মিয়ানমারে ধসে পড়া প্রি-স্কুলের সামনে বসেই চিৎকার করে সন্তানদের ডেকেছেন মা-বাবারা

ভূমিকম্পে মিয়ানমার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এ ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই পড়ে আছে ১৫ জন শিশুর স্কুল ব্যাগ। গোলাপি, নীল, কমলা রঙের ব্যাগগুলোর আশেপাশেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে বইপত্র। খবর বিবিসির।
ভাঙা চেয়ার, টেবিল ও বাগানের স্লাইডগুলোর ওপর এলোমেলোভাবে পড়ে আছে খেলনা স্পাইডারম্যান ও অ্যালফাবেটের বিভিন্ন অক্ষর।
মিয়ানমারের মান্দালয় থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে কাইয়ুকসে ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কমপক্ষে দুই হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
৭১ বছর বয়সী কিউয়ে নাইয়েন তার পাঁচ বছর বয়সী নাতনি থেট হটারকে হারিয়ে ভূমিকম্পের এ হৃদয়বিদারক দৃশ্যের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তার পরিবার শিশুটির শেষকৃত্যের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কিউয়ে নাইয়েন বলেন, 'থেটের মা তার মধ্যাহ্নভোজ শেষ করছিলেন, সে সময়েই ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে পুরো বাড়ি। তিনি খাওয়া-দাওয়া রেখেই মেয়ের খোঁজে স্কুলে ছুটে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলেন স্কুলটি পুরোপুরি ধসে পড়েছে।'
ঘটনার তিন ঘণ্টা পর মেয়ে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়। কিউয়ে নাইয়েন বলেন, 'সৌভাগ্যক্রমে আমরা আমার নাতনির দেহ সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় পেয়েছিলাম।'
স্থানীয়রা জানায়, স্কুলটিতে গত শুক্রবার ২ থেকে ৭ বছর বয়সী প্রায় ৭০ জন শিশু ছিল। সেখানে তারা আনন্দ নিয়ে হেসে-খেলে পড়াশোনা করত। তবে এখন সেখানে শুধুই ইট, কংক্রিট এবং লোহার রডের ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছু নেই।
স্কুলটি জানায়, ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১২ জন শিশু ও একজন শিক্ষক প্রাণ হারিয়েছেন। তবে স্থানীয়রা বলছেন মৃতের সংখ্যা কমপক্ষে ৪০ জন হতে পারে।
ঘটনায় স্থানীয়রা ও অভিভাবকরা শোকাহত। স্থানীয়রা জানায়, পুরো শহর উদ্ধারকাজে সাহায্য করতে এসেছিল এবং শুক্রবারই কয়েকজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তারা বর্ণনা করেন, সেদিন বাচ্চাদের খোঁজে মায়েরা রাতভর কান্না করছিলেন এবং তাদের সন্তানের নাম ধরে ডাকছিলেন।
ভূমিকম্পের তিন দিন হতে চলছে, এখন সবই নীরব। যারা বেঁচে আছেন তাদের মনও দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে আছে।
সাহায্যকারী সংগঠনগুলো জানায়, পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। কারণ ভূমিকম্পে হাসপাতালগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত রোগী ধারণ করতে পারছে না। তবে ক্ষতির পরিমাণ এবং এর প্রভাব এখনও পুরোপুরি নির্ণয় করা যায়নি।
তারা জানায়, কাইয়ুকসে পৌঁছানোর আগে তারা মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে অবস্থান করছিলেন।
তারা জানায়, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের একটি আবাসিক ভবন। ভবনটির নিচের তলা একদম ধসে গেছে। এর ওপরে তখনও তিনটি ফ্লোর দাঁড়িয়ে আছে।
