উলন দাস পাড়া: ঢাকার শেষ আদি জেলেপল্লী?

কেবল এই দাসপাড়াটুকুই পৈতৃক সম্পত্তি। বংশ পরম্পরায় আমরা আছি। বাকি সব দলিলের জমি, বিক্রি হয়ে গেছে। আমার এক জ্যাঠাই বিক্রি করে দিয়েছেন এক মুসলিম পরিবারের কাছে।
সঞ্জিতচন্দ্র দাস এ কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন একেবারে নিশ্চিত হয়ে। ঢাকার রামপুরার মধ্যে উলন দাসপাড়াটিই যে সবচেয়ে আদি পাড়া, এ নিয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই।
প্রধান সড়কের ফুটপাতের ওপর দিয়েই চলে গেছে একটি সরু গলি। সেই গলির ওপরে সাইনবোর্ড টাঙ্গানো। সেখানে লেখা- 'উলন দাসপাড়া'।
উলন একটি মৌজার নাম। এখানে দুটি উলন আছে। দাসপাড়াটিই মূলত প্রধান উলন রোড, যা মোল্লা টাওয়ার থেকে রামপুরা বাজার পর্যন্ত।
ছয়-সাত পুরুষ ধরে তার বাপ-দাদারা এখানে
সঞ্জিতের জন্ম এই দাসপাড়াতেই, ১৯৮৩ সালে। লেখাপড়া করেছেন পাশের একরামুন্নেসা বিদ্যালয়ে, নবম শ্রেণি পর্যন্ত। বাবা মারা যাওয়ায় আর পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। নিজে লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি, সেই আফসোস থেকে ছেলেকে পড়াচ্ছেন। তার ছেলে এখন স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন।
সঞ্জিত একটি মুদি দোকানের মালিক। দোকানের পেছনের দেয়ালের সাথেই লাগোয়া তার থাকার ঘর। রান্নঘরসহ মোট পাঁচটা ঘর। এক ঘরে মা আর বোন থাকেন। বাকি তিনটি ঘরে তিনি ও তার ভাইয়েরা থাকেন। বাড়িতে সদস্য বলতে সঞ্জিতের বৃদ্ধা মা, স্ত্রী, এক ছেলে, ছোট অবিবাহিত বোন, দুই ভাই আর তাদের স্ত্রী-সন্তান। আরেকটি বোন বিয়ে করে নারায়ণগঞ্জে থাকছেন।
আগে পরিবার ছোট ছিল। ঘরও ছিল দুটো, সঞ্জিতের দাদা সুনীল চন্দ্র দাসেরা ছিলেন দুই ভাই। সবাই এখানেই থাকতেন আগে এক ছাদের নিচে। শুধু ঘর দুটো ছিল। এখন পরিবার বড় হচ্ছে, সঞ্জিতদের ছেলেরাই বড় হচ্ছে। তাই ঘরও আলাদা হচ্ছে।
টিনের দোচালা ঘর থেকে কোনোমতে দালান উঠেছে। এটুকু সঞ্জিত নিজে দেখেছেন। আর তারও আগের কথা সঞ্জিত জানেন না। শুধু এটুক জানেন, ছয়-সাত পুরুষ ধরে তার বাপ-দাদারা এখানে। তার পূর্বপুরুষেরা সবাই মাছের ব্যবসাই করতেন।
সঞ্জিতের দোকানের খদ্দের এ পাড়ার মানুষই। মেয়েকে নিয়ে ডিংডং চিপ্স কিনতে এসেছিলেন সেদিন পাবনচন্দ্র দাস। পেশায় তিনি ফ্রিল্যান্সার সিনেমাটোগ্রাফার। পড়ালেখা বলতে বিএ পাশ। সঞ্জিতের মতো তিনিও এ পাড়ায় কয়েক পুরুষ ধরে আছেন। তার বাবাও মাছের ব্যবসা করতেন।
ঢাকার ভেতর আদি জেলেপল্লী?
