যেভাবে হিমবাহ ধসে গিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল সুইজারল্যান্ডের একটি গ্রাম

সুইজারল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত শতবর্ষী ব্লাটেন গ্রাম এক ভয়াবহ হিমবাহ ধসে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীদের সতর্কতা অনুযায়ী বাসিন্দাদের আগেই সরিয়ে নেওয়া হলেও, ভয়াবহ ধসের আঘাতে মাটির নিচে চাপা পড়ে গেছে পুরো গ্রাম, যার মধ্যে রয়েছে গির্জা, হোটেল ও শতাধিক বাড়িঘর। খবর বিবিসি'র।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে গ্রামটির ওপরের নেস্টহর্ন পর্বতের গতিবিধি নজরদারিতে রাখছিলেন বিজ্ঞানীরা। দেখা যায়, পর্বতের কিছু অংশ ভেঙে নিচের বার্চ হিমবাহে পড়ছে, ফলে বরফের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
ইতোমধ্যে পাথর ও বরফের ছোট ছোট ধস নামতে শুরু করে। নিরাপত্তার স্বার্থে প্রায় ৩০০ বাসিন্দা এবং তাদের গবাদিপশু সরিয়ে নেওয়া হয়। আশা ছিল, দুর্বল পাথরের স্তর ধীরে ধীরে ভেঙে পড়বে, আর কিছুদিন পর সবাই ঘরে ফিরতে পারবে।
কিন্তু বুধবার বিকেলে সেই আশা শেষ হয়ে যায়।

প্রায় ৯০ লাখ ঘনমিটার পাথর ও বরফ গড়িয়ে পড়ে উপত্যকার ওপর।
ধসের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে সুইজারল্যান্ডের প্রতিটি ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণকেন্দ্রে কম্পন ধরা পড়ে।
সেসময় পাশ্ববর্তী কিপেল গ্রামের বাসিন্দা বারবারা ও অটো ইয়াগি তাদের বাড়িতে চিমনি মেরামতের কাজ করাচ্ছিলেন। হঠাৎ এক প্রচণ্ড শব্দ হয়, সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চলে যায়। বারবারা বলেন, 'একটা প্রচণ্ড শব্দ হলো, আর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চলে গেল।'
প্রথমে তাঁরা ভাবেন, মেরামতের কারণে কিছু হয়েছে। কিন্তু শব্দ আরও তীব্র হয়ে গর্জনে রূপ নেয়। ঠিক তখন মেরামতকারী দৌড়ে ওপরে এসে চিৎকার করে বলেন, 'পাহাড় আসছে।'
ব্লাটেন থেকে কিপেল গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৪ কিলোমিটার। মুহূর্তেই পুরো উপত্যকা ধুলায় ঢেকে যায়। সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় ব্লাটেন—তার ঘরবাড়ি, গির্জা, পরিচিত হোটেল এডেলভাইস—সবকিছু গুঁড়িয়ে যায়।
ভূতাত্ত্বিকদের আগাম সতর্কতার কারণে আগেভাগেই গ্রাম খালি করা হয়েছিল। তবে এত ভয়াবহ ধ্বংস—তা বিশেষজ্ঞদের কল্পনাকেও ছাপিয়ে গেছে।

ল্যাচেনটাল উপত্যকার কোলে অবস্থিত এই ছোট্ট গ্রামের দুইটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা ছিল—গ্রামের গির্জা ও হোটেল এডেলভাইস। বিপর্যয়ে উভয় স্থাপনাই টনকে টন পাথর, বরফ ও কাদার নিচে চাপা পড়ে। গির্জাটি সম্পূর্ণ মাটিচাপা পড়ে, আর হোটেলটির শুধু ছাদটুকু দৃশ্যমান।
'আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম,' বলেন জুরিখের ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির খ্যাতনামা হিমবাহ বিশেষজ্ঞ ম্যাথিয়াস হুস। 'এটা ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতি যা ঘটতে পারত।'
ব্লাটেনের অবস্থা সম্পর্কে আগে থেকেই জানতেন হুস। তার দল বছরজুড়ে সুইজারল্যান্ডের হিমবাহ পর্যবেক্ষণ করে। তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে হিমবাহ গলার যে চিত্র উঠে আসে, তা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত এবং দিন দিন তা আরও দ্রুত হচ্ছে।
এখন পুরো ব্লাটেন পাথর ও কাদার নিচে চাপা পড়ে আছে। পরবর্তী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে, কারণ ধ্বংসাবশেষ লনজা নদীর প্রবাহ আটকে দিয়েছে, যা নতুন করে বন্যার ঝুঁকি তৈরি করছে।