ধ্বংসস্তূপে রক্তের দাগ ছিল। তীব্র দুর্গন্ধ থেকে ধারণা করা যায় যে, এখানে অনেক মানুষ মারা গেছে, কিন্তু সেখানে কোনো উদ্ধারকর্মীকে দেখা যায়নি।
সেখানে কিছু পুলিশ সদস্যকে ট্রাকে আসবাবপত্র এবং গৃহস্থালির জিনিসপত্র তুলতে দেখা যায়। তারা ব্যবহারযোগ্য জিনিসগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করছিলেন।
দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা রাজি হননি। তবে প্রতিবেদককে কিছু সময়ের জন্য ছবি তোলার অনুমতি দেন।
মানুষদের শোকাহত ও বিপর্যস্ত দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু তারা সেনা শাসিত সরকারের ভয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও কতজন আছে? সেখানে কাউকে জীবিত পাওয়া যাবে কি না—এমন হাজারও প্রশ্ন মনে ভিড় করে থাকলেও তার উত্তর নেই।
রাজধানীর এক হাজার শয্যার সবচেয়ে বড় হাসপাতালটিতে গেলে দেখা যায়, ইমার্জেন্সি ইউনিটের ভবনের ছাদ ধসে পড়েছে।
হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেনাবাহিনীর ছয়টি ট্রাক। সেখানে কয়েকটি তাঁবু টানানো হয়েছে। হাসপাতাল থেকে রোগীদের সরিয়ে সেখানেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তাঁবুগুলোকে বারবার পানিতে ভিজিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, যাতে ভেতরে থাকা মানুষরা তীব্র গরম থেকে কিছুটা আরাম পেতে পারেন।
এসব তাঁবুতে কমপক্ষে ২০০ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন। ঘটনাস্থলে এক কর্মকর্তাকে ক্ষিপ্তভাবে স্টাফদের বকাঝকা করতে দেখা যায়।
ওই কর্মকর্তা ছিলেন মিয়ানমারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. থেত খাইন উইন। তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি তাচ্ছিল্যভাবে সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন।
বাস্তুহারা অনেক মানুষ গরম থেকে রেহাই পেতে তখন মহাসড়কের মাঝে ও গাছের নিচে বসে ছিল। সময়টি বছরের সবচেয়ে গরম সময়। এ সময় তাপমাত্রা ছিল ৪০° সেলসিয়াস। চলমান আফটারশকের কারণে তারা কোনো ভবনে আশ্রয় নিতে ভয় পাচ্ছিলেন।
প্রতিবেদক জানান, তারা রোববার ভোর ৪টায় ইয়াঙ্গুন থেকে রওনা দেন ৬০০ কিলোমিটার দূরে মান্দালয়ের উদ্দেশে। যাওয়ার রাস্তাটি ছিল সম্পূর্ণ অন্ধকার। সেখানে কোনো স্ট্রিট লাইট ছিল না।
তিন ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানোর পর প্রতিবেদক একটি ২০ জনের উদ্ধারকারী দলকে দেখতে পান। তাদের গায়ে ছিল কমলা রঙের ইউনিফর্ম। তাদের ভেস্টে থাকা লোগো থেকে বোঝা যায় যে, তারা হংকং থেকে এসেছেন সাহায্যের জন্য।
এরপর প্রতিবেদক উত্তরে যাত্রা শুরু করেন। সেখানে রাস্তায় তিনি ফাটলের দেখা পান।
এ ধরনের রাস্তায় সাধারণত চেকপোস্টের দেখা মেলে। তবে সেখানে ১৮৫ কিলোমিটার পর একটি চেকপোস্টের দেখা পেলেন প্রতিবেদক। সেখানে তাকে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সামনে সেতু ভেঙে গেছে, তাই রাস্তা বন্ধ এবং তাদের বিকল্প পথ দেখিয়ে দেন।
প্রতিবেদক আশা করছিলেন রোববারই তিনি মান্দালয়ে পৌঁছাতে পারবেন। কিন্তু বিকল্প পথ, তাপমাত্রা ও গাড়িতে সমস্যা হওয়ায় তিনি সময়মতো পৌঁছাতে পারেননি।
একদিন পর মান্দালয়ে পৌঁছান প্রতিবেদক। কিন্তু শহরটি সম্পূর্ণ অন্ধকারে ডুবে ছিল। ছিল না কোনো স্ট্রিট লাইট। বাড়িগুলোতে কোনো বিদ্যুৎ ও পানি কিছুই ছিল না।
তবে সকালে উঠে দিনের আলোতে কেমন পরিবেশ দেখবেন, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন প্রতিবেদক।