স্পেসএক্সের রকেটে করে পৃথিবীতে ফিরছেন ৯ মাস মহাকাশে ‘আটকে পড়া’ ২ নভোচারী

নয় মাসের মহাকাশ অভিযানের পর অবশেষে ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন নাসার নভোচারী বুচ উইলমোর ও সুনি উইলিয়ামস। খবর বিবিসি'র।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) তাদের থাকার কথা ছিল মাত্র আট দিন। কিন্তু যে মহাকাশযানে তারা গিয়েছিলেন, সেটিতে প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দেওয়ায় তাদের মিশন নাটকীয়ভাবে দীর্ঘায়িত হয়।
নাসার নভোচারী নিক হেইগ ও রুশ মহাকাশচারী আলেক্সান্দর গর্বুনভের সঙ্গে স্পেসএক্সের একটি ক্যাপসুলে চড়ে তারা পৃথিবীতে ফিরছেন।
তাদের আইএসএস থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) বাংলাদেশ সময় সকাল ১১টা ৫ মিনিটে (জিএমটি ০৫:০৫, ইডিটি ০১:০৫)। আর সেদিনই রাত ৩টা ৫৭ মিনিটে (জিএমটি ২১:৫৭, ইডিটি ১৭:৫৭) ফ্লোরিডার উপকূলে অবতরণের কথা রয়েছে।
তবে আবহাওয়া অনুকূল না থাকলে অবতরণের সময়সূচি পরিবর্তিত হতে পারে।
এটি হবে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলা এক মহাকাশ মিশনের সমাপ্তি। তবে তাদের ফেরার শেষ পর্বটি সহজ হবে না।
স্পেসএক্স ড্রাগন ক্যাপসুলটি দ্রুত ও অগ্নিময় পুনঃপ্রবেশের মাধ্যমে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ফিরবে, যেখানে এটি প্রায় ১ হাজার ৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করবে।
নিমেষেই গতি কমে যাওয়ার কারণে নভোচারীরা পৃথিবীর অভিকর্ষের প্রায় চার গুণ জি-ফোর্স অনুভব করবেন।
অবশেষে চারটি বিশাল প্যারাশুট খুলবে এবং ক্যাপসুলটিকে ধীরে সমুদ্রে অবতরণ করতে সাহায্য করবে।
ব্রিটেনের প্রথম নভোচারী হেলেন শারম্যান বলেন, উত্তেজনাপূর্ণ এই যাত্রা পুরোপুরি সার্থক হবে।
তিনি বিবিসিকে বলেন, 'তারা অভিজ্ঞ নভোচারী. তবে পৃথিবীতে ফেরার অনুভূতিই হবে দুর্দান্ত। প্রথমেই তারা টের পাবেন বিশুদ্ধ বাতাসের ছোঁয়া।'

মাত্র আট দিনের মিশনে গত বছরের ৫ জুন বোয়িং নির্মিত স্টারলাইনার রকেটে করে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে গিয়েছিলেন সুনিতা ও বুচ। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তাদের প্রায় দীর্ঘ ৯ মাস অরবিটে অবস্থান করতে হয়।
যাত্রাপথে স্টারলাইনার নভোযানটির যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছিল। এক্ষেত্রে নতুন ওই রকেটে প্রপালশন সমস্যা ও হিলিয়াম লিক হওয়ার কথা জানিয়েছিল বোয়িং। উৎক্ষেপণের একদিন পর ৬ জুন ক্যাপসুলটি স্পেস স্টেশনের কাছাকাছি যাওয়ার সময় এর পাঁচটি থ্রাস্টার নষ্ট হয়ে যায়।
স্টারলাইনার গত সেপ্টেম্বরের শুরুতে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে এলেও, সেটি খালি অবস্থায় ফিরেছিল। এর ফলে বুচ ও সুনির ফেরার জন্য নতুন যান প্রয়োজন হয়।
তাই নাসা বিকল্প হিসেবে পরবর্তী নির্ধারিত ফ্লাইট স্পেসএক্স ক্যাপসুল বেছে নেয়। এটি সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পৌঁছায়।
ওই ক্যাপসুলে চারজনের পরিবর্তে দুইজন নভোচারী ছিলেন। ফলে বুচ ও সুনির জন্য দুটি আসন খালি ছিল। তবে এই মিশনের মেয়াদ ছয় মাস হওয়ায় তাদের মহাকাশে থাকার সময় দীর্ঘায়িত হয়।
রোববার বদলি ক্রুর আগমনের মধ্য দিয়ে বুচ ও সুনির ফেরার চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। নতুন দলের কাছে সংক্ষিপ্ত দায়িত্ব হস্তান্তরের পর তাদের মিশন শেষ হলো।
নাসার এই দুই নভোচারী প্রত্যাশার চেয়ে দীর্ঘ সময় মহাকাশে কাটানোকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছেন।
আইএসএসে থাকাকালীন তারা নানা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালিয়েছেন এবং মহাকাশে হেঁটেছেন। এর মধ্যে সুনি উইলিয়ামস আইএসএসের বাইরে সবচেয়ে বেশি সময় কাটানো নারী হিসেবে নতুন রেকর্ড গড়েছেন।
আর যদিও তাদের 'আটকে পড়া' বলা হচ্ছিল, তারা কখনোই প্রকৃত অর্থে আটকে পড়েননি।
মিশনজুড়ে স্টেশনের সঙ্গে সবসময়ই অন্তত একটি মহাকাশযান সংযুক্ত ছিল, যা প্রয়োজনে তাদের এবং স্টেশনে থাকা অন্যদের নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে পারত।
বিদায়ের কয়েক সপ্তাহ আগে কথা বলতে গিয়ে বুচ উইলমোর বলেছিলেন, তাদের মিশন দীর্ঘায়িত হলেও এতে তারা মোটেও বিচলিত হননি।
তিনি বলেন, 'আমরা স্বল্প সময় থাকার পরিকল্পনা নিয়ে এলেও দীর্ঘ সময়ের জন্য প্রস্তুত ছিলাম। মানব মহাকাশ অভিযানে এটাই স্বাভাবিক। আপনার দেশের মানব মহাকাশ কর্মসূচির মূল কথাই এটি।'
সুনি উইলিয়ামস জানিয়েছেন, এটি সম্ভবত তার শেষ মহাকাশযাত্রা।
তিনি বলেন, 'আমি মনে করি, এত অনন্য এক জায়গায় থাকাটা সত্যিই এক অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি দেয়। আমি চাই না, পৃথিবীতে ফিরে এই প্রেরণার অনুভূতিটা হারিয়ে ফেলি। তাই কোনোভাবে সেটাকে ধরে রাখতে হবে।'

