মাত্র ১৪ বছর বয়সেই তৈরি করেছেন এমন অ্যাপ যা কয়েক সেকেন্ডেই হৃদ্রোগ শনাক্ত করবে

ভারতে পরীক্ষামূলকভাবে স্মার্টফোন ভিত্তিক এআই অ্যাপ ব্যবহার করে মাত্র সাত সেকেন্ডের মধ্যে সম্ভাব্য হৃদ্রোগে আক্রান্ত ৪০ জন রোগীর রোগ শনাক্ত ও নির্ণয় করছেন সিদ্ধার্থ নন্দ্যালা। কোনো চিকিৎসক বা চিকিৎসাশাস্ত্রের ছাত্র না হয়েও মাত্র ১৪ বছর বয়সে সিদ্ধার্থ সার্কাডিয়ান এআই নামে এ অ্যাপটি উদ্ভাবন করেছেন।
গত বছর প্রায় আট মাস ধরে, টেক্সাসে বসবাসরত এই কিশোর কম্পিউটারের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছেন। তার একটি সরল লক্ষ্য ছিল—একটি এমন অ্যাপ তৈরি করা, যা হৃদরোগের প্রাথমিক পর্যায়ে অস্বাভাবিকতা শনাক্ত করতে পারে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, হৃদরোগের প্রথম লক্ষণ হলো হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক। প্রাথমিক পর্যায়ের হৃদ্রোগ সাধারণত উপসর্গহীন থাকে, আর তা শনাক্ত করার জন্য নির্ভর করতে হয় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম (ইসিজি), স্ট্রেস টেস্ট, ইকোকার্ডিওগ্রাম এবং রক্ত পরীক্ষার ওপর। কিছু নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক টুল যেমন কার্ডিয়াক এমআরআই (গ্যাডোলিনিয়াম ব্যবহার করে), ইনভেসিভ করোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি, রাইট হার্ট ক্যাথেটারাইজেশন এবং এন্ড-স্টেজ ড্যামেজ শনাক্তকরণে ব্যবহৃত বায়োমার্কার—এসব কেবল তখনই কার্যকর যখন রোগী ইতোমধ্যে মারাত্মক ব্লকেজ, হৃদ্যন্ত্রের ব্যর্থতা বা মৃত টিস্যু সমস্যায় ভুগছেন অর্থাৎ রোগটি শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে অ্যাট ডালাসে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছেন সিদ্ধার্থ নন্দ্যাল। তিনি বলেন, "আমার মূল লক্ষ্য ছিল এমন একটি টুল তৈরি করা, যা সহজ, ব্যথাহীন স্ক্রিনিং পদ্ধতির মাধ্যমে অনেক মানুষকে সহায়তা করতে পারে।"
শৈশব থেকেই প্রযুক্তি, কোডিং এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রতি আগ্রহী ছিলেন নন্দ্যালা। ২০২২ সালে, তিনি ভারতে মাত্র ১৫০ ডলারে একটি প্রোস্থেটিক আর্ম (কৃত্রিম হাত) ডিজাইন করেন। সেসময় প্রচলিত কৃত্রিম হাতের দাম হতে পারে ৩০ হাজার ডলার পর্যন্ত। এর পরের বছর, তিনি 'এসটিইএম আইটি' নামে একটি স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার্থীদের জন্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিতের কিট তৈরি ও বিক্রি করে। স্থানীয় ফ্রিসকো চেম্বার অব কমার্স তাকে 'ইনোভেটর অব দ্য ইয়ার' হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং তখন সপ্তম শ্রেণির এই শিক্ষার্থীকে তার কোম্পানির জন্য ২ হাজার ডলারের বেশি অনুদান দেওয়া হয়।
এ ছাড়াও, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস থেকে একটি 'সার্টিফিকেট অব রিকগনিশন' এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পক্ষ থেকে অভিনন্দন বার্তা পান। এরপর ২০২৪ সালে তিনি এমন একটি আর্মব্যান্ড আবিষ্কার করেন, যা প্রবীণদের পড়ে যাওয়া শনাক্ত করতে পারে ৯৬.১ শতাংশ নির্ভুলতায় এবং এটি অ্যাপল ওয়াচের চেয়েও কার্যকর।
সিদ্ধার্থ বলেন, "হেলথকেয়ার খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আমার আগ্রহ আসলে এসেছে এর বিশাল প্রভাব এবং সম্ভাব্য পরিবর্তনের কথা ভেবে।"
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, হৃদ্রোগ বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান কারণ। ২০২১ সালে হৃদ্রোগে মারা গেছেন ১ কোটি ৯৯ লাখ ১০ হাজার মানুষ, যা প্রতি তিনটি মৃত্যুর মধ্যে একটির সমান। জার্নাল অব কার্ডিয়াক ফেইলিয়রে প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০ বছর বা তদূর্ধ্ব প্রায় ৬.৭ মিলিয়ন মানুষ হৃদ্রোগে ভুগছেন। এই সংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে বেড়ে ৮.৭ মিলিয়ন, ২০৪০ সালে ১০.৩ মিলিয়ন এবং ২০৫০ সালে ১১.৪ মিলিয়নে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে।
