কিটামিন নেওয়ার অভিযোগ মাস্কের বিরুদ্ধে; মানব মস্তিষ্কে এর প্রভাব কী?

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে হোয়াইট হাউজে কর্মরত থাকা অবস্থায় ইলন মাস্ক নিয়মিত মাদক সেবন করতেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। মাস্কের ঘনিষ্ঠ সূত্রের বরাত দিয়ে টাইমস জানায়, তিনি নিয়মিত কিটামিন, এক্সটাসি এবং সাইকেডেলিক মাশরুম নিতেন।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে কনজারভেটিভ পলিটিক্যাল অ্যাকশন কনফারেন্সে তার উপস্থিতি বেশ আলোচিত হয়েছিল। সেখানে বক্তৃতার সময় তিনি কিছুটা হোঁচট খান এবং প্রশ্ন তোলেন যে ফোর্ট নক্সে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের সুরক্ষিত ভল্ট ভবন) আসলেই স্বর্ণ সংরক্ষিত আছে কি-না।
এছাড়াও, এক্স-এ তার গভীর রাতের পোস্ট, সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে পাঠানো ই-মেইল এবং টেলিভিশনে দেওয়া তার এলোমেলো মন্তব্য—এসব কারণেই জনমনে তার 'কিটামিন' গ্রহণের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
মাস্ক অবশ্য এর আগে স্বীকারও করেছেন যে, তিনি নিয়মিত কিটামিন গ্রহণ করেন। তবে তার দাবি, তার কাছে এর প্রেসক্রিপশন রয়েছে এবং তিনি দুই সপ্তাহে একবার 'সীমিত পরিমাণে' এই মাদক নেন।
২০২৪ সালের মার্চে সাংবাদিক ডন লেমনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'যদি আপনি খুব বেশি কিটামিন খান, তাহলে আসলে কাজ করা সম্ভব হয় না, আর আমার অনেক কাজ আছে।'
টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের বসন্ত নাগাদ মাস্ক তার ঘনিষ্ঠদের জানিয়েছিলেন, নিয়মিত কিটামিন সেবনের ফলে তার মূত্রথলিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে।
ফলে জনমনে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন—তিনি কী পরিমাণ কিটামিন গ্রহণ করেন, এটি তার আচরণকে কতটা প্রভাবিত করে, এবং তিনি আসক্তির পর্যায়ে পৌঁছেছেন কি না।
দ্য আটলান্টিক জানিয়েছে, কিটামিনকে 'ডিসোসিয়েটিভ ড্রাগ' বলা হয়। কারণ এটি গ্রহণের পর প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ব্যক্তি শরীর, আবেগ ও সময়ের প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করতে পারেন। নিয়মিত এবং অতিরিক্ত কিটামিন গ্রহণ মস্তিষ্কের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। যার ফলে স্মৃতিভ্রংশ, বিভ্রান্তিকর চিন্তাভাবনা, কুসংস্কারে বিশ্বাস এবং নিজেকে অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করার প্রবণতা তৈরি হতে পারে।
কিটামিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি ব্যবহারকারীদের বাস্তব জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে। ১৯৭০ সালে এটি অ্যানেসথেটিক হিসেবে অনুমোদিত হয়। কারণ এটি শ্বাস-প্রশ্বাসের ওপর তেমন প্রভাব না ফেলেই ব্যক্তিকে অচেতন করতে পারে।
১৯৯০-এর দশকে এটি 'স্পেশাল কে' নামে আনন্দদায়ক মাদক হিসেবে পরিচিতি পায়। ২০০০-এর দশকে গবেষকরা আবিষ্কার করেন যে, অল্প মাত্রার কিটামিন মস্তিষ্কের নিউরোন সংযোগে পরিবর্তন ঘটিয়ে বিষণ্ণতার লক্ষণ দ্রুত কমাতে পারে।