গত মাসে এই দুই নভোচারীর মিশন আরও বেশি নজর কাড়ে, যখন স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ক দাবি করেন, রাজনৈতিক কারণে তাঁদের মহাকাশে রেখে দেওয়া হয়েছে এবং তাঁর কোম্পানি চাইলে তাঁদের আগেই ফিরিয়ে আনতে পারত।
তবে নাসার কর্মকর্তারা জানান, তাদের সিদ্ধান্ত পুরোপুরি ফ্লাইটের সময়সূচি ও মহাকাশ স্টেশনের প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া হয়েছিল।
প্রাক্তন নাসা নভোচারী ও স্পেসএক্সের সাবেক মহাকাশ অভিযান পরিচালক গ্যারেট রাইজম্যান বলেন, নাসা কেন তাদের জন্য একটি বিশেষ উদ্ধার অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়নি, তার যথেষ্ট কারণ ছিল।
তিনি বিবিসিকে বলেন, 'এটি বুচ এবং সুনির মহাকাশে কাটানো সময় কমানোর ক্ষেত্রে খুব একটা সহায়ক হতো না। মানে কয়েক মাস কমানো যেত। কিন্তু এর বিশেষ কোনো সুবিধা ছিল না।
রাইজম্যান আরও বলেন, 'এবং খরচ ছিল অনেক। এই ক্রু মিশনগুলোর জন্য কয়েকশো মিলিয়ন ডলার খরচ হয়।'
নভোচারীরা পৃথিবীতে পৌঁছানোর পর তাদের হিউস্টনের জনসন স্পেস সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞরা তাদের পরীক্ষা করবেন।
মহাকাশে দীর্ঘ মিশন শরীরের ওপর চাপ ফেলে, নভোচারীরা হাড়ের ঘনত্ব হারান এবং পেশি শক্তি কমে যায়। রক্ত সঞ্চালনেও প্রভাব পড়ে এবং শরীরের তরলের পরিবর্তন চোখের দৃষ্টিকেও প্রভাবিত করতে পারে।
শরীর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে অনেক সময় লাগতে পারে। তাই তারা ভারী ব্যায়ামের মধ্য দিয়ে যাবেন, যাতে মহাকাশে থাকার পর শরীর আবার মহাকর্ষের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তবে বুচ ও সুনির প্রথম অগ্রাধিকার হবে তাদের পরিবার, বন্ধু এবং পোষা প্রাণীদের সঙ্গে দেখা করা।
গ্যারেট রাইজম্যান সুনির সঙ্গে মহাকাশে থাকার সময়ে যোগাযোগ রেখেছিলেন।
তিনি বলেন, 'সুনির কাছ থেকে একটি ই-মেইল পেয়েছিলাম। সেখানে সে বলেছিল, মেইনে তার বাড়ির সামনের বারান্দায় কুকুরদের সঙ্গে বসে থাকার, বিশুদ্ধ বাতাস শ্বাস নেওয়ার এবং সূর্যের তাপে গা গরম করার অনুভূতি সে খুব মিস করছে।'