অপারেশন থিয়েটারে রোবট: ভবিষ্যতে শল্যচিকিৎসায় মানুষের জায়গা নিতে পারে যন্ত্র

চার দশক আগে ডিফেন্স এডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি (ডারপা) ও নাসা এমন এক প্রযুক্তির খোঁজে উদ্যোগ নেয়, যা যুদ্ধক্ষেত্র কিংবা মহাকাশে দূর থেকে অস্ত্রোপচার করার সুযোগ দেবে। সেই প্রচেষ্টার ফলেই জন্ম নেয় 'দা ভিঞ্চি'র মতো রোবটিক সার্জারি সিস্টেম, যা বাস্তব চিকিৎসকের নির্দেশ মেনে দূর থেকে কাজ করে। তবে এখন পর্যন্ত এসব যন্ত্র পুরোপুরি মানবনির্ভর, সার্জনের নির্দেশে চলে।
কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, এই নির্ভরতা ভবিষ্যতে আর নাও থাকতে পারে। জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিংয়ের সংযোজনে এমন রোবটিক সিস্টেম তৈরি হচ্ছে, যা মানুষের সহায়তা ছাড়াই জটিল অস্ত্রোপচার করতে সক্ষম।
গত বুধবার প্রকাশিত সাইন্স রোবটিকস জার্নালের এক গবেষণায় জন হপকিন্স ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এমন এক রোবট সিস্টেম উপস্থাপন করেছেন, যেটি মানব সার্জনের ভিডিও দেখে শিখেছে এবং স্বাভাবিক ভাষায় নির্দেশ গ্রহণ করে অস্ত্রোপচারের বিভিন্ন ধাপ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করতে পারে।
গত বছর জন হপকিন্স দলের গবেষক অ্যাক্সেল ক্রিয়েগার রোবটটিকে তিনটি মৌলিক সার্জারি কাজ শেখান—সুঁই ধরা, টিস্যু তুলা ব্যবহার ও সেলাই করা। এতে ব্যবহার করা হয় চ্যাটজিপিটির মতো ইমিটেশন লার্নিং প্রযুক্তি, যদিও এখানে ভাষার বদলে রোবটিক অ্যাকশন অংকে রূপান্তরিত হয়।
নতুন গবেষণায়, দুইজন অভিজ্ঞ মানব সার্জন শূকরের টিস্যুতে গলব্লাডার বা পিত্তথলি অপসারণের নির্দেশনা দেন, যাতে ৩৪টি অপারেশন থেকে ১৭ ঘণ্টার ডেটা সংগ্রহ করা হয়। এই ডেটা বিশ্লেষণ করে রোবট নিজেই নতুন ৮টি অচেনা গলব্লাডার থেকে কিছু ধাপ সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করে, যেমন নির্দিষ্ট নালি ও ধমনি শনাক্ত, ক্লিপ স্থাপন ও কাঁচি দিয়ে কাটা। এমনকি রোবটটি ভুল ধরতে ও তা সংশোধন করতেও সক্ষম হয়।
২০২২ সালেও একই দল একটি জীবন্ত শূকরের শরীরে প্রথমবারের মতো স্বয়ংক্রিয় ল্যাপারোস্কোপি করে। তবে সে সময়ে পরিবেশ ছিল নিয়ন্ত্রিত, টিস্যুতে ছিল বিশেষ মার্কার। গবেষক ক্রিয়েগারের ভাষায়, তখনকার রোবট ছিল 'ম্যাপ করে দেওয়া রাস্তায় গাড়ি চালানো'র মতো। আর এবারের রোবট সে রাস্তা না চিনেও চালাতে পেরেছে, যেটি আরও এক ধাপ অগ্রগতি।
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন। হিউম্যান অ্যানাটমি অধ্যাপক ফ্রান্সিসকো ক্লাসকা বলেন, "এটা খুব সাধারণ সার্জারি, আর প্রাণীগুলোর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও বয়স অনুযায়ী তেমন জটিল ছিল না। ৬০–৭০ বছর বয়সী রোগীদের উপর অপারেশনের মতো জটিলতা এতে ছিল না।"
স্পেনের মারানোন জেনারেল হাসপাতালের সার্জারি প্রধান মারিও ফের্নান্দেজ বলেন, "এটা যতই প্রযুক্তিগত অগ্রগতি হোক, মানব চিকিৎসকের বিকল্প হওয়ার পথ অনেক দীর্ঘ। প্রযুক্তির মুগ্ধতায় পড়ে বাস্তব উপকারিতা না বুঝে এগোনো ঠিক নয়।"
তিনি উদাহরণ টানেন, "ভারতের এক হাসপাতালে একটি রোবট আছে, তারা বছরে মাত্র ৪৮টি সার্জারি করতে পারে। রোবটিকস সেখানে সার্জারি শিক্ষা ও চর্চার উপায় হতে পারে, কিন্তু সাধারণ রোগীদের উপর প্রয়োগের জন্য নয়।"
অন্যদিকে ক্রিয়েগারের মতে, এই গবেষণা প্রমাণ করে যে জটিল অস্ত্রোপচার স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা সম্ভব এবং শেখার এই পদ্ধতি ভবিষ্যতে আরও ধরনের অস্ত্রোপচারে কাজে লাগানো যাবে।
তবে স্প্যানিশ সার্জন হোসে গ্রানেল সতর্ক করেন, "বায়োলজিক্যাল টিস্যুর বৈচিত্র্য এত বেশি যে সব সময় একই নিয়মে কাজ হয় না। হাড় কাটতে বলা রোবটের জন্য সহজ, কিন্তু নরম টিস্যুতে সব সময় ঠিক একই রকম প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় না।"
আর সবচেয়ে গভীর দিকটি তুলেন ধরেন তিনি-আইজ্যাক অ্যাসিমভের রোবটিক্স নীতির প্রসঙ্গ টেনে: "একজন সার্জন অনেক সময় জানেন যে কোন কাজে ক্ষতি হলেও সেটা রোগীর মঙ্গলের জন্য দরকার। কিন্তু রোবট কি এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে?" তার মতে এই প্রশ্নটিই ভবিষ্যতের স্বয়ংক্রিয় সার্জারির নৈতিক ও প্রযুক্তিগত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।