বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশকে বেছে নেওয়ার আহ্বান ইয়াংওয়ান প্রধানের, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টার প্রশংসা

বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে ইয়ংওয়ান কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) ও টেক্সটাইল খাতের অগ্রদূত কিহাক সাং সোমবার সফররত বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশকে তাদের ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার বিনিয়োগকারীদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার ব্যাপারে সত্যিকার অর্থেই আন্তরিক উল্লেখ করে তিনি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বলেন, 'আপনারা বাংলাদেশের এই নতুন প্রশাসনের ওপর আস্থা রাখতে পারেন।'
কিহাক সাং বলেন, অতীতে অনেক সরকার সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু বর্তমান প্রশাসন খুবই কার্যকরভাবে কাজ করছে।
তিনি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আনোয়ারায় কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনে (কেইপিজেড) বিনিয়োগের আহ্বান জানান।
জমি সংক্রান্ত বিরোধের কথা উল্লেখ করে কিহাক সাং বলেন, 'আমরা একটি কঠিন সময় পার করেছি এবং নতুন অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এখন পরিস্থিতি ঠিক হয়ে গেছে।'
বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের উৎসাহ দিয়ে তিনি বলেন, 'আমি বাংলাদেশকে খুব ভালোবাসি।'
প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার ইউএনবিকে বলেন, 'দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত এবং নেদারল্যান্ডসের প্রায় ৭০ জন বিনিয়োগকারী কেইপিজেড পরিদর্শন করেছেন এবং সেখানকার কার্যক্রম দেখেছেন।'
কিহাক সাং এবং ইয়াংওয়ান বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জাহাঙ্গীর সাদাত আনোয়ারার কেইপিজেডে সফররত বিদেশি বিনিয়োগকারীদের স্বাগত জানান।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও পোশাক খাতের অগ্রদূত ইয়ংওয়ান করপোরেশনের নির্মিত ও পরিচালিত কেইপিজেড শিল্প উন্নয়ন ও টেকসই উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী সর্বোত্তম চর্চার প্রতিফলন ঘটায়।
এই অঞ্চলটি উচ্চ-প্রযুক্তি শিল্প উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এখানে ৭ মিলিয়ন বর্গফুট এলাকাজুড়ে ৪৮টি গ্রিন-সার্টিফাইড কারখানা রয়েছে এবং এখানে উন্নত লজিস্টিক্স ও ওয়ারহাউজিং সুবিধাও রয়েছে।
কেইপিজেড কর্ণফুলী টানেল হয়ে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মাত্র ১৫ মিনিটের ড্রাইভে কর্ণফুলী নদীর বাম তীরে অবস্থিত।
২,৪৯২ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এটি দেশের বৃহত্তম বেসরকারি মালিকানাধীন এবং পরিবেশবান্ধব রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল।
বিস্তৃত বনায়ন প্রচেষ্টার মাধ্যমে, ইয়াংওয়ান একসময়ের অনুর্বর জমিকে সমৃদ্ধ সবুজ শিল্প অঞ্চলে রূপান্তর করেছে, যা পরিবেশ সংরক্ষণ এবং বিশ্বমানের পরিচালন ব্যবস্থা প্রতিশ্রুতির প্রমাণ।
ডিপিএস আজাদ বলেছেন, কেপিজের ৫২% জমি সবুজ অঞ্চল এবং জলাশয়ের জন্য নির্ধারিত, যেখানে বিপুল পরিমাণ গাছ লাগানো হয়েছে।
কিহাক সুং বলেছেন, কেইপিজেড-এ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কৃত্রিম তন্তু উৎপাদন কারখানা রয়েছে, যা ২ মিলিয়ন বর্গফুট এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এবং টেকসই উৎপাদন নিশ্চিতে সব কারখানায় বর্জ্য পানি শোধনাগার প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে।
আজ সোমবার (৭ এপ্রিল) থেকে শুরু হওয়া বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনের অংশ হিসেবে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা চট্টগ্রাম সফর করছেন। কেইপিজেডের সুযোগ-সুবিধা দেখে তারা মুগ্ধ হয়েছেন।
বিনিয়োগকারীরা আজ চট্টগ্রামের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন করবেন।

আগামীকাল ৮ এপ্রিল বিদেশি অংশগ্রহণকারীরা আড়াইহাজারে অবস্থিত জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন করবেন।
বৈশ্বিক বিনিয়োগকারী এবং শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তাদের আতিথেয়তা জানাচ্ছে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে দেশের বিকাশমান বিনিয়োগ পরিবেশকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরা হচ্ছে। এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য হলো দেশের নতুন সুযোগ এবং অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে তুলে ধরা, যা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে।
আগামী ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকায় বাংলাদেশের বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ সম্ভবনা নিয়ে আলোচনায় বসবেন বৈশ্বিক বিনিয়োগ নেতা, নির্বাহী কর্মকর্তা এবং শিল্পখাতের পথিকৃৎরা।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন জানান, আগামী ৯ এপ্রিল রাজধানীর একটি হোটেলে মূল অনুষ্ঠান আয়োজিত হবে, এতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যোগ দেবেন।
বিডা'র নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, 'এটি একটি যৌথ প্রচেষ্টা। বেসরকারি খাত এবং দূতাবাস (ঢাকায় বিদেশি মিশন) সমানভাবে এতে অংশগ্রহণ করছে।'
তিনি আরও বলেন, আমরা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কথা শুনব, যাতে তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ সম্পর্কে কী মনে করেন এবং কীভাবে বাংলাদেশ আরও উন্নতি করতে পারে সেই বিষয়ে তাদের মতামত জানতে পারি।