সিদ্ধার্থ বলেন, "কেবল একজনের রোগ শনাক্ত করা মানেই একটি জীবন বাঁচানো।"
রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে অনেক সময়ই তার ক্ষতি ধীর করা বা পুরোপুরি উল্টে দেওয়া সম্ভব হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা রোগীর জীবনমান উন্নত করার, মৃত্যুর হার কমানোর এবং স্বাস্থ্যসেবার খরচ হ্রাস করার সুযোগ সৃষ্টি করে। এটি ব্যক্তির ওপর রোগের চাপ অনেকটাই কমিয়ে দেয়।
তবে অনেক নিম্ন ও মধ্য-আয়ের দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের অনুপস্থিতির কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করা কিংবা সঠিক চিকিৎসা প্রাপ্তি সবসময় সম্ভব হয় না। কার্যকর ও সমতাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার অভাব এবং অন্যান্য সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণে এসব দেশে মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী হৃদ্রোগজনিত মৃত্যুর ৮০ শতাংশই ঘটে নিম্ন ও মধ্য-আয়ের দেশগুলোতে।
একটি কার্যকর পণ্য তৈরি করার জন্য সিদ্ধার্থ নিয়মিত বিভিন্ন হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। সেখানে তিনি হাসপাতালের কর্মী, রোগী এবং অন্যান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে হৃদ্রোগ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এই প্রক্রিয়ায় তিনি তার অ্যাপের জন্য প্রয়োজনীয় ডেটা সংগ্রহ করেন।
এর পরের ধাপে তিনি একটি শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক মডেল তৈরি করেন, যেটিকে তিনি একাধিকবার প্রশিক্ষণ দেন এবং পুনরায় প্রশিক্ষণ দেন যতক্ষণ না তিনি ফলাফলে সন্তুষ্ট হন।
সিদ্ধার্থ বলেন, "এই পুরো যাত্রায় আমি বলতে পারি, প্রতিটি সাক্ষাৎকারই সহায়ক ছিল।"

বর্তমানে অ্যাপটি শুধু বিভিন্ন ক্লিনিকে অনুমোদিত ব্যক্তিরাই ব্যবহার করতে পারেন। একে অন্যান্য চিকিৎসা উপাদানের মতোই বলে ব্যাখ্যা করেন সিদ্ধার্থ। তিনি বলেন, "রোগ শনাক্তে এটি ব্যবহারের আগে আপনাকে অবশ্যই এর ব্যবহার শেখা প্রয়োজন।"
অ্যাপটি ব্যবহারের জন্য ব্যবহারকারীকে শুধু তাদের হৃৎপিণ্ডের কাছে একটি স্মার্টফোন ধরে রাখতে হয়। তখন অ্যাপটি হৃদস্পন্দনের শব্দ রেকর্ড করে। এতে উন্নত নয়েজ-ক্যান্সেলেশন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে, যা আশপাশের শব্দ ফিলটার করে দেয়—ফলে এটি শব্দযুক্ত পরিবেশেও সঠিক রিডিং দিতে পারে।
রেকর্ড করা শব্দ বিভিন্ন অ্যাম্পলিফিকেশন অ্যালগরিদমের মধ্য দিয়ে যায় এবং এরপর সেগুলো ক্লাউডে হোস্ট করা একটি মেশিন-লার্নিং মডেলের কাছে পাঠানো হয়। এই মডেল ব্যবহারকারীর হার্ট হেলথ বা হৃদ্স্বাস্থ্যের সার্বিক মূল্যায়ন প্রদান করে।
একটি সহজবোধ্য ইন্টারফেসে ফলাফল প্রদর্শিত হয়, যেখানে ব্যাখ্যা থাকে কোনটি স্বাভাবিক এবং কোনটির চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। অ্যাপটি অ্যারিথমিয়া ও অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন, হার্ট ফেইলিয়রের প্রাথমিক লক্ষণ, করোনারি আর্টারি ডিজিজ এবং হার্ট ভালভের সমস্যাগুলো শনাক্ত করতে পারে।
সিদ্ধার্থ বলেন, "এটি একটি প্রাথমিক স্ক্রিনিং টুল।"
এ কিশোর যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত দুই দেশেই বিভিন্ন পর্যায়ে অ্যাপটি ব্যবহার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৫ হাজার ও ভারতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার রোগীর ওপর এটি পরীক্ষা করা হয়েছে।
