ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ধাক্কায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার হারাল মার্কিন শেয়ারবাজার

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কায় মার্কিন শেয়ারবাজারে বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকটি গত মাসের শীর্ষ অবস্থান থেকে প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার কমে গেছে। অথচ তখন ওয়াল স্ট্রিটে ট্রাম্পের বেশিরভাগ নীতি উদযাপিত হচ্ছিল।
ট্রাম্পের একের পর এক নতুন নীতির কারণে ব্যবসায়ী, ভোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। বিশেষ করে কানাডা, মেক্সিকো ও চীনের মতো প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদারদের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের ফলে এই অস্থিরতা আরও তীব্র হয়েছে।
ওয়েলথ এনহান্সমেন্টের সিনিয়র ইনভেস্টমেন্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট আয়াকো ইয়োশিওকা বলেন, "আমরা স্পষ্টভাবে একটি বড় মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। যেসব কৌশল আগে কাজ করছিল, সেগুলো এখন আর কার্যকর নয়।"
সোমবার মার্কিন শেয়ারবাজারে আরও বড় পতন দেখা গেছে। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকটি ২.৭ শতাংশ কমে গেছে, যা এ বছরের সবচেয়ে বড় দৈনিক পতন। নাসডাক কম্পোজিট ৪ শতাংশ কমেছে, যা ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পরবর্তী সর্বোচ্চ পতন।
ল্যাজার্ডের প্রধান নির্বাহী পিটার অরজাগ বলেন, "কানাডা, মেক্সিকো ও ইউরোপের সঙ্গে শুল্ক যুদ্ধ যে মাত্রার অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে, তাতে কোম্পানির বোর্ড ও শীর্ষ নির্বাহীরা ভবিষ্যতের পরিকল্পনা পুনর্বিবেচনা করছেন।"
তিনি আরও বলেন, "চীনের সঙ্গে চলমান উত্তেজনা মানুষ বুঝতে পারছে, কিন্তু কানাডা, মেক্সিকো ও ইউরোপের সঙ্গে এই দ্বন্দ্ব বিভ্রান্তি তৈরি করছে। আগামী এক মাসের মধ্যে এই সমস্যার সমাধান না হলে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও অধিগ্রহণ এবং একীভূতকরণ কার্যক্রমে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।"
সোমবার ডেল্টা এয়ারলাইনস তাদের প্রথম ত্রৈমাসিক মুনাফার পূর্বাভাস অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। এর ফলে কোম্পানির শেয়ারমূল্য পরবর্তী লেনদেনে ১৪ শতাংশ কমে গেছে। কোম্পানির প্রধান নির্বাহী এড বাস্তিয়ান এই পতনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাকে দায়ী করেছেন।
আইনপ্রণেতারা আংশিক ফেডারেল সরকার অচলাবস্থা এড়াতে তহবিল বিল পাস করতে পারেন কি-না, বিনিয়োগকারীরা এখন নজর রাখছেন সেটির ওপর। আগামী বুধবার প্রকাশিত হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির প্রতিবেদন।
বেয়ার্ডের বিনিয়োগ কৌশলবিদ রস মেফিল্ড বলেন, "ট্রাম্প প্রশাসন যেন বাজার পতনকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছে এবং এমনকি মন্দার আশঙ্কাকেও গুরুত্ব দিচ্ছে, যাতে তারা তাদের বৃহত্তর লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে। ওয়াল স্ট্রিটের জন্য এটি একটি বড় সতর্ক সংকেত।"
সেন্ট লুইস ফেডারেল রিজার্ভের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মোট কর্পোরেট ইকুইটি ও মিউচুয়াল ফান্ড শেয়ারের ৮৭ শতাংশ মালিকানা ছিল শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর হাতে। অথচ মোট কর্পোরেট ইকুইটি ও মিউচুয়াল ফান্ড শেয়ারের মাত্র ১ শতাংশ মালিকানা ছিল দেশের নিম্ন ৫০ শতাংশ সম্পদশালীদের হাতে।
এনভিডিয়া ও টেসলার মতো বড় প্রযুক্তি কোম্পানির কারণে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছিল। তবে ২০২৫ সালে এই শেয়ারগুলো পতন ঘটেছে। সোমবার এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকের প্রযুক্তি খাতের ৪.৩ শতাংশ পতন ঘটেছে। অ্যাপল ও এনভিডিয়া উভয়ের শেয়ার প্রায় ৫ শতাংশ কমেছে। টেসলার শেয়ার ১৫ শতাংশ কমে গিয়ে প্রায় ১২৫ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে।
অন্যদিকে, বিটকয়েনের মূল্য ৫ শতাংশ কমেছে এবং শেয়ারবাজারের কিছু নিরাপদ আশ্রয় খাত যেমন ইউটিলিটিজ ও সরকারি বন্ডের চাহিদা বেড়েছে।
বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ
এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ডোনাল্ড ট্রাম্প ৫ নভেম্বরের নির্বাচন জেতার পর যে সব লাভ করেছিল, তার সবই হারিয়েছে এবং এই সময়ে প্রায় ৩ শতাংশ নিচে নেমে গেছে।
গোল্ডম্যান স্যাকসের সোমবার প্রকাশিত এক নোটে বলা হয়েছে, গত শুক্রবার হেজ ফান্ডগুলো গত দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে শেয়ারের প্রতি তাদের ঝুঁকি কমিয়েছে।
বিনিয়োগকারীরা আশাবাদী ছিলেন যে, ট্রাম্পের প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধিমুখী নীতি, যার মধ্যে করছাড় এবং নিয়ন্ত্রণ শিথিলকরণের মতো পদক্ষেপ রয়েছে, তা শেয়ারবাজারের জন্য উপকারী হবে। তবে শুল্ক আরোপ এবং ফেডারেল কর্মীসংখ্যা কমানোসহ অন্যান্য পরিবর্তন নিয়ে অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের মনোভাবকে ম্লান করে দিয়েছে।
জোন্সট্রেডিং-এর প্রধান বাজার কৌশলবিদ মাইকেল ও'রুর বলেন, "প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি খুবই অনুকূল হবে—এটি ছিল সর্বসম্মত ধারণা। যখনই কাঠামোগত পরিবর্তন আসে, তখনই অনিশ্চয়তা এবং সংঘাত দেখা দেয়। মানুষের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হওয়া এবং মুনাফা তুলে নেওয়ার প্রবণতা দেখা দেওয়াটা স্বাভাবিক।"
এছাড়া, শেয়ারবাজারের দীর্ঘমেয়াদি গড় মূল্যবোধের তুলনায় এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকের মূল্য এখন ২১ গুণের সামান্য বেশি অবস্থানে রয়েছে, যা বাজার সংশোধনের আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
এজে বেল-এর বিনিয়োগ বিশ্লেষক ড্যান কোটসওয়ার্থ বলেন, "অনেক দিন ধরেই অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারের উচ্চ মূল্যমান নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং বাজার সংশোধনের জন্য উপযুক্ত কারণ খুঁজছিলেন। বাণিজ্য যুদ্ধ, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং অনিশ্চিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মিলেই সেই কারণ হয়ে উঠতে পারে।"