এই দুর্যোগ কীভাবে ঘটল, তা বিশ্লেষণ করতেও সময় লাগবে।
তবে হুস মনে করেন, এটি সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় এবং নাটকীয় আলপাইন বিপর্যয় হলেও, এটাই একমাত্র নয়।
'আমরা অনেক ঘটনা দেখছি,' বলেন তিনি। 'গত কয়েক বছরে আলপস অঞ্চলে এ ধরনের বহু ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট যোগ রয়েছে। পারমাফ্রস্ট গলছে—যা পাহাড়গুলোকে স্থিতিশীল রাখে।'
নিকটবর্তী উইলার ও কিপেল গ্রামগুলোও এখন বরফ গলার কারণে বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে।
পারমাফ্রস্টকে বলা হয় 'পর্বতের আঠা'। এটি গলতে শুরু করলে পাহাড় খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়ে। একইসঙ্গে হিমবাহের আকার ছোট হতে থাকে, আর বরফের ঘন চাদর সরে গেলে উন্মোচিত হয় এমন পৃষ্ঠ—যেগুলো অস্থির হয়ে ওঠে।

এমন বিপদ নতুন নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হিমবাহ প্রসারিত ও সংকুচিত হয়েছে।
ঋতুভিত্তিক তুষারধস ও ভূমিধস সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু পথে নামে। আলপস অঞ্চলের বাসিন্দারা এ বিষয়ে অভ্যস্ত। সুইজারল্যান্ডে ঝুঁকির মানচিত্র বহু আগেই তৈরি করা হয়েছে। ব্লাটেনের মতো গ্রামগুলো গড়ে ওঠে এই বিশ্বাসে—এগুলো তুলনামূলকভাবে নিরাপদ।
কিন্তু গত দুই দশকে পরিস্থিতিতে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। হিমবাহ ও পারমাফ্রস্ট এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় দ্রুত গলছে।
বর্তমানে বরফের পরিমাণ এক শতাব্দী আগের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। কিছু হিমবাহ পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেছে। অনেকে প্রতীকী অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মাধ্যমে হিমবাহকে 'শেষ বিদায়'ও জানিয়েছে।
প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে নির্ধারিত ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা বৃদ্ধির সীমা অতিক্রম করা হলে, চলতি শতকের শেষে সুইজারল্যান্ডের বেশিরভাগ হিমবাহ বিলীন হয়ে যাবে—এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় উদ্বেগ ছিল, মিঠাপানির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। ইউরোপের নদীগুলোর উৎস এই হিমবাহগুলো শীতে তুষার জমা রেখে গ্রীষ্মে ধীরে ধীরে গলিয়ে নদী ও কৃষিজমিতে পানি সরবরাহ করে।
কিন্তু ব্লাটেন এখন এক নতুন আশঙ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে। নজরদারি ও ঝুঁকির মানচিত্র থাকা সত্ত্বেও, দ্রুত বরফ গলার কারণে বিপদের আগাম সতর্কতা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
ব্লাটেনের বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল সাবধানতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে। কারণ তখনও ধসে পড়ছিল বরফ ও পাথর। কর্তৃপক্ষ চায়নি কেউ আহত হোক।
৬৪ বছর বয়সী এক ব্যক্তি নিখোঁজ হলেও এই পূর্বসতর্কতামূলক পদক্ষেপে শত শত মানুষের প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। তবে গ্রামবাসীরা হারিয়েছেন সবকিছু। বাড়িঘর গুঁড়িয়ে গেছে; টনকে টন ধ্বংসাবশেষের নিচে চাপা পড়েছে তাদের জীবনের স্মৃতিচিহ্ন।
হুস আশঙ্কা করছেন, ব্লাটেনের ঘটনা ভবিষ্যতের জন্য একটি অশনিসংকেত।
তিনি বলেন, 'এটা সত্যিই উঁচু পর্বতমালায় বসবাস নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ভবিষ্যতে আরও কিছু গ্রাম ধ্বংস হয়ে যেতে পারে—সেই সম্ভাবনাও আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না।'

ব্লাটেনের ধসের পরদিন পাশের উইলার গ্রামে অ্যাসেনশন ডে উপলক্ষ্যে একটি গির্জায় প্রার্থনায় মিলিত হন স্থানীয়রা।
গৃহহারা মানুষের জন্য, এবং গোটা সম্প্রদায়ের কল্যাণে প্রার্থনা করা হয়। এক নারী বলেন, 'আমরা সবাই এখানে একে অপরকে চিনি। আমাদের উপত্যকাগুলো ছোট—তাতেই আমরা আরও কাছাকাছি হয়ে উঠি। এখানে সত্যিকারের সহমর্মিতা আছে।'
আরেক নারী বলেন, 'এটা ভয়াবহ। ওরা সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে। আমরা কিছুই করতে পারি না।'
এক বৃদ্ধ যোগ করেন, 'কাঁদতে পারি, কিন্তু সারাজীবন তো কাঁদতে পারি না। আমাদের ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখতে হবে—তিনি আমাদের সাহায্য করবেন, যেন জীবন কোনোভাবে এগিয়ে যায়।'
আর হিমবাহ বিশেষজ্ঞ ম্যাথিয়াস হুসের ভাষায়, 'এটা সত্যিই এক ঘটনা, যা সুইজারল্যান্ড এবং আমাদের পর্বতমালার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হয়ে থাকবে।'