ব্রাজিলের দুর্গম এক শহরের বিরল রোগ, যেখানে সবাই সবার আত্মীয়

আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগেও ব্রাজিলের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছোট্ট শহর সেরিনহা দু পিন্তোসের বাসিন্দারা জানতেন না, কেন তাদের শিশুরা ধীরে ধীরে চলাফেরা করার ক্ষমতা হারাচ্ছে। খবর বিবিসি'র
পাঁচ হাজারেরও কম জনসংখ্যার এ শহরে জীববিজ্ঞানী ও জিন বিশেষজ্ঞ সিলভানা সান্তোস এক নতুন রোগের উৎস খুঁজে পান।
তার গবেষণায় উঠে আসে, এটি একটি জেনেটিক মিউটেশনের (জিনগত পরিবর্তন) কারণে সৃষ্ট স্নায়ুতন্ত্র-সংক্রান্ত রোগ, যার নাম রাখা হয় স্পোয়ান সিনড্রোম।
উত্তরাধিকারসূত্রে বাবা-মা উভয়ের থেকেই পরিবর্তিত (ত্রুটিপূর্ণ) জিন শিশুর শরীরে এলে এই রোগ দেখা দেয়। এতে শিশুর শরীর ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে, হাঁটাচলা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়।
সান্তোসের এই গবেষণার মাধ্যমেই বিশ্বে প্রথমবারের মতো স্পোয়ান সিনড্রোমের অস্তিত্ব চিহ্নিত এবং ব্যাখ্যা করা হয়।
তার এই অসাধারণ গবেষণা এবং পরবর্তী কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২৪ সালে বিবিসির 'বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী নারী'র তালিকায় স্থান করে নেন তিনি।
সান্তোস আসার আগে রোগটির কোনো ব্যাখ্যা ছিল না শহরের বাসিন্দাদের কাছে। আজ সেরিনহা দু পিন্তোসের বাসিন্দারা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জেনেটিক্স এবং স্পোয়ান সিনড্রোম নিয়ে কথা বলেন।
সেখানকারই একজন স্পোয়ান সিনড্রোম রোগী মারকিনহোস বলেন, 'সান্তোস আমাদের এ রোগের এমন এক ব্যাখ্যা দিলেন, যা আগে কেউ দিতে পারেনি। তার এ গবেষণার পরপরই সাহায্য আসতে শুরু করল—মানুষ এলো, অর্থসহায়তা এলো, সাথে হুইলচেয়ারও আনা হলো।'

যে শহরে সবাই সবার আত্মীয়
ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় এবং সমৃদ্ধ শহর সাও পাওলোতে বেড়ে ওঠা সিলভানা সান্তোসের বহু প্রতিবেশীই এসেছিলেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছোট শহর সেরিনহা দু পিন্তোস থেকে। তাদের অনেকেই ছিলেন পারিবারিকভাবে একে অপরের আত্মীয়, আবার অনেকেই পরস্পরের সঙ্গে বিয়েও করেছিলেন।
এই প্রতিবেশীরাই প্রথম সান্তোসকে জানান, সেরিনহায় এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা হাঁটতে পারেন না। কিন্তু কেউই জানেন না এর কারণ কী।
সান্তোসের প্রতিবেশীদেরই একজনের মেয়ে জিরলান্দিয়া ছোটবেলা থেকেই এক জটিল শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। তার চোখ অস্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করত, ধীরে ধীরে হাত-পায়ের শক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি। শেষে তাকে হুইলচেয়ারে বসে চলাফেরা করতে হতো, এমনকি দৈনন্দিন ছোটখাটো কাজেও অন্যের সহায়তা লাগত।
দীর্ঘ গবেষণার পর সান্তোস ও তার দল বুঝতে পারেন জিরলান্দিয়ার এই লক্ষণগুলো আসলে জিনঘটিত রোগ স্পোয়ান সিনড্রোমের উপসর্গ। পরে তারা বিশ্বের নানা প্রান্তে আরও ৮২টি অনুরূপ রোগীর সন্ধান পান।
প্রতিবেশীদের আমন্ত্রণে একবার ছুটিতে সান্তোস সেরিনহা দু পিন্তোস শহরে বেড়াতে যান। সেখানে পা রেখেই তার মনে হয়, তিনি যেন এক ভিন্ন জগতে প্রবেশ করেছেন। শুধু পাহাড়ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রূপ-রস-গন্ধেই নয়, শহরের সামাজিক কাঠামোর এক বিশেষ বাস্তবতাও সান্তোসকে বিস্মিত করে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি অবাক হয়ে দেখেন, পারিবারিক আত্মীয়ের সঙ্গে বিয়ে সেখানে খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার।
শহরটি ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন। বাইরের মানুষ এসে এখানে বসতি গড়ার সুযোগও কম। ফলে দেখা যায়, এখানে বেশিরভাগ মানুষই পারিবারিকভাবে একে অপরের আত্মীয় এবং আত্মীয়দের মধ্যেই বিয়ের প্রবণতা বেশি।

