সন্তান না নেওয়াকে উৎসাহ দেয় এমন সিনেমা ও সিরিজ নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে রুশ সরকার

১৯৩৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আদমশুমারির ফলাফল জোসেফ স্ট্যালিনের প্রচারণার সঙ্গে মেলেনি। এই অভিযোগে তিনি জনগণনা সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
প্রায় ৯০ বছর পর এসেও রাশিয়ায় জন্মহার একেবারে নিম্নমুখী। সরকারি হিসাব বলছে, ২০২৪ সালে জন্ম সংখ্যা কমেছে ৩.৪ শতাংশ আর মৃত্যু বেড়েছে ৩.৩ শতাংশ। জন্ম-মৃত্যুর এই বিরূপ ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে। এ বছর প্রথম তিন মাসে জন্মনিবন্ধন হয়েছে মাত্র ২ লাখ ৯৪ হাজার, যা আগের বছরের তুলনায় ২.৩ শতাংশ কম। ফেব্রুয়ারিতে ৭ শতাংশ আর মার্চে ৪ শতাংশ কম শিশুর জন্ম হয়েছে।
জনসংখ্যাবিদ আলেক্সেই রাখশা বলছেন, রাশিয়ায় জন্মহার এমন পর্যায়ে নেমেছে যা শেষবার ১৮শ বা ১৯শ শতকে দেখা গিয়েছিল।
রাশিয়ার সরকারি পরিসংখ্যান সংস্থা রসট্যাটও তথ্য লুকাতে শুরু করেছে—মার্চের পর থেকে জন্ম, মৃত্যু, বিবাহের নির্দিষ্ট সংখ্যা প্রকাশ বন্ধ করেছে। এমনকি ২০২২ সালের মার্চ থেকে, পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের পরই মৃত্যু পরিসংখ্যানও বন্ধ করা হয়।
সমস্যা মোকাবেলায় সরকার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। পরিবারের জন্য আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছে। গর্ভপাতের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে। এমনকি, সন্তান না নেওয়ার পক্ষে মুখ খুললে নারীদের জরিমানাও করা হচ্ছে।
এবার রাশিয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আরও এক কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। তারা এমন সিনেমা ও সিরিজ নিষিদ্ধ করতে চাইছে যেখানে নারীরা সন্তান নেওয়ার চেয়ে ক্যারিয়ারকে বেশি গুরুত্ব দেয় বা সন্তানবিমুখ দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় 'হাউস অফ কার্ডস', 'সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি', এবং 'গেম অফ থ্রোনস'-এর মতো জনপ্রিয় সিরিজগুলো পড়তে পারে। যদিও কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই তালিকা এখনও চূড়ান্ত নয়। গ্রীষ্মের পর বিস্তারিত জানানো হবে।
সরকারি পরিসংখ্যান সংস্থা রসস্ট্যাট মার্চে প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে ও বিবাহবিচ্ছেদের নির্দিষ্ট সংখ্যা বাদ দিয়েছে। শুধু দেখানো হয়েছে প্রথম তিনমাসে মোট জন্ম সংখ্যা ২ লক্ষ ৯৪ হাজার, যা জনসংখ্যাবিদ রাখশার নিজস্ব হিসাব থেকে (২ লক্ষ ৮৮ হাজার ৮০০) সামান্য বেশি।
রাখশা তার টেলিগ্রাম চ্যানেলে রসট্যাটের তথ্য গোপন নিয়ে মন্তব্য করেন, 'এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন।' তিনি আরও দাবি করেন, ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে মৃত্যুহার আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেড়েছে।
রসট্যাট অবশ্য তথ্য গোপনের কৌশল শুরু করেছে বেশ আগেই। ২০২২ সালের মার্চে, ইউক্রেনে পুতিন ঘোষিত 'বিশেষ সামরিক অভিযান' শুরুর কয়েক সপ্তাহ পরই তারা বয়সভিত্তিক ও অঞ্চলভিত্তিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান প্রকাশ বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০২৪ সালে বন্ধ করে দেয় মৃত্যুর কারণসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ যা যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার হতাহতের পরোক্ষ হিসাব বের করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সর্বশেষ যুদ্ধে নিহত সেনাদের সংখ্যা প্রকাশ করেছিল ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যা ছিল মাত্র ৫ হাজার ৯৩৭। যদিও বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ থেকে বোঝা যায় আসল সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।
তিন বছর পর, ব্রিটিশ সম্প্রচারমাধ্যম বিবিসি ও রুশ সংবাদমাধ্যম মিডিয়াজোনা, প্রকাশ্যে পাওয়া তথ্য ও সংবাদ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে অন্তত ১ লাখ ৮ হাজার ৬০৮ জন নিহত রুশ সেনার পরিচয় শনাক্ত করে।
