সাড়ে ১২ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া ডায়ার ওলফের ‘পুনর্জন্ম’ ঘটালেন বিজ্ঞানীরা

এইচবিও'র টিভি সিরিজ 'গেম অব থ্রোনস' যারা দেখেছেন তাদের নিশ্চয়ই ডায়ার ওলফের (সাদা নেকড়ে) কথা মনে আছে। হাউজ স্টার্কের প্রতীক ছিল এটি। নেড স্টার্কের প্রতিটি সন্তানের সঙ্গী ছিল একটি করে ডায়ার ওলফ—এটি শুধু তাদের পোষা প্রাণী নয়, বরং ছিল তাদের নির্ভরযোগ্য রক্ষাকবচ।
প্রাগৈতিহাসিক এই ভয়ংকর শ্বেত বা সাদা নেকড়ে এতদিন শুধু কাল্পনিক জগতে থাকলেও এবার বাস্তবে তাদের 'পুনর্জন্ম' ঘটিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। প্রায় ১২,৫০০ বছর আগে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ডায়ার ওলফকে আবারও ফিরিয়ে এনেছে যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসভিত্তিক বায়োটেক প্রতিষ্ঠান কলোসাল বায়োসায়েন্স। তারা দাবি করেছে, এটি পৃথিবীর প্রথম সফলভাবে পুনর্জীবিত হওয়া বিলুপ্ত প্রাণী।
প্রতিষ্ঠানটি সোমবার জানায়, ডায়ার ওলফের কাছাকাছি জীবিত গোত্রের গ্রে ওলফের (ধূসর নেকড়ে) ডিএনএ পরিবর্তন করে তিনটি ডায়ার ওলফ শাবকের জন্ম দিয়েছে তারা। এই গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছে প্রাচীন ডিএনএ, ক্লোনিং ও জিন-সম্পাদনা প্রযুক্তি। এর ফলে জন্ম নেওয়া শাবকগুলো দেখতে বিলুপ্ত ডায়ার ওলফের মতো হলেও তারা মূলত এক ধরনের হাইব্রিড বা সংকর প্রজাতি।
ডায়ার ওলফ (এনোকিওন ডিরাস) ছিল উত্তর আমেরিকার শীর্ষ শিকারি প্রাণী। এর ভীতিকর চেহারাই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে জনপ্রিয় এইচবিও সিরিজ 'গেম অব থ্রোনস'-এর কল্পিত ডায়ার ওলফ চরিত্রে। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, এই সাদা নেকড়ে ধূসর নেকড়ের চেয়ে আকারে বড়, মাথা চওড়া, মোটা লোমে ঢাকা ও চোয়াল অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল।
বায়োটেক প্রতিষ্ঠান কলোসাল ২০২১ সাল থেকে বিলুপ্ত ম্যামথ, ডোডো এবং তাসমানীয় বাঘ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে। তবে ডায়ার ওলফ নিয়ে তাদের কাজ এতদিন গোপন ছিল।

কলোসাল জানায়, ১৩ হাজার বছর পুরোনো একটি দাঁত ও ৭২ হাজার বছর পুরোনো একটি খুলি থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে তারা জিনগত পরিবর্তন সাধন করেছে। এরপর সেরা কোষগুলোর ক্লোন তৈরি করে তা গর্ভধারণের জন্য ব্যবহার করা হয়। গর্ভধারণে ব্যবহার করা হয়েছিল ঘরোয়া বড় জাতের কুকুরকে।
প্রতিষ্ঠানটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী বেন ল্যাম এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, 'এটি আমাদের ডি-এক্সটিংকশন প্রযুক্তির প্রথম বড় মাইলফলক। আমাদের দল ১৩ হাজার বছর পুরোনো একটি দাঁত এবং ৭২ হাজার বছর পুরোনো একটি খুলি থেকে ডিএনএ নিয়ে সুস্থ ডায়ার ওলফ শাবক তৈরি করেছে।'
এখন এই তিনটি শাবক বসবাস করছে এক গোপন স্থানে, ২ হাজার একরের একটি নিরাপদ এলাকায়। ১০ ফুট উঁচু বেড়ায় ঘেরা সেই এলাকায় রয়েছে আধুনিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা, প্রহরী ও ড্রোন নজরদারি। কলোসাল জানায়, এই স্থাপনাটি আমেরিকান হিউম্যান সোসাইটির স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এবং মার্কিন কৃষি বিভাগের নিবন্ধিত।
নেকড়ের জীবাশ্ম আর প্রাচীন ডিএনএ
দুইটি ডায়ার ওলফের জীবাশ্ম থেকে সংগ্রহ করা প্রাচীন ডিএনএ ব্যবহার করে উচ্চমানের দুটি এনোকিওন ডিরাস (ডায়ার ওলফ) জিনোম তৈরি করতে সক্ষম হন কলোসাল বায়োসায়েন্স-এর বিজ্ঞানীরা ও তাদের সহযোগীরা।
এই জিনোম বিশ্লেষণ করে তারা জীবিত কানিড প্রজাতি—যেমন ধূসর নেকড়ে, শিয়াল ও শৃগালের সঙ্গে তুলনা করেন, যাতে ডায়ার ওলফের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জিনগত পার্থক্যগুলো শনাক্ত করা যায়। এর মধ্যে সাদা রঙের পশম, দীর্ঘ ও ঘন লোমসহ কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ছিল।
এরপর ধূসর নেকড়ের কোষে মোট ১৪টি জিনে ২০টি পরিবর্তন আনা হয়, যেগুলোর মাধ্যমে ডায়ার ওলফের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়। এই সম্পাদিত কোষগুলো থেকে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় কোষরেখা নির্বাচন করে তা ডোনার ডিম্বাণুতে প্রতিস্থাপন করা হয়।

বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে গর্ভধারণের জন্য পরবর্তীতে এই ভ্রূণগুলো প্রতিস্থাপন করা হয় উপযুক্ত 'সারোগেট'-এর শরীরে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে তিনটি সফল গর্ভধারণের মাধ্যমে জন্ম নেয় বিলুপ্ত প্রাণীর প্রথম জীবন্ত শাবকেরা।
কলোসাল জানিয়েছে, এই সারোগেট হিসেবে তারা ব্যবহার করেছে বড় জাতের মিশ্র প্রজাতির গৃহপালিত কুকুর।
২০২৪ সালের ১ অক্টোবর জন্ম নেয় দুটি পুরুষ ডায়ার উলফ শাবক, আর ২০২৫ সালের ৩০ জানুয়ারি জন্ম নেয় একটি মেয়ে শাবক।

বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর পুনরুজ্জীবনের জন্য জিন সম্পাদনা
কলোসাল বায়োসায়েন্সেস কোম্পানি মূলত সিআরআইএসপিআর প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি হাইব্রিড জিনোম তৈরি করেছে, যার মাধ্যমে ধূসর নেকড়ের কিছু জিন ভ্যারিয়েন্ট কেটে ফেলে এবং সেগুলোর স্থানে ডায়ার ওলফের বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্য দায়ী জিনগুলো প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, এমনটাই জানিয়েছেন স্টকহোম ইউনিভার্সিটির প্যালিওজেনেটিক্স বিভাগের উন্নয়নশীল জেনোমিক্সের অধ্যাপক লভ ডালেন, যিনি কলোসালের পরামর্শক।
ডালেন বলেন, 'এটা স্পষ্ট যে, পুরো জিনোমের ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ ধূসর নেকড়ের, তবে এই পরিবর্তনগুলো কতটা প্রয়োজনীয়, সেটি নিয়ে বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের মধ্যে আলোচনা হতে পারে। তবে এটি আসলে একটি দার্শনিক প্রশ্ন।'
তিনি আরও বলেন, 'এতে ডায়ার ওলফের জিন রয়েছে, এবং এই জিনগুলো এটিকে ডায়ার ওলফের মতো দেখতে বানিয়েছে, যা আমরা গত ১৩ হাজার বছরে কখনও দেখিনি। আর এটা খুবই চমৎকার।'
ডালেন এই গবেষণায় সহায়ক হিসেবে কাজ করেছেন। তবে এখনও নেকড়ে শাবকদের সামনাসামনি দেখেননি, কিংবা জিন সম্পাদনা বা ক্লোনিং প্রক্রিয়ায়ও অংশ নেননি। তিনি বলেন, বিজ্ঞানীদের এই কাজ ছিল 'একটি বিশাল কষ্টসাধ্য সাফল্য,' যা পূর্বে এই ক্ষেত্রে করা কিছু কাজ থেকে অনেক দূরে ছিল।
তিনি বলেন, 'যেভাবে আমি এটাকে দেখি, তারা ডায়ার ওলফের ফেনোটাইপ (একটি প্রজাতির দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্য) পুনরুদ্ধার করেছে এবং এই জিনোম থেকে আমরা যেটা বুঝতে পারি তা হলো, ডায়ার ওলফ সম্ভবত এই শাবকদের মতোই দেখতে ছিল। আমার কাছে, এটিই ডায়ার ওলফ।'

কলোসাল বায়োসায়েন্সেস প্রতিষ্ঠানটি ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তখনই তারা ম্যামথ পুনর্জীবিত করার পরিকল্পনা ঘোষণা করে। কোম্পানিটি এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৪৩৫ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে। ল্যাম এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিকিস্ট জর্জ চার্চের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত কলোসাল ম্যামথ প্রজেক্টের দিকেও নজর দিচ্ছে। ২০২৮ সালে প্রথম উলির ম্যামথ শাবক আনার পরিকল্পনা করছে তারা।
কলোসাল বায়োসায়েন্সেস আশা করছে, যে প্রযুক্তি দিয়ে তারা ডায়ার ওলফ তৈরি করেছে, তা বিপন্ন প্রাণী সংরক্ষণে সাহায্য করতে পারে। কোম্পানি জানিয়েছে, তারা ডায়ার ওলফ গবেষণার মাধ্যমে একটি নতুন, কম আক্রমণাত্মক ক্লোনিং পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে, যার সাহায্যে তারা দুইটি লিটার ক্লোন করা লাল নেকড়ে তৈরি করেছে—এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন নেকড়ে প্রজাতি।
ডি-এক্সটিংকশনের বিপক্ষে অনেক সমালোচক মনে করেন, এ প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, যা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যয় করা উচিত ছিল। তাদের আশঙ্কা, হাইব্রিড প্রাণী উৎপাদন ও পালন, বেঁচে থাকা প্রাণীদের জন্য বিপদ তৈরি করতে পারে।
তবে, মন্টানা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশনীতিবিদ ক্রিস্টোফার প্রেস্টন বলেন, কলোসাল প্রাণীকল্যাণ বিষয়ে যথেষ্ট যত্ন নিচ্ছে, এবং তারা যে বড় পরিসরে এই প্রকল্পটি পরিচালনা করছে এবং আমেরিকান হিউম্যান সোসাইটির সমর্থন পেয়েছে, সেটি তার প্রমাণ।