মানব শুক্রাণু ও ডিম্বাণুতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা
চুলের চেয়েও সরু ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণাগুলো এখন রক্তসহ মানবদেহের এমন সব অপ্রত্যাশিত জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে, যা আগে আমাদের ভাবনারও বাইরে ছিল।
ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব হিউম্যান রিপ্রোডাকশন অ্যান্ড এমব্রায়োলজির সম্মেলনে উপস্থাপিত তথ্য বলছে, নারীর ডিম্বাণুর চারপাশ ও পুরুষের শুক্রাণুর সঙ্গে যে এক ধরনের তরল থাকে, সেই তরলে এসব ক্ষুদ্র কণার উপস্থিতি দেখা গেছে।
স্পেনের নেক্সট ফার্টিলিটি মুর্সিয়ার ড. এমিলিও গোমেজ-সানচেজের নেতৃত্বে পরিচালিত গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় বিজ্ঞানীরা ২৯ জন নারীর ফলিকুলার ফ্লুইড ও ২২ জন পুরুষের সেমিনাল ফ্লুইড পরীক্ষা করেন।
পরীক্ষায় দেখা যায়, নারীদের ৬৯ শতাংশ এবং পুরুষদের ৫৫ শতাংশের নমুনায় মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি দেখা গেছে।
গবেষণায় বিজ্ঞানীরা নারী ও পুরুষের নমুনায় পলিটেট্রাফ্লুওরোইথিলিন (পিটিএফই) ও পলিপ্রোপিলিনের (পিপি) মতো পলিমারের উপস্থিতি শনাক্ত করেন, যা সাধারণত নন-স্টিক ফ্রাই প্যান ও খাদ্য মোড়ানোর প্যাকেট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
ড. গোমেজ-সানচেজ জানান, মাইক্রোপ্লাস্টিকের এই উপস্থিতি দেখে তারা বিস্মিত। গবেষকরা বলছেন, এটা সত্যিই ঝুঁকিপূর্ণ।
২০২১ সালে ইতালির কিছু স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ প্রতিটি গর্ভনালিতে গড়ে ১২টি প্লাস্টিক কণা পেয়েছিলেন। যা প্রমাণ করে, পাঁচ মিলিমিটারের ছোট কণাগুলো মাতৃ-ভ্রূণ সীমানা ভেদ করতে পারে।
অনুরূপ প্লাস্টিক কণা অস্ত্রোপচারের সময় ফুসফুসের টিস্যু থেকেও পাওয়া গেছে। এ থেকে স্পষ্ট যে শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে প্লাস্টিক ধূলিকণা শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
যেভাবে এসব প্লাস্টিক কণা মানবদেহে প্রবেশ করে
সাধারণত খাবার, পানি পান ও শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে। এই কণা অত্যন্ত ক্ষুদ্র। তাই তা হজমনালি বা ফুসফুসের পাতলা ঝিল্লি ভেদ করে ঢুকে যেতে পারে।
প্রাণীর ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, এক মাইক্রোমিটারের কম আকারের কণা কোষে সরাসরি প্রবেশ করতে পারে। বড় কণাগুলো শরীরের টিস্যুতে আটকে গিয়ে প্রদাহ সৃষ্টি করে।
ইঁদুরের ওপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, যখন মাইক্রোপ্লাস্টিক চর্বির সঙ্গে মিশে থাকে, তখন তা হজমনালি দিয়ে শরীরে প্রবেশের হার বেড়ে যায়।
বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন, এসব কণায় সংস্পর্শে আসা ইঁদুরগুলো এমন শুক্রাণু তৈরি করেছে, যার ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত এবং গতিশীলতাও কম। এর কারণ হিসেবে গবেষকরা দেখেছেন, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে ফেলে।
রডেন্ট লেইডিগ কোষ নিয়ে আলাদা এক গবেষণায় দেখা গেছে, ন্যানোপ্লাস্টিকের সংস্পর্শে মাইটোকন্ড্রিয়া সংকুচিত হয়ে পড়ে, ফলে টেস্টোস্টেরনের উৎপাদন কমে যায়।
২০২৪ সালে প্রকাশিত কয়েকটি পর্যালোচনা প্রবন্ধে বলা হয়, মাইক্রোপ্লাস্টিক হাইপোথ্যালামাস‑পিটুইটারি‑গোনাডাল অক্ষকে ব্যাহত করতে পারে, ফলে হরমোন ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং ডিম্বাণু পরিপক্বতা সঠিকভাবে হয় না। কারণ, মানব ডিম্বাণু গঠনে কয়েক মাস সময় লাগে, তাই স্বল্পমেয়াদী নয়, দীর্ঘমেয়াদি প্লাস্টিকের সংস্পর্শই বেশি প্রভাব ফেলতে পারে।
ডিম্বাণু ও শুক্রাণুতে প্লাস্টিকের মাত্রা নিয়ে সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, পরীক্ষিত ডিম্বাণুর তরলে ৩১ শতাংশ ক্ষেত্রে, আর শুক্রাণুর নমুনায় ৪১ শতাংশ ক্ষেত্রে পিটিএফই পাওয়া গেছে। নারীদের নমুনায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উপস্থিতি ছিল পলিপ্রোপিলিন। আর পুরুষদের ক্ষেত্রে পলিস্টাইরিন। আরও পাওয়া গেছে পলিইথিলিন টেরিফথ্যালেট। তবে এর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।