পাঁচটি কোম্পানি এবং ব্যক্তিকে তাদের অবদানের জন্য সম্মানিত করা হবে এবং একটি বিদেশি বিনিয়োগকারীকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।
আশিক মাহমুদ বলেন, দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের জন্য আরও অনেক আয়োজন থাকবে এবং ভবিষ্যতে বিনিয়োগের দিকে নজর রেখে সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য একটি বিশেষ স্থান থাকবে।
তিনি বলেন, 'আমরা নাসার সঙ্গে অ-সামরিক মহাকাশ অনুসন্ধানের বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ভাবছি। এটি স্বাক্ষরিত হলে আমরা বিস্তারিত জানাতে পারব।'
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান জানান,তাদের লক্ষ্য বাংলাদেশ সম্পর্কে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা এবং ব্যবসা শুরু করার প্রক্রিয়া আরও সহজতর করা।
তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ও প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। এই সামিটে শুধু বিনিয়োগের সুযোগই তুলে ধরা হবে না, বরং অধিকতর ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে গৃহীত উল্লেখযোগ্য সংস্কারগুলোও তুলে ধরা হবে।
এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনে শীর্ষ নিবন্ধিত দেশগুলো হলো চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারত।
বিডা'র তথ্যানুসারে সম্মেলনে অংশ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ অতিথিদের মধ্যে রয়েছেন- জারা গ্রুপের সিইও অস্কার গার্সিয়া মেসেইরাস, ডিপি ওয়ার্ল্ডের চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদ বিন সুলাইয়েম, ব্রিটিশ ব্যারোনেস রোজি উইন্টারটন, স্যামসাং সি অ্যান্ড টি-র ভাইস প্রেসিডেন্ট কিয়ংসু লি, গিওর্দানো'র সিইও জুনসিওক হান, এক্সেলারেট এনার্জির প্রেসিডেন্ট স্টিভেন কোবোস, টেলিনর এশিয়ার এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড জন ওমুন্ড রেভহাউগ এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের উবারের পাবলিক পলিসি প্রধান মাইক অর্গিল।
বিডা'র নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশ চায় বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের কাছে দেশের 'প্রকৃত চিত্র' এবং বাংলাদেশে বিনিয়োগের সত্যিকারের সম্ভাবনার গল্প তুলে ধরতে চায়।
তিনি বলেন, ' বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের সশরীরে দেশে না এনে, প্রকৃত চিত্র দেখানো এবং সত্যিকারের সম্ভাবনা সম্পর্কে জানানো খুব কঠিন। আমরা বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছে প্রকৃত চিত্র উপস্থাপন করতে চাই।'
অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী এখনও বাংলাদেশের প্রকৃত বিনিয়োগ পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন নন জানিয়ে আশিক মাহমুদ বলেন, বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ সম্পর্কে যা জানেন তা আসল চিত্র নয়, কারণ প্রকৃত পরিস্থিতি ভিন্ন।
এক প্রশ্নের জবাবে বিডা'র নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, বিনিয়োগকারীরা 'স্বল্পমেয়াদী বাধা-বিঘ্নের কথা' মাথায় রেখেই বাংলাদেশে আসছেন।
আশিক মাহমুদ বলেন, এই সামিটের মাধ্যমে আমরা তাদের বাংলাদেশের সম্ভাবনা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগবান্ধব নীতি এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত করতে চাই।
তিনি বলেন, এছাড়া তিনটি রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আলাদা বুথ থাকবে, যাতে করে বিনিয়োগকারীরা এসব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারেন।
এছাড়া, বাংলাদেশের ঐতিহ্য তুলে ধরতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা আয়োজন করা হবে।
১০ এপ্রিল সামিটে বিভিন্ন ব্রেকআউট সেশন অনুষ্ঠিত হবে। যার মধ্যে ডিজিটাল অর্থনীতি (সিটি এনএ ও ইউএনডিপি), টেক্সটাইল (এইচএসবিসি ও বিজিএমইএ), কৃষি ও কৃষি-প্রক্রিয়াজাতকরণ (ডাচদূতাবাস ও এলসিপি) এবং স্বাস্থ্যসেবা (ইন্সপিরা, ইবিএল ও সাজিদা ফাউন্ডেশন)-এর ওপর আলোচনা হবে।
এছাড়া, ওইদিন বিনিয়োগকারীদের জন্য ম্যাচমেকিং সেশন এবং সেরা বিনিয়োগ চর্চা নিয়ে রাউন্ড-টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
এই ইভেন্টের প্রধান অংশীদারদের মধ্যে রয়েছে ইউএনডিপি, এফসিডিও, গ্রামীণফোন, বিশ্বব্যাংক ও এফআইসিসিআই, যা বাংলাদেশে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করতে সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টাকে তুলে ধরে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনের আগে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, 'বাংলাদেশে বিনিয়োগের অসাধারণ সুযোগ অনুসন্ধানের এর চেয়ে ভালো মুহূর্ত আর কখনো আসেনি।'
বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে এক বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'বাংলাদেশ গভীর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে এবং বর্তমানে একটি ভবিষ্যতবান্ধব বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা আমাদের সক বিনিয়োগকারীদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।'
ড. ইউনূস বলেন, এই সম্মেলন বিনিয়োগকারীদের জন্য আরও তথ্যভিত্তিক ধারণা অর্জনের একটি সুযোগ।
তিনি বলেন, 'আসুন, আপনাদের জন্য বাংলাদেশে অপার সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করুন এবং বিশ্বের অন্যতম গতিশীল অর্থনীতিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে ভবিষ্যত গঠনে আমাদের সঙ্গে যোগ দিন।'