এখানে এখন প্রায় ৪-৫ বিঘা জমির ওপর প্রায় ৫০-৫৫টা ঘর আছে। মানুষ হবে হয়তো সাড়ে ৩০০। এর মধ্যে পরিবার বড় হয়ে আলাদা ঘর তুলেছে, আবার যুদ্ধের সময় অনেকে পালিয়ে গেছে, ২০০৮ বা ২০০৯ সালের দিকে হাতিরঝিলে রাস্তা ভাঙার কারণে অনেক ঘর উচ্ছেদ হয়েছে। মেইন রোড, টিভি সেন্টারের জন্য কিছু জমি সরকারের আওতায় চলে গেছে। অনেকে জমি বিক্রি করে চলে গেছেন, প্রায় ১০ বিঘার বেশি জমি চলেই গেছে।
ফলে জায়গাটিও ছোট হয়ে গেছে এখন। আগে ছিল কেবলই হিন্দু দাস সম্প্রদায়। এখন মুসলিমরাও ভাড়া থাকছেন। তবে আদি যারা আছেন তাদের সবাই দাস।
পাবন বললেন, 'কবে থেকে এটি দাসপাড়া হয়ে উঠল, তা নিজেরাও জানি না। ২০০ কিংবা ১৫০ বছর আগের কথাটুকুই জানি কেবল। আগে আমাদের বাড়ি ছিল তেজগাঁও কারখানার ওদিকে। এই এলাকার প্রত্যেক বাসিন্দারই বাড়ি ছিল কুনিপাড়া এখনকার আড়ংয়ের পাশে। যখন ওখানে প্রকল্পের কাজ শুরু হলো, তখন সবাই এখানে চলে এল। তবে আরেকটি উলন আছে এখানে। এই দুই উলনের মধ্যে কনফিউশন তৈরি হওয়ার পর উলন এলাকাটি ভাগ হয়ে গেল। এটি উলন দাস পাড়া হয়ে গেল।'

তখন রামপুরার আশেপাশে বনশ্রী, আফতাবনগর, টিভি সেন্টার, বন্ধুনিবাস পুরো জায়গাজুড়ে আগে ধানক্ষেত ছিল। পাবনদেরই ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির মধ্যে ছিল চার বিঘা জমি। বনশ্রীতে ছিল আরও প্রায় চার বিঘা। টিভি সেন্টারের পাশে ছিল দুই বিঘা।
'কিছু নিজেরা খেয়ে শেষ করেছি, আর কিছু জাল দলিল-টলিল করে লোকে নিয়ে নিছে', বলেন পাবন।
তবে একসময় এ পাড়াটি পরিচিত ছিল জেলেপল্লী হিসেবে। একসময় ঢাকার রামপুরা থেকে শুরু করে মেরাদিয়া, ডেমরা এলাকায় প্রচুর মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল মাছ ধরা। তখন এখানকার মানুষ পাশের নড়াই নদীতে মাছ ধরতে যেত। বর্ষার দিনে নদীতে মাছ ধরা আর অন্যান্য মৌসুমে ক্ষেতে খামারে চাষ, এই ছিল অঞ্চলের মানুষদের প্রধান জীবিকার উৎস। এখন আর কেউ জেলে পেশায় নেই। থাকলেও দু-চারজন হয়তো বা আছে। তারা চলে গেলে এই পেশায় আর কেউ থাকবে না। আরও ৩০ বছর আগে থেকেই এই পেশা নেই।
পাকিস্তান আমলেও এই নড়াই নদীতে মাছ ধরতেন এখানকার বাসিন্দারা। আশির দশকের শেষের দিকগুলোতে পাবন নিজেও দেখেছেন নৌকায় করে মাছ ধরতে আসতেন অনেকে। ধীরে ধীরে মানুষে ভরে গেছে, পানি নষ্ট হয়ে গেছে, মাছ মরে গেছে। নদী মরে যাওয়ার সাথে সাথে বদলে গেছে জীবিকার ধরনও। নড়াই নদী হয়ে গেল হাতিরঝিল। আর এখানকার বাসিন্দারা মাছ ধরার পরিবর্তে জীবিকা ঘুরিয়ে নিলেন মাছের ব্যবসায়। কারওয়ান বাজার, সোয়ারীঘাট থেকে মাছ ধরে এনে বিক্রি শুরু করলেন আশপাশের বাজারে।
৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজলরানী এখানেই