২০১৯ সালে মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) 'এসকিটামিন' (কিটামিনের একটি পরিবর্তিত রূপ) নামে একটি নাসাল স্প্রে অনুমোদন দেয়, যা 'স্প্রাভাটো' নামে বাজারজাত করা হয়। এটি কেবল চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এবং অনুমোদিত চিকিৎসাকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য সুপারিশ করা হয়।
তবে স্প্রাভাটোর অনুমোদনের পর সাধারণ কিটামিনের প্রেসক্রিপশনও ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। যেহেতু এটি ইতোমধ্যে অ্যানেসথেটিক হিসেবে এফডিএ অনুমোদিত, তাই 'অফ-লেবেল' (অনুমোদিত ওষুধের অননুমোদিত ব্যবহার) ব্যবহারে কোনো বাধা ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিশেষায়িত কিটামিন ক্লিনিক তৈরি হয়েছে, যেখানে ইনজেকশন ও লজেন্সের মাধ্যমে উদ্বেগ ও পিটিএসডির মতো মানসিক সমস্যার চিকিৎসা দেওয়া হয়। একটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে ২০২৩ সালে কিটামিন শিল্পের বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন ডলার।
ক্লিনিকের বাইরেও কিটামিনের জনপ্রিয়তা বেড়েছে, বিশেষত সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের মধ্যে। এমনকি এটি কিছু 'ওয়েলনেস রিট্রিট', নেতৃত্ব বিকাশ প্রশিক্ষণ, কর্পোরেট টিম বিল্ডিং কর্মশালা এবং দম্পতিদের কাউন্সেলিং সেশনেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
দীর্ঘমেয়াদি কিটামিন থেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এখনো পুরোপুরি গবেষণার আওতায় আসেনি। তবে অতিরিক্ত মাত্রায় বিনোদনমূলক ব্যবহারের কিছু প্রভাব সম্পর্কে পুরোনো গবেষণাগুলো থেকে ধারণা পাওয়া যায়। ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটারের মনোবিজ্ঞানী সেলিয়া মরগান ২০১০ সালে ১২০ জন কিটামিন ব্যবহারকারীর ওপর এক বছরের গবেষণা চালান।
গবেষণায় দেখা যায়, যারা মাসে মাত্র তিনবার কিটামিন গ্রহণ করতেন, তারাও তীব্র বিভ্রমমূলক চিন্তায় ভুগতেন। প্রাক্তন কিটামিন ব্যবহারকারী, অন্যান্য মাদক গ্রহণকারী এবং সম্পূর্ণ মাদকমুক্ত ব্যক্তিদের তুলনায় তাদের বিভ্রমের মাত্রা বেশি ছিল। আর যারা মাসে ২০ বার কিটামিন গ্রহণ করতেন, তাদের বিভ্রমের মাত্রা আরও বেশি ছিল।
কিটামিন ব্যবহারকারীদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বাস করেন যে তারা বিভিন্ন গোপন বার্তা পাচ্ছেন এবং আশেপাশের মানুষ তাদের সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন। মরগান ও তার দলের গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত কিটামিন ব্যবহারকারীদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিতে গভীর প্রভাব পড়ে এবং তারা ধীরে ধীরে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
তবে বিভ্রমপ্রবণ ব্যক্তিরাই বেশি কিটামিন গ্রহণ করেন কি না, তা গবেষণায় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। মরগান জানান, সাধারণত কিটামিন গ্রহণ বন্ধ করলে এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দ্রুত কমে আসে।
দীর্ঘদিন ধরে সাইকেডেলিক বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে আসছেন যে অতিরিক্ত কিটামিন ব্যবহারের ফলে মূত্রথলির গুরুতর ক্ষতি, তীব্র পেটব্যথা এবং ওষুধের প্রতি আসক্তি দেখা দিতে পারে। ১৯৯৪ সালে গবেষক ডি. এম. টার্নার লিখেছিলেন, 'অনেকেই কিটামিন গ্রহণ শুরু করার পর এটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামাতে পারেন না।'
