ডোডো পাখি ও ডায়ার নেকড়ে

বছর দুই আগের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের 'কলোসাল বায়োসায়েন্সেস কোম্পানি' ঘোষণা করল যে অচিরে ডোডো পাখি, লোমশ ম্যামথ ইত্যাদি কয়েকটি বিলুপ্ত প্রাণী নতুন করে 'সৃষ্টি' বা 'তৈরি' করা হবে। কলোসালের বিজ্ঞানীরা বললেন, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নবলব্ধ কৌশল ব্যবহার করে শত শত বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া পাখির ছানা ও পশুর শাবক তৈরি করা যাবে। অনন্য সেই উদ্যোগের নাম দেওয়া হল 'ডি-এক্সটিঙ্কশন'।
ডি-এক্সটিঙ্কশন একটি বানানো শব্দ; এতে বোঝানো হয়েছে এক্সটিঙ্কশনের উল্টো প্রক্রিয়া। ডি-এক্সটিঙ্কশনের বাংলা হতে পারে 'অ-বিলুপ্তি'। বিশ্বে কোনো প্রজাতির শেষ সদস্যটি মারা গেছে বলে অকাট্য প্রমাণ পেলে বলা হয় যে প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়েছে। সেই বিলুপ্ত প্রজাতির নব্য সদস্য বলে মোটামুটিভাবে গ্রহণ করা যায় এমন একটি প্রাণী নতুন করে সৃষ্টি বা তৈরি করা গেলে সেই প্রক্রিয়ার নাম হবে ডি-এক্সটিঙ্কশন।
ডি-এক্সটিঙ্কশন কিন্তু রিভাইভাল, রেসারেকশন বা পুনরুত্থান নয়। একটি মৃত প্রাণী জীবিত হয়ে উঠলে তাকে পুনরুত্থান বলা যায়। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসাশাস্ত্রের কিংবা অলৌকিক শক্তির ভূমিকা থাকতে পারে কিন্তু জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভূমিকা নেই। ডি-এক্সটিঙ্কশনে কোনো মৃতদেহ জীবিত হয়ে উঠবে না; বরং মৃত জীবের জেনেটিক পদার্থ ব্যবহার করে সেই হারিয়ে যাওয়া প্রাণীর আদলে নতুন জীব তৈরি হবে। একই কারণে কোনো প্রাণীকে 'ক্লোন' করাও ডি-এক্সটিঙ্কশন নয়। ক্লোন করা হয় শুধু জীবিত প্রাণীর; বিলুপ্ত প্রাণীর তো নয়।
তাই ক্লোন করা মানেই ডি-এক্সটিঙ্কশন নয়; যদিও মহা-বিপন্ন কোনো প্রাণীর ক্লোন করাকে সম্ভাব্য বিলুপ্তি রোধের পথে শক্তিশালী পদক্ষেপ বলে গণ্য হতে পারে। একবার 'পাইরেনীয় আইবেক্স' নামের একটি পাহাড়ি ছাগল ক্লোন করে তার বিলুপ্তি রোধের চেষ্টা করা হয়েছিল। মৃত্যুর আগে পৃথিবীর শেষ পাইরেনীয় আইবেক্সের দেহ থেকে কোষ সংগ্রহ করে বিজ্ঞানীরা তা ভ্রূণে রূপান্তরিত করেছিলেন। সেই ভ্রূণ প্রায় পাঁচ ডজন ছাগলের গর্ভে স্থাপন করার পর মাত্র একটি শাবকের জন্ম হয়েছিল। শাবকটি কয়েক মিনিট পর মারা গেলে পাইরেনীয় আইবেক্স প্রজাতিটি পৃথিবীতে দ্বিতীয়বারের মতো বিলুপ্ত হয়েছিল।

কলোসাল আয়োজিত ডি-এক্সটিঙ্কশনের প্রধান 'ক্যান্ডিডেট' বা 'টার্গেট' ছিল অধুনা বিলুপ্ত ডোডো পাখি। ডোডো পাখির বসবাস ছিল মরিশাস দ্বীপে। ৮০ লক্ষ বছর আগে ভারত মহাসাগরের মাঝে মরিশাস দ্বীপ জেগে উঠলে সেখানে উদ্ভিদ ও প্রাণীর বসতি শুরু হয়। আমাদের এই পূর্ব-এশিয়া থেকে কিছু পাখি উড়ে গিয়ে নবীন মরিশাস দ্বীপে বসবাস শুরু করে। জনহীন দ্বীপে কয়েক প্রজাতির পাখি ওড়ার ক্ষমতাটুকু বিসর্জন দিয়ে উটপাখির মতো মাটিতে হেঁটে চমৎকার টিকে ছিল। তার মধ্যে আজ আমরা জানি শুধু ডোডো পাখিকে। মরিশাস দ্বীপের বনভূমি