একদিন এই মাছ বিক্রির জন্য বের হয়েই রাস্তার ধারে পড়ে প্রাণ হারান চিত্তরঞ্জন দাস। সকালে ভাত খেয়ে তৈরি হয়ে বের হয়ে যান কারওয়ান বাজারের উদ্দেশে। বাজারের ভেতরেই মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যান হুট করে। এরপর মৃত্যু।
দুই হাতে ধরে রাখা লেমিনেটিং করা একটি ছবির (চিত্তরঞ্জন দাস) দিকে তাকিয়ে স্ত্রী কাজলরানী দাস কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন। এরপর হাত থেকে ছবিটি নামিয়ে আবার তরকারি কোটাকুটিতে লেগে গেলেন। তিনিই তরকারি সব কেটেকুটে দেন। বউয়েরা এরপর রান্না চড়ান। মহাদেবের প্রয়াণ বলে সোমবার নিরামিষ খান কাজলরানীরা। তাই আজ উনুনে উঠবে করল্লা ভাজি, বুটের ডাল, মিষ্টিকুমড়ার ঝোল। ছেলে-বুড়ো সবার জন্যই এই ক'টি পদ বরাদ্দ আজ।
কাজলরানীর পাঁচ ছেলে, তিন মেয়ে। বিধবা হয়েছেন আজ ২০ বছর। বড় ছেলের বয়সই ৬০ বছর। নিজের বিয়ে যে কোন বয়সে হয়েছিল নিজেও জানেন না তিনি। পাড়ার অন্যদের মতো, তার স্বামী-শ্বশুরেরও মাছের আড়ত ছিল। ছেলেরা এখন ব্যবসা করেন। একজন মুদি দোকান, আরেকজনে সোফাসেট, পর্দার কাজ করেন। বাকিরাও বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত। যার যার ঘর আলাদা।
ছুটির দিনে সকালে উঠে তারা সবাই একসাথেই খেতে বসেন। অন্যান্য দিন যার যার সুবিধামতো খেয়ে কাজে বেরিয়ে পড়েন। সকালের পাতে থাকে রুটি, ভাত, সবজি। নাতিও দুজন চাকরি করে, তারাও নিয়ে যায় খাবার। ছোটো ছেলের বড় নাতি স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। সবচেয়ে ছোটজন পড়ালেখা করছেন পঞ্চম শ্রেণিতে। এক মেয়ে এখনো তার অবিবাহিত। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বিয়ে হয়নি। মেয়েটিকে নিয়েই তার এখন সব দুশ্চিন্তা।
কাজল জানান, যখন বিয়ে করে আসেন তখন দোচালার ঘর ছিল দুই রুমের। সে সময় ভাসুর, শ্বশুর ও শ্বাশুরড়ি থাকতেন। একসঙ্গে খেতেন। এখন পরিবার বড় হওয়ায় আলাদা থাকেন। স্বামী বেঁচে থাকতে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। একেবারে প্যান্ডেল টানিয়ে উঠানে চেয়ার টেবিল বিছিয়ে খাবারের আয়োজন করেছিলেন। তখন তো খালি ফাঁকা জায়গা ছিল। এখন সেন্টারে বিয়ে হয়, মন্দিরেও হয়। ডেকোরেটরের মানুষ এসে সাজিয়ে দিয়ে যান।
করোনার আগেই এক ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বিয়েটি হয়েছিল মন্দিরে। বৌভাতের দিন ছাদে বসে খাইয়েছিলেন মেয়েপক্ষকে। আতপ চালের গুঁড়ো দিয়ে মেঝেতে, বাড়ির দাওয়ায় কল্কী, শঙ্খ এঁকেছে তার মেয়ে, বউ, নাত্নিরা। খুব সুন্দর মঙ্গলঘট আলপনা আঁকতে পারতেন। শেষ এঁকেছিলেন মেজো মেয়ের বিয়ের সময়। এখন হাত কাঁপে, আগের মতো আর হয় না।