নিউরোফিজিওলজিস্ট ও সাইকেডেলিক গবেষক জন লিলি একসময় ডলফিনের ভাষা বোঝার জন্য এলএসডি মাদক ব্যবহার করতেন। কিন্তু কিটামিনের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে ভিনগ্রহের প্রাণীরা তার পুরুষাঙ্গ নিয়ে গেছে।
মিয়ামিভিত্তিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডেভিড মাথাই কিছু রোগীর জন্য কিটামিন থেরাপি দেন। তিনি বলেন, 'দীর্ঘ সময় ধরে নিয়মিত উচ্চ মাত্রায় কিটামিন গ্রহণ করলে মানসিক ও স্নায়বিক সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।'
এ ধরনের সম্ভাব্য মানসিক দুর্বলতা যে কারও জন্যই উদ্বেগের কারণ হতে পারে। তবে বিশেষ করে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে, যাকে অনেকেই একরকম আমেরিকার সহ-রাষ্ট্রপতি বলেও অভিহিত করছেন, এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
অবশ্য কিটামিনের সঙ্গে মাস্কের আচরণের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই বলেও মনে হতে পারে। তিনি হয়তো কেবল তার কট্টর ডানপন্থী মতাদর্শের প্রতিফলন ঘটাচ্ছেন। মাস্ক নিজেও প্রচার করেন যে তিনি খুব কম ঘুমান, যা শান্ত ও পরিমিত আচরণ বজায় রাখার পথে অন্তরায় হতে পারে।
তবে কিটামিনের ঝুঁকি নিয়ে মাস্ক প্রকাশ্যে কখনো কথা বলেননি। যদিও একবার তিনি বলেছিলেন যে বিষণ্ণতার চিকিৎসায় ব্যবহৃত এসএসআরআই ওষুধ রোগীদের 'জম্বির মতো' করে ফেলে। কিটামিন টেলিমেডিসিন কোম্পানি 'মাইন্ডব্লুম'-এর প্রতিষ্ঠাতা ডিলান বেইনন সম্প্রতি এক্স-এ লিখেছিলেন, 'কিটামিন শারীরিকভাবে আসক্তিকর নয়। কিন্তু এসএসআরআই ওষুধ থেকে বের হওয়া অনেকের জন্য কঠিন।'
কিটামিন আফিম বা অ্যালকোহলের মতো শারীরিক আসক্তি তৈরি করে না। তবে মরগানের মতে, এর আসক্তির সম্ভাবনা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। এর প্রধান কারণ হলো, মানবদেহ খুব দ্রুত এ ওষুধের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। ২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যে দুই হাজারের বেশি মানুষ কিটামিন আসক্তির চিকিৎসা নিয়েছেন। কিটামিনের সবচেয়ে গুরুতর ঝুঁকিগুলো নির্ভর করে একজন ব্যক্তি কতদিন এবং কী পরিমাণ গ্রহণ করছেন তার ওপর।
সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তিপ্রেমীরা স্টয়িক দর্শনের প্রতি বরাবরই আকৃষ্ট। স্টয়িক দর্শন মতে, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, তা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া উচিত। এটি প্রতিকূলতার মোকাবিলার জন্য একটি কার্যকর উপায়, বিশেষ করে যেখানে (সিলিকন ভ্যালিতে) বেশিরভাগ স্টার্টআপ ব্যর্থ হয়। তবে এই দর্শনের অতিরিক্ত চর্চা মানুষকে বাস্তবতা ও আশপাশের সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে।
একইভাবে, কিটামিনও এর ব্যবহারকারীদের হতাশা কমাতে সাহায্য করে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মাথাই বলেন, এটি বাস্তবতা থেকে সাময়িকভাবে বিষণ্ণতা কমাতে পারে। তবে বাস্তবতা থেকে দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন থাকলে এর ফলাফল ভালো নাও হতে পারে।