সাপের বিষ শরীরে নিয়েছেন শতবার, তার রক্তেই তৈরি হলো ১৯ প্রজাতির অ্যান্টিভেনম

২০১৭ সালে এক অদ্ভুত খবরের শিরোনামে চোখ আটকাল ইমিউনোলজিস্ট জ্যাকব গ্ল্যানভিলের—একজন মানুষ, যিনি বিশ্বের সবচেয়ে বিষাক্ত কিছু সাপ—যেমন কোবরা, মাম্বা ও র্যাটলস্নেকের বিষ নিজ শরীরে শত শতবার ইনজেকশন দিয়েছেন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে সাপের কামড় খেতে দিয়েছেন।
টিম ফ্রিডে যখন নিজের শরীরে একের পর এক বিষধর সাপের বিষ প্রয়োগ করছিলেন, তখন অনেকেই তাকে 'পাগল' বলেই ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞানী জ্যাকব গ্লানভিল বিষয়টিকে দেখেছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন সম্ভাবনার এক 'গোপন রত্ন'—ফ্রিডের রক্তে থাকা বিরল অ্যান্টিবডি।
ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা টিম ফ্রিডে ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত সাপ বিশেষজ্ঞ। প্রায় ১৮ বছর ধরে ফ্রিড নিজেকে ইচ্ছাকৃতভাবে সাপের বিষে আক্রান্ত করে গেছেন—কখনও ইনজেকশনের মাধ্যমে, কখনও সরাসরি কামড় খেয়ে। এর ফলে তার শরীরে এমন অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, যা একাধিক সাপের নিউরোটক্সিনের বিরুদ্ধে একসঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
গ্ল্যানভিল বলেন, 'আমি ওকে ফোন করে বলি—আমি জানি ব্যাপারটা অদ্ভুত শোনাবে, কিন্তু তোমার রক্ত নিয়ে গবেষণা করতে চাই। উত্তরে ও বলল, " শেষ পর্যন্ত এই ফোনটা আসলো!"'
এরপর ফ্রিডে ৪০ মিলিলিটার রক্ত দিয়ে দেন গ্ল্যানভিলের গবেষণা দলে। আট বছর পর, সেই রক্ত থেকে সংগ্রহ করা অ্যান্টিবডি ও একটি ভেনম-ব্লকার ওষুধের মাধ্যমে তৈরি হলো এমন এক অ্যান্টিভেনম, যা অন্তত ইঁদুরের দেহে ১৯ প্রজাতির বিষাক্ত সাপের কামড় ঠেকাতে সক্ষম।
গ্লানভিল বলেন, 'আমার জানা মতে, টিমের অভিজ্ঞতার কোনো তুলনা হয় না। তিনি সারা বিশ্বের নানা ধরনের সাপের বিষ ব্যবহার করেছেন—ভিন্ন মহাদেশ থেকে ভিন্ন প্রজাতির। ১৭ বছর ৯ মাস ধরে তিনি এই কাজ করে গেছেন, আর তার প্রতিটি ধাপের নিখুঁত তথ্য তিনি নথিভুক্ত করেছেন।'
তবে গ্লানভিল স্পষ্ট করে বলেন, 'আমরা খুব জোর দিয়ে বলি—টিম যা করেছেন, তা কেউ করার চেষ্টা করবেন না। সাপের বিষ অত্যন্ত বিপজ্জনক।'
ফ্রিডে নিজে ২০১৮ সালে সাপের বিষ নিজ শরীরে নেওয়া বন্ধ করে দেন কিছু মারাত্মক অভিজ্ঞতার পর। এখন তিনি গ্ল্যানভিলের বায়োটেক কোম্পানি 'সেন্টিভ্যাক্স'-এ কাজ করছেন।
সাপের কামড়: এক বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট
যদি আপনার দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোনো বিষধর সাপ আপনার শরীরে দাঁত বসিয়ে দেয়, তাহলে বাঁচার একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়ায় অ্যান্টিভেনম—যা আজও প্রায় সেই ভিক্টোরিয়ান যুগের পদ্ধতিতে তৈরি হচ্ছে।
এই প্রচলিত পদ্ধতিতে সাপের বিষ সংগ্রহ করা হয় হাতে, তারপর তা অল্প অল্প করে ঘোড়া বা অন্য কোনো প্রাণীর শরীরে ইনজেকশন দিয়ে দেওয়া হয়, যাতে শরীর ইমিউন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পরে সেই প্রাণীর রক্ত থেকে অ্যান্টিবডি সংগ্রহ করা হয়, যা বিষের বিরুদ্ধে কাজ করে।

