পেট ভালো রাখার রহস্য কিন্তু ধারণার চেয়েও সহজ

পেটের স্বাস্থ্য ভালো রাখা আপনার কল্পনার চেয়েও সহজ হতে পারে। 'ন্যাচার মাইক্রোবায়োলজি' জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিজ্জ খাদ্য গ্রহণ করলে অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়ে। অন্যদিকে, মাঝে মাঝে মাংস খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর না হলেও অতিরিক্ত মাংস গ্রহণে অন্ত্রে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি পায়।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইতালির ২১ হাজার মানুষের ওপর এ গবেষণা পরিচালিত হয়। একটি অ্যাপের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীদের খাদ্যাভ্যাস বিশ্লেষণ করে তাদের তিনটি গ্রুপে ভাগ করা হয়— সর্বভুক (যারা মাংস, দুগ্ধজাত ও উদ্ভিজ্জ খাদ্য গ্রহণ করেন), নিরামিষভোজী এবং নিরামিষাশী (যারা কোনো প্রাণিজ পণ্য খান না)।
গবেষকরা ডিএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে অংশগ্রহণকারীদের মলের নমুনা বিশ্লেষণ করেন। গবেষণার সহ-লেখক নিকোলা সেগাটা জানান, এতে অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমে বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ফল, সবজি ও শস্যজাতীয় খাদ্য অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বাড়ায়। এসব ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে কিছু দেহের রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। বিশেষ করে নিরামিষভোজীদের অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমে এ উপকারী ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ সর্বাধিক।
অন্যদিকে, সর্বভুকদের মধ্যে যারা লাল মাংস বেশি খান, তাদের অন্ত্রে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার আধিক্য দেখা যায়। এসব ব্যাকটেরিয়া প্রদাহজনিত অন্ত্রের রোগ (ইনফ্লেমেটরি বাওয়েল ডিজিজ) এবং কোলোরেক্টাল ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। তবে যারা মাংসের পাশাপাশি প্রচুর উদ্ভিজ্জ খাবার গ্রহণ করেন, তাদের অন্ত্রে নিরামিষভোজীদের মতোই প্রচুর উপকারী ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি দেখা যায়।
অর্থাৎ, বেশি পরিমাণে উদ্ভিজ্জ খাদ্য গ্রহণ লাল মাংস বা উচ্চ প্রক্রিয়াজাত মাংস গ্রহণের ফলে সৃষ্ট ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ কমাতে পারে এবং উপকারী ব্যাকটেরিয়া বাড়ায়। ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটির স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং 'দ্য গাট বায়োম ল্যাব'-এর পরিচালক রবিন্দর নাগপালও এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তবে, এটি রোগ প্রতিরোধে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখে তা এখনো নিশ্চিত নয়। বিদ্যমান গবেষণাগুলো আশাব্যঞ্জক হলেও, মাংস গ্রহণের ফলে সৃষ্ট ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধে উদ্ভিজ্জ খাদ্য কতটা উপকারী, তা জানতে আরও বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন।
এ ছাড়া, একজন ব্যক্তির স্বতন্ত্র মাইক্রোবায়োম তার সামগ্রিক সুস্থতার একটি মাত্র অংশ। তাই এ অনুজীবগুলো স্বাস্থ্যকে কীভাবে প্রভাবিত করে, তা বুঝতে আরও গবেষণা দরকার। তবে, অন্ত্রে উপকারী জীবাণুর উপস্থিতি স্বাস্থ্যকর থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এটি বজায় রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো খাদ্যতালিকায় প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিজ্জ খাবার রাখা।
উদ্ভিজ্জ খাদ্য অন্ত্রকে যেভাবে সুস্থ রাখে
অন্ত্রের জীবাণুগুলোর কার্যক্রমকে একটি বাগানের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এখানে অগণিত জীবাণু হলো ফুল, আর এগুলোর বৃদ্ধি ও পুষ্টির জন্য প্রয়োজন যথাযথ খাদ্য। কোন জীবাণু দেহে বিস্তার লাভ করবে, তা নির্ধারণ করে আমাদের খাদ্যাভ্যাস।
স্ট্যানফোর্ড মেডিসিনের গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট ও গবেষক শন স্পেন্সার বলেন, উদ্ভিজ্জ খাদ্যে প্রচুর আঁশ থাকে, যা আমাদের শরীর সম্পূর্ণভাবে হজম করতে পারে না। তখন অন্ত্রের কিছু উপকারী জীবাণু এ আঁশ খেয়ে হজমে সহায়তা করে এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
এ কারণে খাদ্যে বৈচিত্র্য থাকা জরুরি। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় শুধু নির্দিষ্ট কোনো শাকসবজি রাখলে, ওই নির্দিষ্ট শাক নির্দিষ্ট উপকারী ব্যাকটেরিয়ারই পুষ্টি জোগাবে, কিন্তু অন্যান্য উপকারী ব্যাকটেরিয়া অপুষ্টির শিকার হতে পারে।
বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়াকে পুষ্টি জোগালে শরীরে শর্ট-চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড তৈরি হয়, যা নানা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া, রঙিন উদ্ভিজ্জ খাদ্যে প্রচুর পরিমাণে ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট থাকে, যা প্রদাহ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াকে উৎসাহিত করে এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়।
তবে, সেগাটা সতর্ক করে বলেন, সম্পূর্ণ উদ্ভিদভিত্তিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করলে কিছু পুষ্টির ঘাটতি দেখা দিতে পারে। গবেষকরা আরও জানান, নিরামিষভোজীদের অন্ত্রে দই ও চিজের মতো ফারমেন্টেড দুগ্ধজাত পণ্য থেকে প্রাপ্ত প্রোবায়োটিকের অভাব লক্ষ্য করা গেছে। ফলে, পুষ্টিকর খাদ্য বাদ দিলে তা মাইক্রোবায়োমের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
খাদ্যতালিকা যেভাবে সাজাবেন
নাগপাল বলেন, যারা মাংস খান, তাদের প্রাণিজ আমিষ গ্রহণের পরিমাণ সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিত।
এ বিষয়ে তিনি ভূমধ্যসাগরীয় ডায়েটের কথা উল্লেখ করেন, যা অনুসরণ করলে লাল মাংসের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সামুদ্রিক মাছ ও কম চর্বিযুক্ত হাঁস-মুরগির মাংস প্রোটিনের ভালো উৎস হতে পারে। এর পাশাপাশি বাদাম, অলিভ অয়েল, স্বল্প-চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য, শস্যদানা, ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়া উচিত।
খাদ্যতালিকায় অবশ্যই ফাইবার থাকা দরকার। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ২২ থেকে ৩৪ গ্রাম ফাইবার গ্রহণ করা উচিত। ইউএসডিএ-এর মতে, একটি সুষম খাবারের জন্য প্লেটের অর্ধেক অংশে ফল ও শাকসবজি এবং বাকি অংশে শস্যদানা ও আমিষ থাকা উচিত।
আমাদের চারপাশেই অন্ত্রের জন্য উপকারী অনেক উদ্ভিজ্জ খাদ্য পাওয়া যায়। কোনো নির্দিষ্ট সবজি অপছন্দ হলে তা জোর করে খাওয়ার দরকার নেই। শন স্পেন্সার বলেন, 'বাজারে অনেক ধরনের সবজি ও ফাইবারসমৃদ্ধ খাদ্য পাওয়া যায়। শুধু নিজের পছন্দের খাবারগুলো বেছে নেওয়াই যথেষ্ট।'