এড়িয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প, হতাশ হলেও নীরব ইসরায়েল

চলতি সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একের পর এক ঘোষণা ইসরায়েলের ডানপন্থী সরকারকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলেছে। ঘোষণাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে নিজেদের অবস্থান নিয়ে ইসরায়েলের ধারণাগুলোকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। তবু কূটনৈতিক নীরবতা বজায় রেখেছে ইসরায়েল।
মধ্যপ্রাচ্য সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ইসরায়েলকে এড়িয়ে যাওয়াকে অনেকেই দেখছেন উপসাগরীয় ধনী দেশগুলোর সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ার অগ্রাধিকার হিসেবে। এ তালিকায় রয়েছে কাতারও, যাকে ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে হামাসের পৃষ্ঠপোষক বলে অভিযোগ করে আসছে।
তবে সফরের আগেই ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈঠক এবং ইয়েমেনের হুথিদের ওপর বিমান হামলা বন্ধের ঘোষণা ইসরায়েলকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। কারণ, ইরানের সমর্থনপুষ্ট হুথি গোষ্ঠী এখনও ইসরায়েলের দিকে নিয়মিত ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে যাচ্ছে।
এরইমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র হামাসের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করে, যাতে গাজা থেকে জীবিত শেষ মার্কিন জিম্মি এডান আলেকজান্ডারকে মুক্ত করা যায়। এ নিয়েও ইসরায়েল কিছু বলার সুযোগ পায়নি।
এরপর সিরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিলেন ট্রাম্প। দামেস্কের নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করারও আহ্বান জানান তিনি। তবে ইসরায়েল এই সরকারকে 'জিহাদিপন্থী শাসনব্যবস্থা' হিসেবে দেখে এসেছে।
মঙ্গলবার রিয়াদে ট্রাম্প যখন হুথিদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির কৃতিত্ব দাবি করছিলেন, ঠিক তখনই জেরুজালেম ও তেলআবিবসহ ইসরায়েলের নানা জায়গায় সাইরেন বাজতে শুরু করে। ইয়েমেন থেকে ছোড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের দিকে ধেয়ে আসছিল।
তবু ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরার কথা নাকচ করে দিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সেটি ইসরায়েলের জন্যই 'ভালো'। মধ্যপ্রাচ্য সফর বরং ইসরায়েলেরই উপকারে আসবে।
তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এ বিষয়ে এখনও কোনো মন্তব্য করেননি। শুধু গাজা থেকে জীবিত মার্কিন জিম্মি এডান আলেকজান্ডারকে মুক্ত করতে সহায়তার জন্য ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
তবে সাম্প্রতিক ঘটনায় নেতানিয়াহুকে ঘিরে ইসরায়েলে চাপ বাড়ছে। গাজা যুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনা, সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগে অগ্রগতি না হওয়ায় অনেকেরই ধারণা, এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ইসরায়েল পিছিয়ে পড়েছে।
ইসরায়েলের ডানপন্থী পত্রিকা 'ইসরায়েল হায়োম' পত্রিকায় বিশ্লেষক ইয়োভ লিমোর লিখেছেন, 'চোখের সামনে চুক্তি আর বৈঠকের মধ্য দিয়ে নতুন করে মধ্যপ্রাচ্য গড়ে উঠছে—আর ইসরায়েল (সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও) কেবল দর্শকের ভূমিকায় আছে।'
নেতানিয়াহু, যিনি দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হলেও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, আগেই বলেছিলেন, তিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চেয়ে বেশি পছন্দ করেন।
তৎকালীন বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতার ঘটনায় কয়েকজনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং ভারী অস্ত্র সরবরাহ আটকে দেয়।
এদিকে গাজা যুদ্ধ নিয়ে নেতানিয়াহু দুই ধরনের চাপের সম্মুখীন—একদিকে তার সরকারে থাকা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী কট্টরপন্থীরা হামাসকে পুরোপুরি পরাজিত না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে। অন্যদিকে দীর্ঘ ১৮ মাসের এই সংঘাতে সাধারণ ইসরায়েলিরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
যদিও এখন পর্যন্ত নেতানিয়াহু কট্টরপন্থীদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন।
তবে গত দুই সপ্তাহে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো থেকে স্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের যে 'বিশেষ সম্পর্কের' জেরে ইসরায়েল এতদিন ধরে সুবিধাগুলো পেত, তা হয়তো আর থাকছে না।
মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক উপপরিচালক জনাথন প্যানিকফ বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের অগ্রাধিকারের মধ্যে স্পষ্ট ফারাক তৈরি হয়েছে।'
বর্তমানে ওয়াশিংটনের আটলান্টিক কাউন্সিল থিঙ্কট্যাংকে কর্মরত প্যানিকফ আরও বলেন, 'ট্রাম্প এখন স্পষ্টভাবেই বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-কেন্দ্রিক সম্পর্ক গড়তে চাইছেন। নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিষয়ে যদি ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য হয়, তবুও ট্রাম্প তার পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে যাবেন।'
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ক এখনও শক্তিশালী বলে দাবি করলেও ট্রাম্প প্রশাসন নেতানিয়াহুর প্রতি কিছুটা হতাশ। কারণ, ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গাজা ও ইউক্রেনের যুদ্ধ দ্রুত শেষ করতে চান।
এজন্য নেতানিয়াহুকে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময়ে আরও আন্তরিক হওয়ার তাগিদ দিচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন।
আবার ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ওপর ইসরায়েলি হামলার পক্ষেও যুক্তরাষ্ট্র খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তারা কূটনৈতিক সমাধান চায়।
হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জেমস হিউইট বলেন, 'গাজায় আটক ৫৮ জন বন্দির মুক্তি ও মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা জোরদারে আমরা ইসরায়েলের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি।'
তিনি আরও বলেন, 'ইসরায়েলের ইতিহাসে ট্রাম্পের মতো ভালো বন্ধু আর কেউ ছিল না।'
ইসরায়েলের সরকারে থাকা কট্টরপন্থীরা, যারা একসময় গাজায় ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে সৈকতের ধারে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার ট্রাম্প পরিকল্পনায় খুশি হয়েছিল, এখন অধিকাংশই চুপ। ট্রাম্প প্রশাসন নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো সমালোচনা করছে না তারা।
আলেকজান্ডারের মুক্তির ব্যাপারে ইসরায়েলকে পাশ কাটানো হয়েছে কি না—জানতে চাইলে এই প্রসঙ্গে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র একটি সার্বভৌম দেশ।'
তিনি আরও বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ আলোচনা হয় সরাসরি, মিডিয়ার মাধ্যমে নয়।'
যুদ্ধবিরতি আলোচনায় অংশ নিতে ইসরায়েলি একটি প্রতিনিধিদল এখন দোহায় অবস্থান করছে। এই আলোচনা চালাচ্ছেন ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। তবে এরই মধ্যে গাজায় হামলা আরও জোরদার করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। বুধবার তাদের হামলায় বহু ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের লক্ষ্য বদলায়নি। তারা হামাসকে সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে ধ্বংস করতে চান।
তিনি বলেন, 'ইসরায়েল থামবে না, আত্মসমর্পণও করবে না।'