ইসরায়েল-সমর্থিত বিতর্কিত গাজা সহায়তা সংস্থার প্রধানের পদত্যাগ

ফিলিস্তিনের গাজায় ত্রাণ বিতরণের জন্য গঠিত ইসরায়েল সমর্থিত সংস্থার প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন জেক উড। তিনি বলছেন, সংস্থাটি 'মানবিক নীতিমালা' মেনে কাজ করতে পারবে না। খবর বিবিসির।
গত রোববার গভীর রাতে জেক উড গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি বলেন, সংস্থাটি 'মানবতা, নিরপেক্ষতা, পক্ষপাতহীনতা ও স্বাধীনতা'র নীতিমালা পূরণ করতে পারবে না।
ইসরায়েল নির্ধারিত বিতরণকেন্দ্রের মাধ্যমে বেসরকারি ঠিকাদারদের ত্রাণ পৌঁছানোর এ পরিকল্পনাকে যুক্তরাষ্ট্রও সমর্থন দিয়েছে। তবে জাতিসংঘ এ উদ্যোগের সমালোচনা করেছে এবং এতে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।
সোমবার রাতে জিএইচএফ জানায়, তাদের প্রথম ত্রাণ চালান গাজায় পৌঁছেছে এবং জনগণের মধ্যে বিতরণ চলছে।
জিএইচএফ-এর পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনিদের ২০ কেজি (৪৪ পাউন্ড) ওজনের খাদ্য ও মৌলিক স্বাস্থ্যসামগ্রীসহ ত্রাণের বাক্স সংগ্রহ করতে হবে গাজার দক্ষিণাঞ্চলের চারটি বিতরণকেন্দ্র থেকে।
তবে দুর্বল, আহত বা অসুস্থরা কীভাবে এ ত্রাণ সংগ্রহ করবে, তা স্পষ্ট নয়।
ইসরায়েল বলছে, হামাস যাতে ত্রাণ চুরি করতে না পারে, সেজন্যই এই পরিকল্পনা জরুরি। তবে হামাস এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
জাতিসংঘের ত্রাণ প্রধান টম ফ্লেচার এ পরিকল্পনার সমালোচনা করে বলেছেন, এটি আরও বাস্তুচ্যুতি ঘটাবে, গাজার একটি নির্দিষ্ট অংশেই ত্রাণ সীমিত রাখবে এবং 'ক্ষুধাকে দর কষাকষির হাতিয়ার' বানাবে।
পদত্যাগের বিবৃতিতে সাবেক মার্কিন মেরিন সদস্য জেক উড বলেন, 'দুই মাস আগে আমাকে জিএইচএফ-এর কার্যক্রম পরিচালনার অনুরোধ জানানো হয়, কারণ মানবিক সহায়তা পরিচালনায় আমার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
তিনি বলেন, 'বিশ্বের অনেক মানুষের মতো আমিও গাজার ক্ষুধা সংকটে আতঙ্কিত ও মর্মাহত হয়েছিলাম। একজন মানবিক সহায়তা কর্মী হিসেবে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে যা কিছু সম্ভব, তা করার দায়বদ্ধতা অনুভব করেছিলাম।'

তিনি আরও বলেন, 'আমি আমাদের কার্যক্রম নিয়ে গর্বিত। এর মধ্যে ছিল একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা তৈরি, যা ক্ষুধার্ত মানুষকে খাদ্য সরবরাহ করতে পারে, ত্রাণ অপসারণ বা চুরি নিয়ে নিরাপত্তা উদ্বেগ মোকাবিলা করতে পারে এবং গাজায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা এনজিওগুলোর কার্যক্রমের পরিপূরক হতে পারে।'
জিএইচএফ আরও জানিয়েছে, 'আমাদের ট্রাকগুলো ত্রাণে পূর্ণ এবং প্রস্তুত।'
একজন ইসরায়েলি কর্মকর্তা বলেন, 'এই নতুন উদ্যোগের লক্ষ্য হলো গাজার জনগণকে হামাসের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত করা।'
ইসরায়েলি গণমাধ্যম জানিয়েছে, সোমবার সকালে জিএইচএফ গাজার প্রথম চারটি বিতরণকেন্দ্রের একটি চালু করবে।
গত সপ্তাহে ইসরায়েল গাজায় খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ ও অন্যান্য সরবরাহ ঢোকার ওপর ১১ সপ্তাহ ধরে চলা অবরোধ কিছুটা শিথিল করে। এরপর কিছু ত্রাণবাহী ট্রাক সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেছে। তবে জাতিসংঘ বলেছে, এই সহায়তা 'চাহিদার তুলনায় সমুদ্রের এক ফোঁটা পানির মতো'।
সংস্থাটি জানিয়েছে, ইসরায়েলের অবরোধের সময় অপুষ্টিতে ৫৭ শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) গত সপ্তাহে সতর্ক করে জানায়, গাজার পুরো জনগোষ্ঠীই 'অনাহারের দ্বারপ্রান্তে' দাঁড়িয়ে আছে।
নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের মহাসচিব জান এগেলান্ড বিবিসির টুডে প্রোগ্রামে বলেন, জিএইচএফ হলো 'সামরিকীকৃত, বেসরকারিকৃত ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত'—এটি 'নিরপেক্ষতার নীতিমালার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।'।
তিনি বলেন, 'এই সংস্থার নেতৃত্বে যারা আছেন, তারা সবাই সাবেক সিআইএ এবং সাবেক সামরিক কর্মকর্তা… আমাদের সেই ব্যবস্থায় ফিরে যেতে হবে, যেটি কাজ করছিল।'
জিএইচএফ ইতোমধ্যেই এর অর্থায়ন, প্রতিষ্ঠার পটভূমি এবং সমর্থনকারীদের নিয়ে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছে।
সোমবার সন্ধ্যায় জিএইচএফ ঘোষণা দেয়, ইউএসএইড-এর সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জন অ্যাক্রি অন্তর্বর্তী নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নিচ্ছেন।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, জিএইচএফ সম্ভবত ইসরায়েলে কিছু সরকারি কর্মকর্তা, সেনা কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে পরিকল্পিত হয়েছিল।
এ মাসের শুরুতে জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) মুখপাত্র জোনাথন ক্রিক প্রশ্ন তোলেন, 'একজন চার সন্তানের মা, যিনি তার স্বামীকে হারিয়েছেন, কীভাবে ২০ কেজির একটি ত্রাণের বাক্স কয়েক কিলোমিটার দূরের অস্থায়ী তাবুতে বয়ে নিয়ে যাবেন?'
তিনি আরও বলেন, 'বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, অসুস্থ, আহত এবং এতিম শিশুসহ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের জন্য ত্রাণ সহায়তা পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।'
ইসরায়েল সীমান্তে হামাস হামলা চালানোর প্রতিক্রিয়ায় গাজায় সামরিক অভিযান শুরু হয় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর। ওই হামলায় প্রায় এক হাজার ২০০ মানুষ নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যাওয়া হয়।
এরপর থেকে গাজার হামাস-শাসিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৩ হাজার ৯৩৯ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে অন্তত ১৬ হাজার ৫০০ শিশু রয়েছে।