বিয়েশাদি সব দাসের মধ্যে হলেও, আত্মীয়তা তৈরি হয় এ পাড়ার বাইরে গিয়েও। এখানকার ছেলে-মেয়েদের মধ্যেই যে বিয়ে হয়, সবসময় এমনটি নয়।
সাভারের মেয়ে সম্পারানী বিয়ে করে এই দাসপাড়ায় এসে ঘর বেঁধেছেন আজ ৫০ বছর। স্বামী মাছের ব্যবসা করতেন। কারওয়ান বাজার থেকে কিনে এনে বিক্রি করতেন রামপুরা বাজারে। চার ছেলে- বড় ছেলে কাঠের কাজ করেন, জানালা থাইয়ের কাজ করেন, ফার্নিচার পালিশের কাজ করেন। সবাই একসঙ্গেই থাকেন। সকালে ভাত খেয়ে কাজে যান। পাতে থাকে, ভাত সবজি ডাল। দুপুরে যুক্ত এক পদের মাছ। রাতেও তাই।
'সকালে ঘুম থেকে উঠে আশিবাসি ছাড়ি, স্নান করি, পূজা দেই। মোছামাছি করি, এগুলো বাসি কাম। ঘুম থেকে উঠে বাসি কাম আগে করি', বলেন সম্পারানী।
ঘর ঝাড়তে ঝাড়তে ছেলেরা বিছানা ছাড়েন। স্নান সেরে এসে তারা বসেন মাঝের ঘরে। সম্পারানী আর তার পুত্রবধূরা ছেলেদের সামনে থালা গুছিয়ে দেন। ছেলেরা খেয়ে কাজে চলে যান। এরপর আবার দুপুরের রান্নার যোগাড়। দুপুরে ২টা-৩টার দিকে খাবেন। এরপর আর খাবারের পর্ব নেই। একেবারে রাতে আবার ভাত।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে একটু পান, তামাক চিবোন। ঘর থেকে বের হয়ে আশপাশের ঘরের সবার সাথে বসে গল্প করেন। তবে চা খাওয়ার অভ্যাস নেই। সন্ধ্যায় নাতিরা পড়তে বসেন। বউয়েরাও যে যার মতো ঘরে গল্প করেন, সেলাই করেন। রাতে ছেলেরা ফিরলে খাবার বেড়ে খেয়ে নেন। কখনো বুড়ো-বুড়ি আগেই ঘুমিয়ে পড়েন। তখন ছেলে, বউ যে যার মতো খেয়ে নেন। রান্না মূলত তার হাতেই। বউয়েরা সাহায্য করেন। আর ছেলেরা টাকা দিলে বৃদ্ধ স্বামী বাজারে যান। নয়তো বাসায় বসেই দিন পার।
গত সপ্তাহেই কানের ব্যথায় তেজগাঁও সরকারি নাক কান হাসপাতালে গেছেন। এমনিতে ছোটখাটো রোগে কাছেধারে রামপুরা যান। বড় কোনো রোগ বা অপারেশন লাগলে বড় হাসপাতালগুলোয় যান। পাশেই ভাসুরের ছেলের ঘর। সে ঘরের নাতি এসে খেলছে পাশে বসে। আর সম্পারানী শিং মাছ কুটছেন। ছাইয়ে মাখানো কালো কালো শিং মাছগুলো নদী থেকেই সরাসরি আনা। মেয়ের জামাই নিয়ে এসেছিলেন শুক্রবার। পূজায় নতুন জামা-কাপড় পরেন। ভালো খাবার মোয়া চিড়া, নাড়ু এই। লুচি বুটের ডাল করেন। বাবার বাড়ি যান, মেয়েরা আসে। তারাও যান বেড়াতে।
টিনের ঘর, পাঁচ-ছয়তলা দালান সবাই আছে মিলেমিশে
টিনের ঘর, সিমেন্টের একতলা ঘর, আবার পাঁচ-ছয়তলা বাসাও চোখে পড়ে এই একই সীমানার মধ্যে। যেমন, অনলকান্তিরা এখানে ছয়তলা বাড়ি করেছেন। তুলনামূলকভাবে এমন অবস্থাসম্পন্ন বাড়ি কম থাকায় কমলা রঙের এই বাড়ি সবার আগে চোখে পড়ে। নিচে শ্রী কালী মন্দির। বাড়ির নাম মনোরঞ্জন ভিলা। অনলের বাবা মনোরঞ্জন ছিলেন মাছ ব্যবসায়ী। এখনও এই ব্যবসা তারা ধরে রেখেছেন। মাছের ব্যবসাতেই তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছে। তাই এই ব্যবসা আর ছাড়েননি অনল এবং তার ভাইয়েরা।
