সিস্টিন চ্যাপেলে দেখা গেল সাদা ধোঁয়া, নতুন পোপ রবার্ট প্রেভোস্ট

বিশ্বের ১৪০ কোটি সদস্যবিশিষ্ট ক্যাথলিক চার্চের নতুন নেতা নির্বাচিত হয়েছেন মার্কিন নাগরিক রবার্ট প্রেভোস্ট। ৬৯ বছর বয়সি এই যাজক প্রথম মার্কিন পোপ হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি 'পোপ লিও চতুর্দশ' নাম ধারণ করেছেন।
সিস্টিন চ্যাপেল থেকে সাদা ধোঁয়া উঠতেই সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে বেজে উঠল ঘণ্টার ধ্বনি। বৃহস্পতিবার (৮ মে) এই দৃশ্যের মাধ্যমে কার্ডিনালরা রোমান ক্যাথলিক চার্চের নতুন পোপ নির্বাচন করেছেন।
শিকাগোয় জন্ম নেওয়া প্রেভোস্ট অধিকাংশ সময় পেরুতে মিশনারি হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের চিকলায়ো অঞ্চলে বিশপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালেই তিনি পেরুর নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন এবং বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও পেরু—দুই দেশের দ্বৈত নাগরিক।
২০২৩ সালে কার্ডিনাল পদে অধিষ্ঠিত হন প্রেভোস্ট, তবে আন্তর্জাতিক পরিসরে তিনি তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত। গণমাধ্যমে তার সাক্ষাৎকারও খুব কমই পাওয়া যায়।
২০১৩ সাল থেকে ক্যাথলিক চার্চের নেতৃত্বে থাকা পোপ ফ্রান্সিসের স্থলাভিষিক্ত হলেন তিনি। প্রেভোস্টের দীর্ঘদিনের বন্ধু রেভারেন্ড মার্ক ফ্রান্সিস বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, নতুন পোপ তার পূর্বসূরির পাপ্যাল নীতিমালার একজন দৃঢ় সমর্থক ছিলেন, বিশেষত সামাজিক ন্যায়বিচার বিষয়ক অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে।
"তিনি সবসময়ই সদয় ও আন্তরিক ছিলেন। চার্চের দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছানোর প্রচেষ্টায় তার সাধারণ বোধ ও বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল গুরুত্বপূর্ণ," বলেন মার্ক ফ্রান্সিস। তারা ১৯৭০-এর দশকে একসঙ্গে সেমিনারিতে পড়াশোনা করেন এবং ২০০০-এর দশকে রোমে একসঙ্গে বসবাস করেন।
তিনি আরও বলেন, "তার মধ্যে সূক্ষ্ম রসবোধ আছে, কিন্তু তিনি কখনও প্রচারের আলোতে আসার চেষ্টা করেননি।" বর্তমানে মার্ক ফ্রান্সিস যুক্তরাষ্ট্রের ভায়েটোরিয়ান ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রদেশীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
১৩৩ জন কার্ডিনাল নির্বাচক বুধবার বিকেলে ভ্যাটিকানের প্রাচীন প্রাচীরঘেরা এলাকায় নিজেদের একান্তে আবদ্ধ করেন। বৃহস্পতিবার ছিল তাদের ভোটদানের প্রথম পূর্ণ দিন।
সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদে ছোট একটি চিমনি থেকে ধোঁয়া উঠতেই সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে জড়ো হওয়া জনতা উল্লাসে ফেটে পড়েন। করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে চত্বর।
'পোপ দীর্ঘজীবী হোন!'—উজ্জ্বল রোদে দাঁড়িয়ে স্লোগান দেন অনেকে। এক ব্যক্তির হাতে ধরা পোস্টারে লেখা ছিল, 'আমরা একজন পোপ পেয়েছি!'
