ব্রাজিলের কিংবদন্তি আলোকচিত্রী সেবাস্তিয়াও সালগাদোর চট্টগ্রাম জাহাজ ঘাটার অবিস্মরণীয় ছবি

প্রকৃতি ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ছবি তুলে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পাওয়া ব্রাজিলের কিংবদন্তি আলোকচিত্রী সেবাস্তিয়াও সালগাদো আর নেই। ৮১ বছর বয়সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
শুক্রবার সালগাদোর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে তার এবং তার স্ত্রী লেলিয়া ডেলুইজ ওয়ানিক সালগাদোর প্রতিষ্ঠিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান 'ইন্সটিটিউটো টেরা'।
প্রতিষ্ঠানটির বিবৃতিতে বলা হয়, 'গভীর দুঃখের সঙ্গে আমরা জানাচ্ছি যে, আমাদের প্রতিষ্ঠাতা, অভিভাবক ও চিরন্তন অনুপ্রেরণার উৎস সেবাস্তিয়াও সালগাদো আর নেই।'
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'সেবাস্তিয়াও শুধু সময়ের শ্রেষ্ঠ আলোকচিত্রীই ছিলেন না—স্ত্রী লেলিয়ার সঙ্গে মিলে তিনি ধ্বংসস্তুপের মাঝেও তিনি আশার বীজ বুনতেন। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন, পরিবেশ পুনরুদ্ধার মানবতার প্রতি ভালোবাসার অন্যতম প্রকাশ।'

সালগাদোর শৈশবই ছিল তার কর্মজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা। ১৯৪৪ সালে ব্রাজিলের মিনাস জেরাইস রাজ্যে জন্ম নেওয়া সালগাদো দেখতে পান, বিভিন্ন কাঠামোগত উন্নয়নের কারণে পৃথিবীর অন্যতম জীববৈচিত্র্যে ভরপুর আটলান্টিক বনাঞ্চল ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।
পরবর্তীতে, জীবনের শেষ কয়েক দশকে সালগাদো ও তার স্ত্রী লেলিয়া মিলে এই বনাঞ্চল পুনরুদ্ধার এবং তা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে উদ্যোগী হন।
তবে বিশ্বজুড়ে সালগাদোকে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি দিয়েছে গভীর অনুভূতি, সূক্ষ্ম টেক্সচার এবং বাস্তবতার ছোঁয়ায় পূর্ণ তার স্থিরচিত্রগুলো। ক্যামেরায় বন্দী নিপীড়িত মানুষের জীবন এবং প্রকৃতির শোষণের অসাধারণ সব আলোকচিত্র তাকে আন্তর্জাতিক মহলেও পরিচিত করে তোলে।


'এক্সোডাস' নামে তার সাম্প্রতিক এক আলোকচিত্রে তিনি অভিবাসীদের কঠোর যাত্রা ফুটিয়ে তোলেন—গাদাগাদি নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়া মানুষ থেকে শুরু করে জাইরের শরণার্থী শিবিরে পানি সংগ্রহের জন্য বহু দূর পথ পাড়ি দেয়া মানুষের চিত্র এই প্রকল্পে দেখা যায়।
বিখ্যাত এ আলোকচিত্রীর ক্যামেরায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের ছবিও। ১৯৮৯ সালের দিকে 'ওয়ার্কার্স' প্রকল্পের অংশ হিসেবে তিনি চট্টগ্রামের জাহাজভাঙা শিল্পের চিত্র ধারণ করেন। চট্টগ্রামের জাহাজভাঙা শিল্প শ্রমিকদের কঠিন জীবনসংগ্রাম, শ্রমের ক্লান্তি ও নিপীড়নের চিত্র তিনি তার ক্যামেরায় বন্দি করেন।

অর্থনীতিবিদ হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়ে ১৯৬৯ সালে দেশ ছাড়লেও সালগাদো এরপর পুরোপুরি আলোকচিত্রের জগতে মনোনিবেশ করেন। ১৯৭৩ সালে ফ্রান্সভিত্তিক সংস্থাগুলিতে কাজের পর তিনি 'ম্যাগনাম ফটোস'-এ যোগ দেন। এর মধ্যেই তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে তিনি ব্রাজিলে ফিরে আসেন এবং সের্রা পেলাদা স্বর্ণখনির শ্রমিকদের কষ্টকর জীবনের চিত্র তার ক্যামেরায় বন্দি করেন।
তবে অনেক সময় তার ছবি নিয়ে সমালোচনা হয়েছে 'দারিদ্র্যের সৌন্দর্যায়ন'-এর অভিযোগে। ২০২৪ সালে 'দ্য গার্ডিয়ান'কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ বিষয়ে বলেন, 'গরিব মানুষের জগৎ ধনী মানুষের জগতের চেয়ে কম সুন্দর হবে কেন? এখানকার আলোও সমান, মর্যাদাও সমান।'

সালগাদোর জীবন ও কাজের ওপর ২০১৪ সালে তার ছেলে জুলিয়ানো রিবেইরো সালগাদো এবং জার্মান চলচ্চিত্র নির্মাতা ভিম ভেন্ডার্স নির্মাণ করেছিলেন তথ্যচিত্র দ্য সল্ট অব দ্য আর্থ। জীবনের শেষ দিকে তাঁর আলোচিত প্রকল্প ছিল 'আমাজোনিয়া', যেখানে অ্যামাজনের প্রাকৃতিক পরিবেশকে তুলে ধরা হয়।
সালগাদোর মৃত্যুতে সারা বিশ্বের আলোকচিত্রী মহল থেকে শোক প্রকাশ করা হয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, 'তার তুলির ছোঁয়া আমাদের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি শুধু ক্যামেরার মাধ্যমে নয়, মন থেকে ভালোবেসে ছবি তুলতেন। তাঁর কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বৈচিত্র্যের মধ্যেই রয়েছে সমতা।'
অনুবাদ: আয়েশা হুমায়রা ওয়ারেসা