২০১০ সালে সান্তোসের নেতৃত্বে হওয়া এক গবেষণায় দেখা যায়, সেরিনহার ৩০ শতাংশের বেশি দম্পতি একে অপরের আত্মীয়স্বজন ছিলেন এবং এক-তৃতীয়াংশ দম্পতির অন্তত একজন সন্তান প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মেছিল।
বিশ্বজুড়ে আত্মীয়ের সঙ্গে বিয়ের হার গড়ে ১০ শতাংশ হলেও, দেশভেদে এর ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়। যেমন পাকিস্তানে এই হার ৫০ শতাংশের বেশি, ব্রাজিলে ১ থেকে ৪ শতাংশ, আর যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ায় ১ শতাংশেরও কম।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে হলে জিনঘটিত রোগ বা প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ব্রাজিলের ফেডারেল ইউনিভার্সিটি অব রিও গ্রান্ডে দু সুল-এর জিনবিদ লুজিভান কোস্টা রেইস বলেন, 'অপরিচিত দম্পতির ক্ষেত্রে বিরল জিনঘটিত রোগ বা প্রতিবন্ধী সন্তানের আশঙ্কা থাকে ২ থেকে ৩ শতাংশ, কিন্তু দম্পতি একে অপরের আত্মীয় হলে এই ঝুঁকি বেড়ে দাঁড়ায় ৫ থেকে ৬ শতাংশ পর্যন্ত।'
রোগ শনাক্তে দীর্ঘ পথচলা
সেরিনিহার মানুষের রহস্যময় রোগটি চিহ্নিত করতে সান্তোস শুরু করেন এক দীর্ঘ জিনগত অনুসন্ধান। গবেষণার জন্য পরিশ্রমও কম করতে হয়নি সান্তোসকে। দরজায় দরজায় গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কফির টেবিলে গল্প করেছেন, সংগ্রহ করেছেন তাদের ডিএনএ নমুনা ও পারিবারিক ইতিহাস।
প্রাথমিকভাবে তিন মাস মাঠপর্যায়ের গবেষণার পরিকল্পনা থাকলেও, তা পরিণত হয় বছরের পর বছর ধরে চলা এক অভিযানে। শেষ পর্যন্ত তিনি ওই অঞ্চলে বাসাও বেঁধে ফেলেন।
শেষমেশ ২০০৫ সালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে প্রথমবারের মতো 'স্পোয়ান' নামের এক জিনঘটিত রোগের অস্তিত্ব তুলে ধরা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, একটি নির্দিষ্ট ক্রোমোজোমের ক্ষুদ্রাংশ বিলুপ্ত হওয়ায় মস্তিষ্কে একটি প্রোটিন অস্বাভাবিকভাবে তৈরি হতে থাকে, যা ধীরে ধীরে স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল করে দেয়।
স্থানীয় কৃষক, ৮৩ বছর বয়সী লোলো বলেন, 'গবেষকরা বলেছেন যে এই জিনটির উৎস আমাদের পরিবারের ম্যাক্সিমিয়ানো নামের এক ব্যক্তি, যিনি বেশ নারীঘেঁষা স্বভাবের ছিলেন।'
লোলো নিজেও তার আত্মীয়কে বিয়ে করেছিলেন, তারপর আর কখনও সেরিনিয়া ছাড়েননি। লোলোর মেয়ে রেজানও স্পোয়ানে আক্রান্ত—দৈনন্দিন কাজে সহায়তা ছাড়া সে চলতে পারে না।
তবে গবেষকদের মতে, স্পোয়ানের এই জিনগত পরিবর্তনের ইতিহাস বেশ পুরনো। ধারণা করা হয়, এটি ব্রাজিলে এসেছে ৫০০ বছরেরও বেশি আগে, ইউরোপ থেকে আগত উপনিবেশবাদীদের মাধ্যমে।

