‘ডায়ার ওলফ’-এর পুনর্জন্ম ঘটেনি, এটি ‘সংকর’ প্রজাতির নেকড়ে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা

টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে জায়গা করে নিয়েছে এক অপূর্ব, বরফ-সাদা রঙের নেকড়ে। শিরোনামে লেখা—'ডায়ার ওলফ'-এর প্রত্যাবর্তন!
'গেম অব থ্রোনস'-এর জনপ্রিয় চরিত্র হিসেবে বহুল পরিচিত এই প্রজাতি আদতে বাস্তবেও ছিল। ১০ হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে এটি উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাজুড়ে বিচরণ করত। তবে বাস্তবে এখন এটি বিলুপ্ত।
এই নতুন জন্ম দেওয়া নেকড়েগুলোর পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান কলোসাল বায়োসায়েন্সেস। তারা দাবি করেছে, প্রাচীন ডিএনএ এবং উন্নত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে তারা তিনটি 'ডায়ার ওলফ' শাবকের জন্ম দিয়েছে—যাদের নাম রাখা হয়েছে রোমুলাস, রেমাস ও খালিসি।
তবে এই প্রযুক্তিগত অগ্রগতি যতই চোখধাঁধানো হোক না কেন, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলো প্রকৃত অর্থে ডায়ার ওলফ নয়।
নিউজিল্যান্ডের ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞানী ফিলিপ সেডন বলেন, 'এগুলো মূলত জেনেটিকভাবে পরিবর্তিত ধূসর নেকড়ে।'
কলোসাল আগেও দাবি করেছিল, তারা বিলুপ্ত উলি ম্যামথ এবং তাসমানিয়ান টাইগারকেও ফিরিয়ে আনার প্রকল্পে কাজ করছে।
এদিকে প্রাণীবিজ্ঞানীরা বলছেন, টাইম ম্যাগাজিনের কাভারে যে প্রাণী দেখা যাচ্ছে, তা আসল ডায়ার ওলফ থেকে অনেকটাই আলাদা।
ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালিওজেনেটিক বিশেষজ্ঞ ড. নিক রলেন্স জানান, প্রকৃত ডায়ার ওলফের জীবাশ্ম থেকে সংগৃহীত ডিএনএ এতটাই নষ্ট ও খণ্ডিত যে, তা দিয়ে সরাসরি ক্লোন তৈরি করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, 'প্রাচীন ডিএনএ এমন, যেন আপনি তাজা ডিএনএকে ৫০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাতে রেখে এসেছেন। সেটা বের হয়ে আসে ধুলো আর টুকরো হয়ে।'
এই পরিস্থিতিতে গবেষকেরা নতুন ধরনের সিন্থেটিক বায়োলজির সহায়তায় ডায়ার ওলফের কিছু নির্দিষ্ট জিন শনাক্ত করেন, যেগুলো ধূসর নেকড়ের জেনেটিক ব্লুপ্রিন্টে সম্পাদনা করে ঢোকানো হয়।
ড. রলেন্স বলেন, 'কলোসাল যে প্রাণী তৈরি করেছে, তা একটি ধূসর নেকড়ে, যার কিছু ডায়ার ওলফ সদৃশ বৈশিষ্ট্য রয়েছে—যেমন বড় খুলি ও সাদা রঙের লোম। এটি এক ধরনের হাইব্রিড (সংকর)।'
কলোসাল-এর জৈবপ্রযুক্তিবিদ ড. বেথ শ্যাপিরো অবশ্য বলছেন, এটাই ডি-এক্সটিংশন বা বিলুপ্ত প্রাণীর পুনর্জন্ম।
তার ভাষায়, 'ধূসর নেকড়ে হলো ডায়ার ওলফের সবচেয়ে কাছাকাছি জীবিত জাত। তাই আমরা ডায়ার ওলফের বৈশিষ্ট্য যুক্ত কিছু নির্দিষ্ট ডিএনএ অংশ টার্গেট করে ধূসর নেকড়ের কোষে পরিবর্তন করেছি, এরপর সেই কোষগুলো ক্লোন করে তৈরি করেছি আমাদের ডায়ার ওলফ।'
তবে ড. রলেন্স মনে করিয়ে দেন, ডায়ার ওলফ ও ধূসর নেকড়ে একে অপর থেকে বিবর্তিত হয়েছে প্রায় ২৫ থেকে ৬০ লক্ষ বছর আগে।
তার ভাষায়, 'এগুলো একেবারে ভিন্ন জেনাসে পড়ে। কলোসাল নিজেই বলেছে, ডায়ার ওলফ ও ধূসর নেকড়ের ১৯ হাজার জিন বিশ্লেষণ করে তারা ১৪টি জিনে ২০টি পরিবর্তন করেছে।'
এই সম্পাদিত ভ্রূণগুলো গর্ভধারণে ব্যবহার করা হয়েছিল ঘরোয়া বড় জাতের কুকুরকে। টাইম ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, তিনটি শাবকই পরিকল্পিত সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে জন্মেছে, জটিলতা এড়াতে। ২ হাজার একর জায়গাজুড়ে গোপন এক জায়গায় এসব শাবকগুলোকে এখন রাখা হয়েছে।
এই নতুন শাবকগুলো দেখতে অনেকটাই অনেকের কল্পনার ডায়ার ওলফের মতো। তবে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিষয়টি আসলে কী তা বোঝাটা গুরুত্বপূর্ণ।
ড. রলেন্স বলেন, 'কারণ একবার কোনো প্রাণী সত্যিকার অর্থে বিলুপ্ত হয়ে গেলে, সেটা চিরতরের জন্যই হারিয়ে যায়।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা যদি ভাবি যে প্রযুক্তির সাহায্যে আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব, তাহলে কি আমরা আমাদের পরিবেশকে বিনষ্ট করতে দ্বিধা করব? এই বার্তাই কি ছড়িয়ে পড়বে—যে প্রাণী বিলুপ্ত হলেও ক্ষতি নেই, আমরা তো আবার ফিরিয়ে আনতে পারি?'