এদিকে, রুশ উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্না সিভিলেভার এক 'ভুল করে ফাঁস হওয়া' তথ্যে জানা গেছে, এখনো প্রায় ৪৮ হাজার রুশ নাগরিক যুদ্ধক্ষেত্রে নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজ করছেন।
রসট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে রাশিয়ার জনসংখ্যা প্রায় ৬ লাখ কমেছে, যেখানে আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৯৫ হাজার ২০০। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে জনসংখ্যা হ্রাস প্রায় ২০ শতাংশ। এতে জন্ম-মৃত্যুর ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে—২০২৪ সালে জন্ম কমেছে ৩.৪ শতাংশ আর মৃত্যু বেড়েছে ৩.৩ শতাংশ।
২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জনসংখ্যা সংকট মোকাবেলায় একটি জাতীয় কর্মসূচি শুরু করেন। পরে ২০১৮ সালে তিনি ২০২৪ সালের মধ্যে এই প্রবণতা বদলে দেওয়ার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনায় সই করেন। কিন্তু বাস্তবে ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত, করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন আগ্রাসনের সময়সহ, মৃত্যু সংখ্যা জন্মের তুলনায় প্রায় ৩৪ লাখ বেশি ছিল।
জন্মহার বাড়াতে রাশিয়ার সরকার এখন দুই কৌশল নিচ্ছে—একদিকে আর্থিক প্রণোদনা, অন্যদিকে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ।
সন্তান থাকা পরিবারগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা, দীর্ঘ মাতৃত্বকালীন ছুটি ইত্যাদি দেওয়া হচ্ছে। ক্রেমলিনকে খুশি করতে গিয়ে বিভিন্ন অঞ্চল যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ২০২৫ সাল থেকে অনেক অঞ্চল গর্ভবতী শিক্ষার্থীদের নগদ প্রণোদনা দিতে শুরু করেছে যা ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ রুবল (প্রায় ২৫০ থেকে ১,৮৭০ মার্কিন ডলার) পর্যন্ত।
বিষয়টা এতটাই চরমে পৌঁছেছে যে কিশোর বয়সী স্কুলছাত্রীরা গর্ভবতী হলেও তাদের টাকা দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে আইনপ্রণেতা সেনিয়া গোরিয়াচেভা বলেন, 'যখন এক শিশু আরেক শিশুকে জন্ম দেয়, সেটা কোনো বীরত্ব নয় বরং সেটা এক ধরনের ট্র্যাজেডি।'
অন্যদিকে একের পর এক কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে গর্ভপাতের ওপর। কোথাও কোথাও গর্ভ-নিরোধক বড়ি পাওয়া যাচ্ছে না, আবার কিছু অঞ্চলে বেসরকারি ক্লিনিকে গর্ভপাত একেবারে নিষিদ্ধ।
জন্মহার কমিয়ে দিতে পারে এমন যে কাউকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করছে সরকার। আর এই তালিকায় রয়েছে এলজিবিটিকিউ+ জনগোষ্ঠী ও নারীবাদী সংগঠনগুলো। এর সর্বশেষ উদাহরণ গত সপ্তাহে দেশের অন্যতম বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান একসমোর অন্তত ১০ জন কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযোগ, তাদের প্রকাশিত কিছু বইতে 'সমকামীতা প্রচারণা' করা হয়েছে।
এর পাশাপাশি ২০২৪ সালে একটি আইন পাস হয়, যার আওতায় সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে কিছু বললে বা লিখলে সর্বোচ্চ ৫৬ হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা করা হতে পারে।
এখন আরও একধাপ এগিয়ে রাশিয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একটি খসড়া আদেশ তৈরি করেছে, যেখানে বলা হয়—'যেসব চলচ্চিত্র সন্তানবিমুখ সংস্কৃতি প্রচার করে, সেগুলোকে প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া হবে না। অনলাইনে প্রকাশ পেলেও তা বন্ধ করে দেওয়া হবে।'
রাশিয়ার সংসদের সরকারি বুলেটিন পার্লামেন্টাসকায়া গ্যাজেটায়ও এই সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞার আভাস দেওয়া হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, 'হাউস অফ কার্ডস'-এ ক্লেয়ার সবসময় ক্যারিয়ারকে অগ্রাধিকার দেন, 'সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি'-তে সামান্থার সন্তান না নেওয়ার প্রবণতা স্পষ্ট, আর 'গেম অফ থ্রোনস'-এ ব্রিয়েন তার নাইট হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করে।
অনুবাদ: নাফিসা ইসলাম মেঘা