ট্রাম্পের শুল্ক: যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের বাণিজ্য টানাপোড়েনের কেন্দ্রে কৃষিপণ্য কেন?

ভারত কেন আমেরিকার এক বুশেল গমও কিনতে চায় না? – সম্প্রতি এই প্রশ্নই রেখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী হওয়ার্ড লাটনিক। ভারতের বাজারে মার্কিন কৃষিপণ্য রপ্তানির ওপর থাকা বিধিনিষেধের কথা উল্লেখ করে তিনি দেশটির বাণিজ্য নীতির সমালোচনায় একথা বলেন। খবর বিবিসির
সাম্প্রতিক আরেকটি সাক্ষাৎকারে লাটনিক অভিযোগ করেন, মার্কিন কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য প্রবেশে বাধা দিচ্ছে ভারত। এসময় তিনি ভারতকে কৃষিপণ্যের বাজার উন্মুক্ত করার আহ্বান জানান। এক্ষেত্রে কোটার মাধ্যমে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে বলে পরামর্শ দেন তিনি।
বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুরু করা বাণিজ্য যুদ্ধ যখন তীব্র হচ্ছে, তারমধ্যে প্রধান উত্তেজনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিখাতের রপ্তানি। ভারতের সঙ্গেও এনিয়ে তৈরি হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের টানাপোড়েন। ভারতে মার্কিন কৃষিপণ্যের ওপর পাল্টা-শুল্কারোপ কার্যকর হচ্ছে আগামী ২ এপ্রিল থেকেই।
ভারত মার্কিন মদ ও কৃষিপণ্যের ওপর যথাক্রমে ১৫০ শতাংশ এবং ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। ইতঃপূর্বে ট্রাম্প ভারতকে 'শুল্কের রাজা' ও 'বড় অপব্যবহারকারী' বলে সমালোচনা করেছেন।
তবে কেবল ট্রাম্পই নন, আমেরিকা বহু বছর ধরেই ভারতের কৃষি বাজারে আরও প্রবেশাধিকার চেয়ে আসছে। ভারতের কৃষি বাজারকে সম্ভাবনাময় মনে করে ওয়াশিংটন। কিন্তু, ভারত কঠোরভাবেই নিজ বাজারকে আমদানি থেকে সুরক্ষিত রাখে। সেক্ষেত্রে প্রান্তিক কৃষকদের জীবনজীবিকা যে কৃষির ওপরই নির্ভর করছে এমন যুক্তি দেওয়া হয়।
ভারতের খাদ্য উৎপাদনও এখন কম নয়। খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হওয়াটা— ভারতের অন্যতম বড় অর্জনের গল্প। অথচ ১৯৫০ বা ৬০'এর দশকেও দেশটি নিজ জনসংখ্যার জন্য খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভর করতো। তবে কৃষিখাতে একের পর এক বিপ্লব ঘটানোর মাধ্যমে সেই পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এখন প্রধান প্রধান খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণই বলা যায় ভারতকে। এমনকী বিশ্বের সর্ববৃহৎ দুধ উৎপাদনকারীও এখন ভারত। শাকসবজি উৎপাদন, পোলট্রি ও মাছ চাষে দ্রুতগতিতে সাফল্য ভারতের খাদ্য ঝুড়িকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারত বর্তমানে বিপুল খাদ্য রপ্তানি করে– বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকে পরিণত হয়েছে। ভারত থেকে প্রতিনিয়তই দেশ-বিদেশে যায় শস্য, ফলমূল ও ডেইরি পণ্যের চালান।
তবে এসব বড় অর্জন সত্ত্বেও— উৎপাদনশীলতায় আজো উন্নত দেশগুলোর চেয়ে পেছনে পড়ে আছে ভারতের কৃষিব্যবস্থা। অবকাঠামো ও বাজার প্রবেশাধিকারেও রয়েছে পিছিয়ে। উৎপাদন বৃদ্ধির এই চ্যালেঞ্জকে আরও কঠিন করে তুলছে জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ববাজারে দামের অস্থিতিশীলতা। ভারতের হেক্টরপ্রতি ফসল উৎপাদন এখনো বিশ্বের সর্বোচ্চ মাত্রার চেয়ে অনেক কম। তাছাড়া, ছোট ছোট জমির মালিকানা এই সমস্যাকে গভীর করছে। ভারতীয় কৃষকের গড় জমির পরিমাণ মাথাপিছু এক হেক্টরেরও কম। অন্যদিকে, ২০২০ সালের এক হিসাব অনুসারে, মার্কিন কৃষকদের গড় জমি ৪৬ হেক্টরেরও বেশি।
এসব বাধার কারণে উৎপাদনশীলতা তুলনামূলকভাবে কম হলেও— দেশটির মোট জনশক্তির প্রায় অর্ধেকের কর্মসংস্থান হয়েছে কৃষিতে। কিন্তু, জিডিপিতে এখাতের অবদান মাত্র ১৫ শতাংশ। অন্যদিকে আমেরিকার মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তবে ভারতে উৎপাদনখাতের চাকরি সীমিত হওয়ায়— দিন দিন কম মজুরিতে কৃষি খামারে শ্রম দেওয়াদের সংখ্যা বাড়ছে— যা কোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি বিপরীত প্রবণতা।
