রোগ ছড়ানোর জন্য শুধু জীবাণু নয়, দায়ী জলবায়ু ও মানুষের আচরণ: আয়েশা মাহমুদের গবেষণা

রোগ ছড়ায় শুধু ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া দিয়ে নয়—মানুষ কীভাবে চলাফেরা করে, চারপাশের আবহাওয়া কেমন, আর সমাজের ভেতরে মানুষের সম্পর্ক কেমন—এসব মিলেই তৈরি হয় রোগের ছড়ানোর পথ।
এই তিনটি বিষয় একসাথে বিবেচনায় রেখে রোগ ছড়ানো নিয়ে গবেষণা করছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেমোগ্রাফির অধ্যাপক আয়েশা মাহমুদ। তিনি তথ্য ও মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করছেন, শহর বা গ্রামে, আর্দ্র বা শুষ্ক আবহাওয়ায়, যোগাযোগপূর্বক বা বিচ্ছিন্ন এলাকায় কীভাবে সংক্রামক রোগ ছড়ায়।
আয়েশা মাহমুদের গবেষণা নিয়ে এমন তথ্য ওঠে এসেছে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলির সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে।
আয়েশা মাহমুদের গবেষণা দলের কাজ হলো এমন মডেল তৈরি করা, যেখানে মানুষের আচরণ, জলবায়ু ও সমাজের তথ্য একসাথে বিশ্লেষণ করে রোগ ছড়ানোর ধারা বুঝে আগেভাগে সতর্ক হওয়া যায়।
বর্তমানে তার গবেষণা দল খতিয়ে দেখছে কীভাবে ব্যক্তিগত আচরণ ও বড় পরিসরের জনসংখ্যাগত চলাচল পরিবেশগত পরিবর্তনের সঙ্গে মিলে রোগের বিস্তারে প্রভাব ফেলে। এর জন্য তারা এমন মডেল তৈরি করছেন, যেখানে জনসংখ্যা, আবহাওয়া আর সামাজিক তথ্য একসাথে বিশ্লেষণ করে রোগ ছড়ানোর গতিপথ বুঝতে পারা যায় এবং সম্ভাব্য হস্তক্ষেপের ফলাফলও অনুমান করা যায়।
এই গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো—শুষ্ক পরিবেশে চিকেনপক্স বেশি ছড়ায়, যা আগে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়নি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—রিয়েল-টাইম মোবাইল ফোনের তথ্য ব্যবহার করলে রোগ কোথায় বাড়ছে, সেটা আগেই বলা সম্ভব।
'আমার কাজের মূল উদ্দেশ্য হলো বিজ্ঞানের প্রয়োগের মাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতে বৈষম্য কমানো ও সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা বাড়ানো,' বলেন মাহমুদ। 'জলবায়ু পরিবর্তনের গতি যেভাবে বাড়ছে, আমাদের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—এই পরিবর্তনের স্বাস্থ্যঝুঁকিগুলো আগেভাগে শনাক্ত ও মোকাবিলা করা।'
আয়েশা মাহমুদের গবেষণা শুধু একটি দেশে নয়—বিভিন্ন মহাদেশে এবং চিকেনপক্স, আরএসভি, কোভিড-১৯ থেকে শুরু করে কলেরার মতো নানা রোগ নিয়ে। তিনি ব্যবহার করছেন আবহাওয়ার তথ্য, মোবাইল ফোনের অবস্থান, আদমশুমারির হিসাব আর মানুষের ডিজিটাল আচরণের ধারা—সব মিলিয়ে রোগ ছড়ানো বোঝার চেষ্টা।
মহামারির প্রথম দিকে তিনি আরেক গবেষক ডেনিস ফিহানের সঙ্গে মিলে 'বার্কলে ইন্টারপারসোনাল কন্ট্যাক্ট স্টাডি' পরিচালনা করেন, যা যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমণ ঝুঁকিতে সামাজিক যোগাযোগ কতটা ভূমিকা রাখে তা বোঝার প্রথম বড় উদ্যোগগুলোর একটি ছিল।
'আমরা দেখেছি বয়স, লিঙ্গ ও জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে যোগাযোগে বিশাল পার্থক্য ছিল—মানুষ কার সঙ্গে কত ঘন ঘন যোগাযোগ করছে, সেটি সংক্রমণের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ,' বলেন তিনি।
কোভিড মহামারির শুরুতে তিনি ডেনিস ফিহান নামের আরেক অধ্যাপকের সঙ্গে 'বার্কলে ইন্টারপারসোনাল কন্ট্যাক্ট স্টাডি' শুরু করেন। এতে দেখা গেছে—বয়স, লিঙ্গ আর জাতিগত পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে মানুষ কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, তার ভিন্নতা রয়েছে, আর সেটাই সংক্রমণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, 'সামাজিক ও পরিবেশগত ধাক্কাগুলো কীভাবে প্রভাবিত করে দুর্বল জনগোষ্ঠীগুলোকে—এই বিষয়টি বোঝা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি।'
আয়েশা মাহমুদের একাডেমিক পথচলা বেশ চমকপ্রদ। প্রথমে তিনি পড়াশোনা করেছেন পদার্থবিজ্ঞানে, আকাশ-জগত নিয়ে গবেষণাও করেছেন। কিন্তু পরে তার আগ্রহ গড়ে ওঠে জনস্বাস্থ্য নিয়ে—মানবসমাজ, জীববিজ্ঞান আর পরিবেশের মিথস্ক্রিয়ায়।
'আমি স্নাতকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে গবেষণা করছিলাম,' বলছিলেন মাহমুদ। 'কিন্তু ধীরে ধীরে আমি টান অনুভব করি জনস্বাস্থ্য আর এই জিজ্ঞাসার প্রতি—মানুষ, পরিবেশ ও জীববিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক কীভাবে কাজ করে।'
এই আগ্রহই তাকে নিয়ে যায় প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেমোগ্রাফিতে পিএইচডি করতে। এরপর হার্ভার্ডে পোস্টডক করেন, যেখানে তার গবেষণার বিষয় ছিল 'প্ল্যানেটারি হেলথ'।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (এনআইএইচ), গেটস ফাউন্ডেশন, সিডিসি এবং মেটা—এই সব সংস্থার অর্থায়নে চলছে তার গবেষণা কার্যক্রম।
উল্লেখ্য, আয়েশা মাহমুদ বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ ও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মেয়ে।