তুরস্কে এরদোয়ানের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রেপ্তার; প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ

তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরের মেয়র ও প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী একরেম ইমামোগলুকে গ্রেপ্তার করার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। মাত্র কয়েক দিন পরেই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে তার মনোনীত হওয়ার কথা ছিল। খবর বিবিসি'র।
ধর্মনিরপেক্ষ রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) নেতা একরেম ইমামোগলুর বিরুদ্ধে প্রসিকিউটররা দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সহায়তার অভিযোগ এনেছেন এবং তাকে 'সন্ত্রাসী সংগঠনের সন্দেহভাজন নেতা' হিসেবে অভিহিত করেছেন।
তদন্তের অংশ হিসেবে পুলিশ ১০০ জনকে আটক করেছে। তাদের মধ্যে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও ব্যবসায়ীরাও রয়েছেন। এদিকে, ইস্তাম্বুলের গভর্নরের কার্যালয় শহরে চার দিনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
ইমামোগলু অনলাইনে বলেছেন, 'জনগণের ইচ্ছাকে দমন করা যাবে না।'
বিক্ষোভকারীরা রাস্তায়, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ও পাতাল রেলস্টেশনে জড়ো হয়ে সরকারবিরোধী স্লোগান দিচ্ছেন। বহু বছর পর তুরস্কে এমন গণঅসন্তোষ প্রকাশ্যে এসেছে।
তুরস্কের বৃহত্তম শহরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রকাশিত ফুটেজে দেখা গেছে, ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ পিপার স্প্রে ব্যবহার করছে।
নগর ভবনের সামনে ঠান্ডা আবহাওয়ার মধ্যেও হাজারো মানুষ সমবেত হয়ে স্লোগান দিয়েছেন, 'এরদোয়ান, স্বৈরাচার!' এবং 'ইমামোগলু, তুমি একা নও!'

সরকার ইস্তাম্বুলে চার দিনের নিষেধাজ্ঞার অংশ হিসেবে জনসমাগম নিষিদ্ধ করেছে। তবে দেশজুড়ে আরও বিক্ষোভের আশঙ্কা করা হচ্ছে, কারণ ইমামোগলুর স্ত্রীসহ বিরোধী দলের নেতারা জনগণকে 'আপনার আওয়ান তুলুন' বলে আহ্বান জানিয়েছেন।
ইস্তাম্বুলের অনেক সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কিছু মেট্রো লাইনও তাদের পরিষেবা বাতিল করেছে।
গ্রেপ্তারের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ পোস্ট করা এক বার্তায় তিনি বলেছেন, তার বিরুদ্ধে 'মিথ্যা, ষড়যন্ত্র ও ফাঁদের' জবাব তুরস্কের জনগণ দেবে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইন্টারনেট পর্যবেক্ষক সংস্থা নেটব্লক্স জানিয়েছে, তুরস্ক বুধবার থেকে এক্স, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ও টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যবহারে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
'আমাদের পরবর্তী প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান'
গত কয়েক মাসে তুরস্কে বিরোধী রাজনীতিক, পৌরসভা কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও বিনোদন জগতের ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে।
ইমামোগলুর গ্রেপ্তারের পর তুরস্কের স্বৈরতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ পেয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কেউ কেউ আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়েছেন। যুক্তি দিয়েছেন, এখন আর অবাধ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন সম্ভব নয়।
ইমামোগলুর দল সিএইচপি এই গ্রেপ্তারকে 'আমাদের পরবর্তী প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান' বলে অভিহিত করেছে।
তবে তুরস্কের আইনমন্ত্রী ইয়িলমাজ তুঞ্চ এরদোয়ানের সঙ্গে এই গ্রেপ্তারের সম্পর্ক টানাকে 'অত্যন্ত বিপজ্জনক ও ভুল' বলেছেন। তিনি দাবি করেছেন, এটি রাজনৈতিক কোনো পদক্ষেপ নয় এবং তুরস্কে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
২২ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা এরদোয়ান ও তার দলও অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তুরস্কের বিচারব্যবস্থা স্বাধীন।
গত বছর ইমামোগলু ইস্তাম্বুলের মেয়র হিসেবে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন। তখন তার দল সিএইচপি ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারার স্থানীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়। এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার পর প্রথমবারের মতো দেশজুড়ে তার দলের নির্বাচনে এমন পরাজয় ঘটেছিল।
এই পরাজয় এরদোয়ানের জন্য ব্যক্তিগতভাবেও বড় ধাক্কা ছিল, কারণ তিনি ইস্তাম্বুলে জন্মগ্রহণ করেন এবং এখান থেকেই মেয়র হয়ে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেন।

ইমামোগলুর বাড়িতে ভোরবেলার অভিযানে ডজনখানেক পুলিশ সদস্য অংশ নেয়।
সিএইচপির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর নির্বাচন রোববার অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সেখানে ইমামোগলুই একমাত্র প্রার্থী ছিলেন।
ইমামোগলুর গ্রেপ্তারের এক দিন আগে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয় তার স্নাতক ডিগ্রি বাতিল করে। অভিযোগ করে, এটি অনিয়মের মাধ্যমে অর্জিত। এই সিদ্ধান্ত বহাল থাকলে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
তুরস্কের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট পদের জন্য উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করা বাধ্যতামূলক।
ইমামোগলু এ সিদ্ধান্তকে 'আইনগতভাবে ভিত্তিহীন' বলে আখ্যা দিয়ে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে 'রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত থেকে জ্ঞানের জন্য নিবেদিত' থাকতে হবে।
তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০২৮ সালে হওয়ার কথা। এরদোয়ান তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না, কারণ তিনি এর আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি কেবল তখনই আবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন, যদি সংবিধান পরিবর্তন করা হয় অথবা মেয়াদ শেষের আগেই নির্বাচন আহ্বান করা হয়।
ইমামোগলুর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়েছে, পাশাপাশি তাকে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে)-কে সহায়তা করার অভিযোগেও অভিযুক্ত করা হয়েছে।
১৯৮৪ সাল থেকে বিদ্রোহ চালিয়ে আসা পিকেকে তুরস্ক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত।
চলতি মাসের শুরুতে কারাবন্দি নেতার সঙ্গে তুরস্কের কর্মকর্তাদের আলোচনার পর পিকেকে অস্ত্র ত্যাগের ঘোষণা দেয়।
আন্তর্জাতিক মহলে ইমামোগলুর গ্রেপ্তারের কড়া সমালোচনা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স ও জার্মানির কর্মকর্তারা এর নিন্দা জানিয়েছেন।
ইউরোপীয় পরিষদের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইমামোগলুর গ্রেপ্তার 'একজন সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে চাপ প্রয়োগের স্পষ্ট উদাহরণ'।
যদিও ইমামোগলুর গ্রেপ্তার অনেককে বিস্মিত করেছে, তার বিরুদ্ধে আইনি চাপ নতুন নয়।
২০১৯ সালে তুরস্কের নির্বাচন কমিশনকে অপমান করার অভিযোগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তাকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। তবে এই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেছেন এবং চূড়ান্ত রায় এখনও ঘোষণা হয়নি।
এছাড়া, তিনি ইস্তাম্বুলের বেইলিকদুজু জেলার মেয়র থাকাকালে দরপত্র সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগেও মামলার মুখোমুখি হয়েছেন।
সবশেষ, গত ২০ জানুয়ারি এক প্রসিকিউটরের সমালোচনা করায় তার বিরুদ্ধে নতুন একটি মামলা করা হয়।