তবে এই প্রক্রিয়াটি যেমন সময়সাপেক্ষ ও ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনই এতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। এবং তৈরি হওয়া সিরাম অনেক সময়ই শরীরে গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটাতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই সাপের কামড়ের জন্য আরও উন্নত চিকিৎসা-পদ্ধতির আহ্বান জানিয়ে আসছেন। কারণ প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ২০০ জন মানুষ সাপের বিষে মারা যান, যার অধিকাংশই উন্নয়নশীল দেশে বাস করেন। প্রতিবছর প্রায় ৪ লাখ মানুষ সাপের কামড়ে স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যান। ২০১৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সাপের কামড়কে 'উপেক্ষিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ' হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
গুয়াতেমালায় বড় হওয়া জ্যাকব গ্লানভিল বলেন, তিনি ছোটবেলা থেকেই সাপের কামড় সংক্রান্ত স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা জানতেন। তাই টিম ফ্রিডের অভিজ্ঞতা তার কাছে এক বিরল সুযোগ মনে হয়।
'ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে'
ফ্রিডের রক্ত থেকে গবেষকরা যে অ্যান্টিবডিগুলো সংগ্রহ করেছেন, সেগুলো এমন কিছু নিউরোটক্সিনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে যা ১৯টি বিষধর সাপের মধ্যে পাওয়া যায়—এর মধ্যে ছিল কোরাল সাপ, মাম্বা, কোবরা, টাইপান, ক্রাইটসহ আরও অনেক প্রজাতি।
এরপর এই অ্যান্টিবডিগুলো একে একে পরীক্ষা করা হয়েছিল ইঁদুরের ওপর, যাদের শরীরে ওইসব সাপের বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। এতে করে বিজ্ঞানীরা সুনির্দিষ্টভাবে বুঝতে পারেন, সব ধরনের বিষকে নিষ্ক্রিয় করতে কতগুলো উপাদান ন্যূনতম প্রয়োজন।
শেষ পর্যন্ত গবেষকেরা একটি 'ড্রাগ ককটেল' তৈরি করেন, যাতে ছিল তিনটি উপাদান—ফ্রিডের শরীর থেকে সংগ্রহ করা দুটি অ্যান্টিবডি এবং একটি ছোট আকারের ওষুধ ভ্যারেসপ্লাডিব, যা এমন একটি এনজাইমকে বাধা দেয় যা ৯৫ শতাংশ সাপের কামড়ে সক্রিয় থাকে। এই ওষুধ বর্তমানে মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মধ্যে আছে।
প্রথম অ্যান্টিবডির নাম এলএনএক্স-ডি০৯, যেটি ছয় ধরনের সাপের বিষ থেকে ইঁদুরদের সম্পূর্ণ সুরক্ষা দিতে পেরেছিল।
এর সঙ্গে ভ্যারেসপ্লাডিব যোগ করলে আরও তিনটি প্রজাতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। পরে ফ্রিডের রক্ত থেকে নেওয়া দ্বিতীয় অ্যান্টিবডি এসএনএক্স-বি০৩ যুক্ত করলে, এই প্রতিরক্ষা ছড়িয়ে পড়ে সব মিলিয়ে ১৯টি সাপের বিষের বিরুদ্ধেই।
গবেষকদের মতে, এই অ্যান্টিভেনম ইঁদুরদের ১৩টি সাপের বিষ থেকে শতভাগ রক্ষা করতে পেরেছে, আর বাকি ছয়টির ক্ষেত্রে আংশিক সুরক্ষা (২০ থেকে ৪০ শতাংশ) মিলেছে।
ব্রিটেনের ল্যাঙ্কাস্টার ইউনিভার্সিটির স্নেকবাইট ফার্মাকোলজিস্ট স্টিভেন হল এই গবেষণাকে বলেছেন 'অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত ও সৃজনশীল একটি পন্থা'। যদিও তিনি গবেষণার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না।
হল মনে করেন, যেহেতু এই অ্যান্টিভেনমে ব্যবহৃত অ্যান্টিবডিগুলো মানুষের শরীর থেকে এসেছে, তাই এটি পশু-নির্ভর প্রচলিত অ্যান্টিভেনমের তুলনায় অনেক কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে—যেমন অ্যালার্জি বা শরীরের অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।

তিনি আরও বলেন, 'মাত্র এক বা দুইটি অ্যান্টিবডি ও একটি ছোট আকারের ওষুধ ব্যবহার করে এতগুলো প্রজাতির বিষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সত্যিই প্রশংসনীয়। এটি দেখায়, কীভাবে অ্যান্টিবডি ও ছোট-মলিকিউল ওষুধ একসঙ্গে মিলে কতটা কার্যকর হতে পারে।'
'যদি এটা মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহারের অনুমোদন পায়, তাহলে সেটা হবে একেবারে যুগান্তকারী পরিবর্তন। সাপের কামড়ের চিকিৎসা পদ্ধতিতেই এক নতুন অধ্যায় শুরু হবে,' বলেন হল।
এদিকে, গবেষণার সহ-লেখক কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কওং জানান, এই গবেষণাটি মূলত এল্যাপিড প্রজাতির সাপের ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল—যেমন কোবরা, মাম্বা ও ক্রাইট। তবে এতে ভাইপারিড গোত্রের সাপ (যেমন র্যাটলস্নেক, স-স্কেল্ড ভাইপার) অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
তবে কওং বলেন, তারা এখন খতিয়ে দেখছেন—ফ্রিডের শরীর থেকে আরও যে অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে, সেগুলো বা অন্য কোনো উপাদান এই ভাইপার গোত্রের সাপের বিরুদ্ধেও কাজ করতে পারে কিনা।
তার ভাষায়, 'আমাদের চূড়ান্ত পরিকল্পনা হলো একটি 'প্যান-অ্যান্টিভেনম ককটেল' তৈরি করা, যা সব ধরনের বিষধর সাপের বিরুদ্ধে কাজ করবে। অথবা এমনও হতে পারে—আমরা দুটি পৃথক অ্যান্টিভেনম তৈরি করব, একটি এল্যাপিডদের জন্য এবং অন্যটি ভাইপারিডদের জন্য, কারণ পৃথিবীর অনেক অঞ্চলে নির্দিষ্ট এক গোত্রের সাপই বেশি দেখা যায়।'
গবেষকরা এখন চাইছেন অস্ট্রেলিয়ায় মাঠপর্যায়ে এই ওষুধের ব্যবহার শুরু করতে, যেখানে শুধুই এল্যাপিড প্রজাতির সাপ আছে। সেখানে ভেটেরিনারিরা এটি সাপের কামড়ে আক্রান্ত কুকুরের চিকিৎসায় ব্যবহার করতে পারবেন।