সান্তোস বলেন, 'জিন-সিকোয়েন্স বিশ্লেষণে রোগীদের মধ্যে ইউরোপীয় বংশধারার প্রবল উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা ওই অঞ্চলের পর্তুগিজ, ডাচ ও সেফার্দি ইহুদি পূর্বপুরুষদের সঙ্গে মিলে যায়।'
মিসরেও স্পোয়ান রোগীর সন্ধান পাওয়ার পর এই ধারণা আরও জোরালো হয়। সেখানকার রোগীদের জিনগত কাঠামোতেও পাওয়া যায় ইউরোপীয় পূর্বসূরির প্রমাণ। সব মিলিয়ে ধারণা করা হয়, রোগটির মূল উৎস আইবেরীয় উপদ্বীপে।
সান্তোস বলেন, 'সম্ভবত এটি এসেছে স্পেন-পর্তুগাল থেকে পালিয়ে আসা সেফার্দি ইহুদি বা মুরদের মাধ্যমে, যারা ধর্মীয় নিপীড়নের সময় আশ্রয় খুঁজছিল।'
তার ধারণা, বিশ্বজুড়েই আরও স্পোয়ান রোগীর সন্ধান পাওয়া যেতে পারে—বিশেষ করে পর্তুগালে।
ঝুঁকি সম্পর্কে বুঝতে শিখেছে মানুষ
স্পোয়ান রোগের কোনো চিকিৎসা এখনো আবিষ্কৃত না হলেও রোগীদের শনাক্তকরণের মাধ্যমে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। আগে যাদের 'পঙ্গু' বলা হতো, এখন তারা পরিচিত 'স্পোয়ান রোগী' হিসেবে।
হুইলচেয়ার শুধু তাদের চলাফেরার স্বাধীনতাই দেয়নি, বরং শরীরের বিকৃতি ঠেকাতেও সহায়তা করেছে। আগে অনেক রোগী বিছানা বা মেঝেতে পড়ে থাকতেন—সঠিক ভঙ্গিতে বসতে না পারার কারণে তাদের দেহে নানা জটিলতা তৈরি হতো।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পোয়ান রোগীদের শারীরিক দুর্বলতা বাড়ে। ৫০ বছর পেরোলেই প্রায় সবাইকে অন্যের সহায়তায় চলতে হয়।
নিজের দূরসম্পর্কের চাচাত ভাইকে বিয়ে করা ইনেসের ছেলেদের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই হয়েছে। ৫৯ বছর বয়সী চিকুইনহো এখন আর কথাই বলতে পারেন না, আর ৪৬ বছর বয়সী মার্কিনিওসের যোগাযোগ ক্ষমতাও সীমিত।

ইনেস বলেন,'বিশেষ শিশুদের লালন-পালন করা সত্যিই কঠিন। আমরা তাদের খুব ভালোবাসি, তবে তাদের কষ্টে আমাদেরও কষ্ট হয়।'
চিকুইনহো ও মার্কিনিওসের ভাগনি ২৫ বছর বয়সী লারিসা কুয়েরোজও বিয়ে করেছেন দূরসম্পর্কের আত্মীয়কে।
'সেরিনিহা দু পিন্তোসে সবাই একে-অপরের আত্মীয়। এখানে সবাই একে অপরের কাজিন,' বলেন লারিসা।
লারিসা ও সাওলোর মতো দম্পতির ওপরই এখন নতুন এক গবেষণা চালানো হচ্ছে, যাতে সান্তোসও যুক্ত আছেন। ব্রাজিলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় এই প্রকল্পে ৫ হাজার দম্পতির জেনেটিক স্ক্রিনিং করা হবে, যেন মারাত্মক এই রোগ সৃষ্টিকারী রিসেসিভ জিন শনাক্ত করা যায়।
সান্তোস বলেন, এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করা নয়, বরং জিনগত ঝুঁকি সম্পর্কে দম্পতিদের সচেতন করা।
সান্তোস বর্তমানে একাধারে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং উত্তর-পূর্ব ব্রাজিলে একটি জেনেটিক শিক্ষাকেন্দ্রের পরিচালক। জেনেটিক পরীক্ষার সুযোগ আরও প্রসারিত করতে তিনি নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন।
গবেষণার সূত্রে সেরিনহা দু পিন্তোস শহরের মানুষজনের সঙ্গে সান্তোসের এক গভীর আত্মিক বন্ধন গড়ে ওঠে। এখনো সেখানে ফিরলে মনে হয়, যেন তিনি নিজের বাড়িতেই ফিরেছেন।
ইনেস বলেন, 'সান্তোস আমাদের পরিবারেরই একজন।'