নতুন পোপের পরিচয় এবং তিনি কোন নাম গ্রহণ করেছেন, তা শিগগিরই ঘোষণা করা হবে সেন্ট পিটার্স বাসিলিকার কেন্দ্রীয় ব্যালকনি থেকে।
এরপর তিনি সামনে এসে জনতার উদ্দেশে তার প্রথম ভাষণ ও আশীর্বাদ প্রদান করবেন।
ব্রাজিলের পতাকা হাতে এক নারী কান্নাভেজা চোখে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্কয়ারে। তিনি ব্রাজিলিয়ান সন্ন্যাসিনী সিস্টার মোনা লিসা। তিনি বলেন, 'আমি খুব খুশি, আমাদের এখন একজন পোপ পাওয়া গেল।'
পোপ ফ্রান্সিস গত ২১ এপ্রিল মারা যান। তিনি ১২ বছর ধরে ১৪০ কোটি সদস্যবিশিষ্ট ক্যাথলিক চার্চের নেতৃত্বে ছিলেন।
তার শাসনকালে তিনি চার্চকে আধুনিক দুনিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি বিভিন্ন সংস্কার এনেছিলেন এবং নারীদের পুরোহিত হিসেবে নিয়োগ ও এলজিবিটি ক্যাথলিকদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বিতর্ক উন্মুক্ত করেন।
তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে কার্ডিনালদের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট নাম এগিয়ে ছিল না। তবে ইতালির কার্ডিনাল পিয়েত্রো পারোলিন এবং ফিলিপাইনের কার্ডিনাল লুইস অ্যান্তোনিও তাগলের নাম আলোচনায় ছিল।
পারোলিন ছিলেন পোপ ফ্রান্সিসের আমলে ভ্যাটিকানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে। তাগলে হলেন এশিয়ার প্রভাবশালী ধর্মগুরুদের একজন।
অন্যান্য সম্ভাব্য প্রার্থীদের (ইতালিতে যাদের 'পাপাবিলি' বলা হয়) মধ্যে ছিলেন ফ্রান্সের জঁ-মার্ক আভেলিন, হাঙ্গেরির পিটার এরদো, যুক্তরাষ্ট্রের রবার্ট প্রেভোস্ট, ইতালির পিয়েরবাতিস্ত পিৎজাবালা এবং ফিলিপাইনের পাবলো ভার্জিলিও ডেভিড।
কার্ডিনালদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে—তারা কি সংস্কারপন্থী ফ্রান্সিসের নীতি অনুসরণ করবেন, না-কি একজন রক্ষণশীল নেতৃত্ব বেছে নেবেন।
কনক্লেভ চলাকালে বাইরের জগতের সঙ্গে তাদের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম ছিল চিমনির ধোঁয়া। কালো ধোঁয়া মানে পোপ নির্বাচিত হয়নি, সাদা ধোঁয়া মানে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ভোটে কেউ নির্বাচিত হয়েছেন।
বুধবার সন্ধ্যায় প্রথম ভোটে সিদ্ধান্ত হয়নি। বৃহস্পতিবার সকালে আরও দুটি ব্যালট হয়।
বিকেল ৪টায় কার্ডিনালরা আবার সিস্টিন চ্যাপেলে ফেরেন। সন্ধ্যা ৬টা ৮ মিনিটে দেখা যায় সাদা ধোঁয়া।
এই সময়ে কার্ডিনালরা বাইরের জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিলেন। তাদের ফোন ও কম্পিউটার তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
ভোটের সময় তাদের সিস্টিন চ্যাপেলে নিয়ে যাওয়া হতো, আবার থাকার ও খাওয়ার জন্য ভ্যাটিকানের দুটি অতিথিশালায় আনা-নেওয়া করা হতো।
গত ১০টি কনক্লেভে গড়ে ৭ দশমিক ২ ব্যালটে একজন পোপ নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৩ সালে পোপ ফ্রান্সিস পাঁচ ব্যালটে নির্বাচিত হয়েছিলেন।