অনলের ছেলের এখনও স্কুলের পড়ার বয়স হয়নি। তবে তার ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা সবাই অনার্স পর্যন্ত পড়েছেন। তার এক ভাইপো বিদেশেও গিয়েছেন মাস্টার্স করতে। একসময় এখানে শিক্ষার হার কম থাকলেও নতুন প্রজন্মের ৯০ শতাংশই স্নাতক বা ডিগ্রি পাশ করা। মেয়েরাও যার যেমন শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরিতে ঢুকছেন। নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছেন, জানান অনল।
বোনেরা আসেন ভাইছাতুর সময়
পাড়ার এই প্রজন্মের যুবক সবুজ দাস, পড়ালেখা করেছেন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত। সবুজ মনে করেন, বাবা ঠাকুরদার মাছের ব্যবসার চেয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ তুলনামূলক সম্মানেরই। শুনেছেন তার বাবার দাদা নাকি মাছ ধরতেন। সেই মাছ বাজারে বিক্রি করতেন আর কিছু নিয়ে আসতেন ঘরে। নদীর সে টাটকা মাছের স্বাদের কথা মনে করে এখনো আফসোস করেন সজীবের ঠাকুমা।
এই পাড়ায় বড় হওয়ার স্মৃতি আলাদা করে কিছু নেই। তবে এই মানুষগুলো তার খুব আপন। ভালো লাগে সবচেয়ে পূজাপার্বনের সময়। বৈশাখ মাসেই মন্দিরে তাদের এক পূজো হয়ে গেল। বোনেরা আসেন ভাইছাতুর সময়। ভাইফোঁটার মতোই এই প্রথা। বর্তমানে এটি বিলুপ্ত হলেও দাসপাড়ায় এই সময়ে উৎসব উৎসব ভাব হয়। যেহেতু এই এলাকাতেই বংশ পরম্পরায় সবাই আছেন, তাই বোনেরা একদিনের জন্য আসেন বাপের বাড়িতে। এরপর ভাই, জ্যাঠাতো, কাকাতো সবাইকে কপালে শুভচিহ্ন এঁকে ছাতু খাইয়ে দেয় বোনেরা।
সামনে শ্রাবণ মাস, অষ্টপ্রহরের মেলা বসবে সামনে। গান বাজনা হবে, কীর্তন হবে। এছাড়া দূর্গা পূজায় মেলা হয়। ৫০০-১৫০০ টাকা চাঁদা ধরে সবাই যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী দেন। পুরো পাড়া মরিচ বাতি, কাগজ দিয়ে সাজানো হয়। মন্দির সাজানো হয়। এলাকার ছেলে-মেয়েদের সাথে হাত মেলায় বাপ জেঠু কাকারাও। আর বাড়ির মা, চাচি, দিদিরা হাত লাগান মিঠাই মোয়া বানাতে। একসাথে মিলে করেন। সাউন্ড বক্স ভাড়া করে আনা হয় দশমীর দিন।
ভাত খেয়ে সকালে কাজে বের হয়ে যাওয়া, দুপুরে মাছ ভাত খেয়ে একটা ঘুম, বিকেল হলে দাওয়ায় সামনে বসে বসে আশপাশের বাড়ির সঙ্গে গল্পগুজব, উকুন বাছা আর রাতে খেয়েদেয়ে সবাইকে নিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাওয়া। এই তাদের জীবন। এর বাইরে কিছু নিয়ে ভাবার সুযোগ বা ফুসরত নেই। যেমন এই জুলাই অভ্যুত্থানই সম্পারানীর কাছে অজানা। তার মতে, গণ্ডগোলের পর (মুক্তিযুদ্ধের পর) এখানে কোনো ঝামেলা আর হয়নি। কিছুদিন আগে ছেলেরা দৌড়াদৌড়ি করেছিল, এটুকুই কেবল মনে আছে!