সিদ্ধার্থ বলেন, "ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুধু রোগ শনাক্তের জন্য নয়, বরং টুলটির কার্যকারিতা পরিমাপের মাপকাঠি হিসেবেও পরিচালিত হয়েছে।"
ভারতের গুন্টুরে অবস্থিত গভর্নমেন্ট জেনারেল হাসপাতালে এক প্রাথমিক পরীক্ষায় অ্যাপটি প্রায় দশজন রোগীর হৃদ্রোগ শনাক্ত ও নির্ণয় করে। পরে এই রোগগুলো ইসিজি ও ২ডি ইকোকার্ডিওগ্রামের মাধ্যমে ক্লিনিক্যালি নিশ্চিত করা হয়।
অ্যাপটি হৃদ্যন্ত্রের ত্রুটি শনাক্তে উচ্চ সাফল্যের হার দেখিয়েছে বলে জানা গেছে। সিদ্ধার্থ বলেন, "নিশ্চয়ই পরীক্ষাগুলোর ফলাফলে কিছু বৈচিত্র্য থাকে, তবে আমরা ৯৬ শতাংশের বেশি নির্ভুল ফলাফল পেয়েছি।"
বর্তমানে সিদ্ধার্থ বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন পেতে কাজ করছেন। একবার এই অনুমোদন পেয়ে গেলে, সার্কাডিয়ান এআই-কে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং অন্যান্য দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও ক্লিনিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহারের জন্য চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে বৃহৎ পরিসরে স্ক্রিনিং চালানো যায়।
নিউ অরলিন্সের লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রোফিজিওলজিস্ট জামিল আহমেদ বলেন, "সার্কাডিয়ান এআই-এর মতো হৃদ্যন্ত্র পর্যবেক্ষণকারী ডিভাইস ও অ্যাপগুলোর মাধ্যমে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির অভাবনীয় সম্ভাবনা রয়েছে।"
তিনি বলেন, "সিদ্ধার্থের অ্যাপটি এমন জনগোষ্ঠীগুলোর কাছে পৌঁছাতে পারে, যাদের কাছে পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা পৌঁছায় না। মাত্র ১৪ বছর বয়সী একজন শিক্ষার্থী এমন একটি অ্যাপ তৈরি করেছে, যা লাখ লাখ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে—এটা সত্যিই অভাবনীয়।"
তিনি আরও বলেন, "কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতি এবং প্রযুক্তির সহজলভ্যতার ফলে আমরা ভবিষ্যতে আরও এমন ডিভাইস ও প্রোগ্রাম দেখতে পাব।"
আহমেদ বলেন, এই ডিভাইসটি হৃদ্স্পন্দনের সম্ভাব্য নিয়ম বহির্ভূত বিষয়গুলো শনাক্ত করে হৃদ্রোগ নির্ণয় করার চেষ্টা করছে। যারা সাধারণত চিকিৎসাসেবায় পৌঁছাতে পারেন না, তাদের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে সম্ভাব্য রোগ শনাক্ত করা দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা এবং মৃত্যুর হার কমাতে সহায়ক হতে পারে।
তবে, আহমেদ অ্যাপটির কিছু সীমাবদ্ধতার কথাও উল্লেখ করেন। অ্যাপটির একটি সম্ভাব্য সমস্যা হতে পারে ব্যবহৃত ডিভাইসের মাইক্রোফোনের 'গুণমান ও নির্ভুলতা'। ঐতিহ্যগতভাবে, চিকিৎসকরা স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করে হৃদরোগের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট শব্দ এবং তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোনেন রোগ নির্ণয়ের জন্য। আহমেদ বলেন, "কখনও কখনও, এমনকি বিশেষজ্ঞের পক্ষেও এই প্যাটার্নগুলো ভুল বা অস্পষ্ট হতে পারে, তাই আমরা নির্ভুলতার জন্য ইকোকার্ডিওগ্রাফি বা হৃদয়ের ইমেজিং-এর উপর নির্ভর করি।"
সিদ্ধার্থ বিষয়টি স্পষ্ট করে জানান, অ্যাপটি শুধু হৃদরোগের অস্বাভাবিকতা শনাক্ত করে এবং এটি কোন ধরনের হৃদ্রোগ হয়েছে তা নির্ণয় করার জন্য নয়। তিনি বলেন, 'আমরা বলছি না যে আমরা [ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম] বা ২ডি ইকো-এর মতো যন্ত্রপাতি বদলে দেব।' এটি কেবল একটি প্রাথমিক স্ক্রিনিং টুল, যা ব্যবহারকারীর হৃদপিণ্ডে কোনো সমস্যা আছে কিনা তা শনাক্ত করবে।
এই তরুণ উদ্ভাবক ইতোমধ্যেই ডিভাইসটির উন্নয়নের কাজ শুরু করেছেন। তিনি বর্তমানে ফুসফুসের শব্দ বিশ্লেষণ করার জন্য কাজ করছেন, যাতে পালমোনারি এমবোলিজম, জলধারণ এবং নিউমোনিয়ার মতো রোগ শনাক্ত করা যায়।
সিদ্ধার্থ বলেন, "আমি এখানেই থামতে চাই না।"