কাঠামোগত এই ভারসাম্যহীনতাই ভারতের বাণিজ্য নীতি গঠনে ভূমিকা রেখেছে। তাই উৎপাদন উদ্বৃত্ত হলেও— আমদানি করা কৃষিপণ্যে উচ্চ শুল্কারোপের মাধ্যমে ভারত তার নিজস্ব কৃষকদের সুরক্ষা দেয়। কারণ কম মূল্যের আমদানি কৃষকের বিপুল লোকসান করবে। যা এই খাতের কর্মসংস্থানকেও কমাবে। তাই মোটামুটি উচ্চ শুল্কের পথই বেঁছে নিয়েছে ভারত— যেখানে কৃষিপণ্য আমদানিতে শূন্য থেকে সর্বোচ্চ ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্যে ভারতের আরোপিত শুল্কের ভারিত গড় – অর্থাৎ পণ্যপ্রতি আমদানির গড় শুল্ক হার হচ্ছে ৩৭.৭০ শতাংশ। সে তুলনায়, যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের কৃষিপণ্য রপ্তানিতে শুল্ক দিতে হয় মাত্র ৫.৩০ শতাংশ। এসব তথ্য জানা গেছে দিল্লি-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা– গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (জিটিআরআই) তথ্যসূত্রে।

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক কৃষি বাণিজ্যের পরিমাণও মাঝারি গোছের, বা ৮০০ কোটি ডলারের।
ভারত যুক্তরাষ্ট্রে মূলত চাল, চিংড়ি, মধু, শাকসবজির নির্যাস, ক্যাস্টর অয়েল, গোলমরিচ প্রভৃতি রপ্তানি করে। অন্যদিকে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানির মধ্যে রয়েছে কাঠবাদাম, আখরোট, কাজুবাদাম, আপেল, ডাল ইত্যাদি।
উভয় দেশ বর্তমানে একটি বাণিজ্য চুক্তিতে নিয়ে কাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন যুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র তার গম, তুলা, ভুট্টা ও যবের মতো প্রধান কৃষি রপ্তানিকে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাড়ে ৪ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে এসব রপ্তানি ভূমিকা রাখবে।
দিল্লি-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট এর বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ ধর বলছেন, 'এবার তাঁরা স্ট্রবেরি বা এই ধরনের পণ্য রপ্তানি করার লক্ষ্য নেয়নি। খেলাটা আরও বড়।
ভারতকে কৃষিপণ্য আমদানির শুল্ক কমানো, স্থানীয় কৃষকদের দেওয়া মূল্য সহায়তা হ্রাস এবং যুক্তরাষ্ট্রের জেনেটিকভাবে রুপান্তরিত শস্য ও ডেইরি পণ্যের জন্য বাজার উন্মুক্ত করার জন্য চাপ দেওয়া— বৈশ্বিক কৃষিখাতের মৌলিক অসামঞ্জস্যকে বিবেচনায় নিয়ে করা হচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র নিজেও কৃষিতে বিপুল ভর্তুকি দেয়, এবং কৃষকদের সুরক্ষায় শস্য বিমাও প্রদান করে।
জিটিআরআই এর বিশেষজ্ঞ অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, কিছুক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কৃষি উৎপাদন ব্যয়ের ১০০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দেয়। এরফলে যে অসম ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে তা ভারতের ছোট কৃষকদের সর্বশান্ত করতে পারে।
তিনি বলেন, কৃষিই হলো ভারতের মেরুদণ্ড, এইখাতের সঙ্গে ৭০ কোটির বেশি মানুষ জড়িত, যা দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ফরেন ট্রেড' এর বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা অধ্যয়ন কেন্দ্রের সাবেক প্রধান অভিজিৎ দাস বলেন, 'প্রধান যে বিষয়টা মনে রাখতে হবে, তা হচ্ছে– দুই দেশের কৃষিব্যবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা। যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্যিক কৃষি রয়েছে। অন্যদিকে শ্রমঘন ও জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষির ওপর নির্ভরতা আছে ভারতের। তাই এটা যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবাণিজ্যের বিপরীতে ভারতের লাখ লাখ মানুষের জীবনজীবিকারও প্রশ্ন।'
তবে ভারতের কৃষিখাতের চ্যালেঞ্জ শুধুই বাইরে থেকে আসছে এমনটা নয়। বিশ্বজিৎ ধর বলছেন, এখাতের বেশিরভাগটাই টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে 'নিজেদেরই দোষে'। কৃষিখাতে অর্থায়ন প্রয়োজনের চেয়ে কম বহুদিন ধরেই, ভারতের মোট বিনিয়োগের মাত্র ৬ শতাংশেরও কম হচ্ছে কৃষিতে। অথচ বিনিয়োগ বাড়লে দরকারি কৃষি-সহায়ক অবকাঠামো, কৃষি উপকরণ ও দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধির জন্য দরকারি অন্যায় সম্পদ তৈরি করা সম্ভব।