সম্প্রসারণে ফলাহারী সেই ডোডো পাখির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৬ শতকে ডাচ্ নাবিকেরা মরিশাস দ্বীপে যাতায়াত শুরু করলে তাদের মাধ্যমেই বিশ্ব জানতে পারে ডোডো পাখির কথা। কিন্তু মানুষের সাথে মরিশাস দ্বীপে চলে আসে কুকুর, বিড়াল, ইঁদুর, শূকর ইত্যাদি অনেক প্রাণী। ওই সব প্রাণী ও মানুষের কবল থেকে আত্মরক্ষা করার দক্ষতা অর্জনের আগেই ডোডো পাখির দিন ঘনিয়ে আসে। ডাচ্ নাবিকেরা ডোডো পাখি আবিষ্কারের ৮০ বছরের মধ্যেই শেষ পাখিটি মারা যায়।
২০২২ সালে কলোসালের বিজ্ঞানীরা বিলুপ্ত ডোডো পাখির ছানা জন্মানোর পরিকল্পনা করলেন। জাদুঘরে রাখা ডোডোর মৃতদেহ ও ডিম নিয়ে পাখিটির জিন-তালিকা তৈরি হলো। কিন্তু জিন-তালিকা থেকেই তো আর ছানা হয় না। মৃত প্রাণীর দেহকোষ থেকে জিন-তালিকা তৈরি করা যায়; কিন্তু জীবিত কোষ তৈরি করা যায় না। ছানা তৈরি করতে হলে একটি জীবিত কোষ লাগবেই। ক্লোন-প্রযুক্তি সহজসাধ্য হওয়ার কারণে কোষকে ভ্রূণে রূপান্তরিত করা আজ আর কঠিন নয়। একটি জীবিত কোষ নিয়ে তাতে ডোডোর জিন প্রতিস্থাপন করে তা থেকে ভ্রূণ তৈরি করলেই তো ডোডোছানা হতে পারে। ভরসা এই যে ক্রিস্পার পদ্ধতি এখন জিন কেটে জোড়া লাগানোর কাজটিও সহজ করে দিয়েছে।
তা সত্ত্বেও ডি-এক্সটিঙ্কশন একটি দুঃসাধ্য কাজ। একটি কোষে কোটি কোটি জিন থাকে বলে একটি প্রাণীর পুরো জিন প্রতিস্থাপন করতে অত্যন্ত দীর্ঘ সময় লাগে। তাই ডোডো পাখির সাথে জিনের সবচেয়ে বেশি মিল আছে এমন একটি জীবিত প্রাণীর কোষ নিয়ে কাজ করতে হবে। ডোডো পাখির নিকটাত্মীয় 'নিকোবার পায়রা' ভারতবর্ষে আজও টিকে আছে। কলোসালের বিজ্ঞানীরা তাই নিকোবার পায়রার জিন-তালিকা প্রস্তুত করলেন।
এবার নিকোবার পায়রার কোষে ডোডো পাখির অমিল জিনগুলো প্রতিস্থাপন করে তা থেকে ভ্রূণ তৈরি করতে হবে। ভ্রূণ তৈরি করার পর নিকোবার পায়রা অথবা গৃহপালিত পায়রাকে মাতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া যাবে এবং তার ডিম থেকে ছানা হলে তা ডোডো পাখির রূপ পাবে।

ডোডো পাখির ছানা তৈরির এই পরিকল্পনা কিন্তু পদে পদে বাধাগ্রস্ত হতে থাকল। দেখা গেল, মমি করা একটি মাথা, একটি পা ও কিছু ডিমের খোসা ছাড়া ডোডো পাখির ডিএনএ সংগ্রহ করার আর কোনো উৎস নেই। ডিএনএ তো চিরস্থায়ী কোনো বস্তু নয়; ৫২১ বছরের বেশি নয় এর অর্ধজীবন। যত দিন যায়, ডিএনএ ততই কমে যেতে থাকে। ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হলেও ডিএনএ দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। তার চেয়ে বড় কথা, ডিমের মধ্যে পরিবর্তিত ডিএনএ ইমপ্ল্যান্ট করা প্রায় অসম্ভব; এবং ডিম থেকে জন্ম হয় এমন প্রাণী ক্লোন করাটাও দুঃসাধ্য কাজ।