হতে পারে এর কারণ, এলাকার নিরাপত্তা। যুদ্ধের সময় অনেকেই পালিয়ে গেলেও বা ভারত চলে গেলেও যুদ্ধের পরে যত ধরনের দাঙ্গা, হাঙ্গামা হয়েছে, এখানে কিছুই হয়নি বলে জানান পাড়ার লোকেরা।
সঞ্জিত বলেন, 'স্থানীয়রা সাহায্য করেই। এই যে মাঝে মন্দিরে মন্দিরে হামলা হইলো, তখন আশেপাশের মুসলিমরাই মন্দির পাহাড়া দিছিল।'
এমনকি পাড়ার মুসলিম ভাড়াটিয়ারাও অন্য কোথাও যেতে চান না একবার আসলে। এত নিরাপদ এই দাসপাড়া, জানান সঞ্জিত।
এই দাসপাড়া ছাড়াও, পশ্চিমপাড়ায় আছে কিছু, মেরুলে আছে কিছু, এছাড়া ভাটারা একশ ফিটে, রাজারবাগেও আছে এই দাস সম্প্রদায়। তারাও আদি।
আদিদের মধ্যে এসব অঞ্চলে আরও আছে রায় বংশ। যদিও এখন তা কমে গিয়ে দু-তিন পরিবারে ঠেকেছে। এদের মধ্যেই। উলন রোড, মহানগর এগুলো ছিল রায় বংশ। এখনো আছে দুই-তিন পরিবার। এরাই আদি।
টিভি সেন্টার, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, রাস্তা এসবকিছু হওয়ার আগে এ অঞ্চল ছিল পতিত জমি। নিজেরা থেকে চাষাবাস করে সুখে-স্বচ্ছলতায় দিন কেটেছে। এখন একেক পরিবারের মালিকানায় আছে আধা কাঠা, এক কাঠার মতো। এখন যা আছে তাতেই ঘর তুলে থাকছেন।
বাইরে ১৭০০ স্কয়ার ফিটের একটা বাসার চেয়ে এখানে ৭০০ স্কয়ার ফিটের একটা বাসায় কিংবা তার চেয়েও ছোটো ঘরে থাকায় বেশি সুখ। এমনটাই মনে করেন দাসপাড়ার দাসেরা। হয়তো বাইরে গেলে একটু উন্নত জীবনযাপন হবে, কিন্তু বংশ পরম্পরায় যেভাবে এখানে তাদের শেকড় গেঁথে গেছে, সেখান থেকে চলে যাওয়ার কথা ভাবতেও চান না তারা।
একসময় এটি ছিল জেলেপল্লী, এখন তা শুধুই উলন দাসপাড়া। ঢাকার মধ্যে অন্যতম আদি এই পাড়াটিকে টিকে থাকা শেষ আদি জেলেপল্লী হিসেবে বিবেচনা করলেও বোধহয় খুব একটা ভুল হবে না।
বি.দ্র: নাম প্রকাশে অনেকেই অনিচ্ছুক থাকায় ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে। পুরো লেখাটিই 'ওরাল হিস্ট্রি' বা মৌখিক ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে লেখা।