষ্ট ছিল না।'
তিনি জানান, তার স্বামী, বাবা-দাদা সবাই ভারতের মাটিতেই জন্মেছেন।
তবুও গত ২৩ মে, পুলিশ কোনও ব্যাখ্যা না দিয়ে খায়রুল ইসলামকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। কয়েক দিন পর, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় এক সাংবাদিকের ভাইরাল ভিডিও দেখে তার পরিবার জানতে পারে খায়রুল এখন বাংলাদেশে।
সোনা বানুর মতোই, খায়রুল ইসলামকেও শেষপর্যন্ত ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তার পরিবার এ তথ্য নিশ্চিত করলেও, আসামের পুলিশ বিবিসিকে জানায়—তাদের কাছে এ বিষয়ে 'কোনো তথ্য নেই'।
এদিকে, সেদিন ভুল পরিচয়ে 'বিদেশি' ঘোষণার শিকার হন আরও অনেকে। তাঁদেরই একজন সঞ্জিমা বেগমের বাবা আবদুল লতিফ।
সঞ্জিমা বলেন, 'আমার বাবার নাম আবদুল লতিফ, আর দাদার নাম আবদুল সুবহান। কিন্তু ট্রাইবুনালের নোটিশে লেখা ছিল—আবদুল লতিফ, শুকুর আলীর পুত্র। তিনি তো আমার দাদা নন, আমি তো তাকে চিনি না।'
তিনি জানান, বাবার নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র তাদের কাছে আছে।
পরিবারটি জানতে পেরেছে—আবদুল লতিফ এখন আবার আসামে ফিরেছেন, তবে এখনও বাড়িতে পৌঁছাননি।
তবে যেসব মানুষ এভাবে হঠাৎ করে আটক হয়ে সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল এবং পরে ফিরেছেন, তাদের অনেকেই এখনো আতঙ্কে আছেন। তাদের ভয়, আবারও যেকোনো সময় গ্রেফতার করা হতে পারে।
চোখেমুখে একরাশ ক্লান্তি আর ক্ষোভ নিয়ে সঞ্জিমা বলেন, 'আমরা কোনও খেলনা নই, আমরাও মানুষ। আমাদের যখন খুশি সীমান্তের এপার-ওপার ছুড়ে ফেলে দেয়া যায় না।'