ডোডো পাখির ছানা তৈরির দুঃসাধ্য প্রকল্প স্থগিত রেখে বিজ্ঞানীরা তাই বিলুপ্ত কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর শাবক তৈরির সহজতর কাজ হাতে নেওয়ার সংকল্প করলেন। তাদের ডি-এক্সটিঙ্কশনের নতুন টার্গেট হল ১০-১২ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া 'ডায়ার উলফ' নামের এক নেকড়ে। 'ডায়ার নেকড়ে' নির্বাচন করার বড় দুটি কারণ ছিল। প্রথম কারণ, ডায়ার নেকড়ের সাথে জিনগত মিল রয়েছে এমন একটি প্রজাতি 'গ্রে উলফ' যুক্তরাষ্ট্রে এখনো 'সুলভ' বলে আখ্যায়িত। এই গ্রে উলফ বা কালচে নেকড়ের কোষে জিন পরিবর্তন করে ডায়ার নেকড়ের কোষ ও ভ্রূণ তৈরি করা সম্ভব। দ্বিতীয় কারণ, নবীন নেকড়ে শাবক টিকিয়ে রাখার মতো প্রতিবেশ খুঁজতে কোনো দূর-দেশে যেতে হবে না; কলোসাল বায়োসায়েন্সেস কোম্পানির নিজ দেশ যুক্তরাষ্ট্রেই তা পাওয়া যাবে।
কলোসাল বায়োসায়েন্সেস কোম্পানির বিজ্ঞানীদের এই পরিকল্পনা সম্প্রতি সফল হয়েছে। ২০২৪ অক্টোবর থেকে ২০২৫ জানুয়ারির মধ্যে তারা তিনটি ডায়ার নেকড়ে শাবক তৈরি করেছেন। কালচে নেকড়ের পরিবর্তিত জিন থেকে ৪৫টি ভ্রূণ বানিয়ে আটটি গৃহপালিত কুকুরের গর্ভে দেওয়া হয়েছিল। সেই কুকুরের গর্ভ থেকে তিনটি নেকড়ে শাবক পাওয়া গেছে। নবীন এই নেকড়ে শাবকের জিন ৯৯.৫% একদা বিলুপ্ত ডায়ার নেকড়ের বলে বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন। দুই হাজার একরের একটি 'ইকোলজিক্যাল প্রিজার্ভে' পশু চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের নজরদারিতে শাবক তিনটি বড় হচ্ছে।

এখন কথা হলো, বিজ্ঞানীদের এই সাফল্যকে কি সত্যিই ডি-এক্সটিঙ্কশন বলা যায়! আমেরিকার প্রকৃতিতে কি সত্যিই আবার ডায়ার নেকড়ে ফিরে আসবে? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো: না; ১২,০০০ বছর আগে ডায়ার নেকড়েগুলো উত্তর আমেরিকার প্রকৃতিতে যেসব কাজে আসত; তার প্রায় কিছুই করতে পারবে না কুকুরের পেটে জন্মানো এবং পশু চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের নজরদারিতে বেড়ে ওঠা নেকড়ে শাবক। নতুন নেকড়ে শাবক একদিন সেই বিলুপ্ত ডায়ার নেকড়ের ১০০% জিন নিয়ে জন্মালেও তা পারবে না। তার কারণ, প্রকৃতিতে ডায়ার নেকড়ের কর্মকাণ্ড পুরোটাই তো জিন-নির্ধারিত ছিল না; অনেকটাই ছিল পুরুষানুক্রমে উদ্ভব হওয়া এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শিখে নেওয়া জীবনপদ্ধতির অঙ্গ।
নিশ্চয়ই অভিনব এই তিনটি নেকড়ে শাবকের জন্য ডিজনিল্যান্ডের মতো নকল আবাস গড়ে বিপুলসংখ্যক দর্শক আকর্ষণ করা যাবে; কিন্তু পরিবেশ কিংবা প্রজাতি রক্ষায় বড় অবদান রাখার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে কলোসাল কোম্পানির বিজ্ঞানীদের কাজে প্রযুক্তিগত যে সাফল্য অর্জিত হয়েছে, তা ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। এই সাফল্য ১৯৯৭ সালে 'ডলি' নামক ভেড়া ক্লোন করার মতোই সম্ভাবনাময়। স্তন্যপায়ী প্রাণী ক্লোন করাটাকে দুই দশকের মধ্যে মানুষ বহুবিধ কাজে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। কলোসাল বায়োসায়েন্সেস কোম্পানি উদ্ভাবিত এই নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে ভবিষ্যতে মানুষ কত রকমের সেবা পাবে, তা আমরা শুধু অনুমান করতে পারি। সম্ভবত সেই সব সেবার মধ্যে সবচেয়ে কম আত্মগরিমাধর হবে ডি-এক্সটিঙ্কশন।