ভারতের যুদ্ধবিমানের লড়াই: আকাশে আমেরিকা বনাম রাশিয়া

ভারত তার বিমান বাহিনী আধুনিকায়নের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু অত্যাধুনিক মার্কিন যুদ্ধবিমান কি সত্যিই সঠিক সমাধান হতে পারে? বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি।
গত ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটন সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় ট্রাম্প ঘোষণা দেন যে ভারতকে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান দেওয়ার পথ সুগম করা হচ্ছে।
এফ-৩৫ উন্নত সেন্সর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক যুদ্ধব্যবস্থা এবং নিরবচ্ছিন্ন ডেটা শেয়ারিং প্রযুক্তির সমন্বয়ে তৈরি একটি 'পঞ্চম প্রজন্মের' যুদ্ধবিমান। এটি রাডার ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এবং বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম উন্নত যুদ্ধবিমান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে, প্রতিটি বিমানের মূল্য প্রায় ৮০ মিলিয়ন ডলার, যা এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল যুদ্ধবিমানের একটি করে তুলেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের যুদ্ধবিমান বহরের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। অন্যদিকে, চীনের সামরিক শক্তি দ্রুত বাড়ছে, যা ভারতকে কঠিন সিদ্ধান্তের মুখে ফেলেছে—যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ব্যয়বহুল কিন্তু অত্যাধুনিক এফ-৩৫ কিনবে, না-কি রাশিয়ার স্টেলথ যুদ্ধবিমান সুখোই সু-৫৭ দেশীয়ভাবে উৎপাদনের পরিকল্পনা করবে।
তবে বাস্তবতা আরও জটিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে প্রতিযোগিতার এই আলোচনাটি মূলত সংবাদমাধ্যমেই বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। বিশেষ করে, গত মাসে ভারতের বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত 'অ্যারো ইন্ডিয়া' এয়ার শোতে দুই যুদ্ধবিমানের প্রদর্শনী এই বিতর্ককে আরও উসকে দিয়েছে।
কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর সিনিয়র ফেলো অ্যাশলি জে টেলিস মনে করেন, ট্রাম্পের এফ-৩৫ প্রস্তাব প্রতীকী ও বাস্তবসম্মত নয়। তিনি এটিকে মূলত মার্কিন অস্ত্র বিক্রির প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দেখছেন।
ভারতের বিমান বাহিনীর (আইএএফ) ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় 'পঞ্চম প্রজন্মের' যুদ্ধবিমান অন্তর্ভুক্ত করা সহজ হবে না, কারণ দেশটি ইতোমধ্যেই নিজস্ব উন্নয়নাধীন অ্যাডভান্সড মিডিয়াম কমব্যাট এয়ারক্রাফ্ট (এএমসিএ) ও ফরাসি রাফাল যুদ্ধবিমানকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (ডিআরডিও) এএমসিএ তৈরি করছে, যা ভারতের নিজস্ব স্টেলথ যুদ্ধবিমান হিসেবে পরিচিত।
টেলিস বলেন, 'আমেরিকা ভারতকে এফ-৩৫ স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের সুযোগ দেবে বলে মনে হয় না। এটি সরাসরি ক্রয়ের ভিত্তিতেই বিক্রি হবে, যা প্রধানমন্ত্রী মোদির "মেক ইন ইন্ডিয়া" নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর "এন্ড-ইউজার মনিটরিং" নীতিও ভারত সহজে গ্রহণ করবে না।'

এফ-৩৫-এর উচ্চমূল্য, জটিল রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনাগত চ্যালেঞ্জ ভারতের জন্য একটি বড় বাধা। নিরাপত্তা বিশ্লেষক স্টিফেন ব্রায়েনের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীতেই এই যুদ্ধবিমানের অপারেশনাল রেট মাত্র ৫১ শতাংশ।
তিনি প্রশ্ন তোলেন, 'ভারত কি মার্কিন বিমানে কয়েক বিলিয়ন রুপি বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত, যেখানে রাশিয়ার বিকল্প বিমান তুলনামূলক বেশি কার্যকর হতে পারে?'
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ সুখোই সু-৫৭-কে বাস্তব বিকল্প হিসেবেও দেখছেন না। প্রযুক্তি স্থানান্তর, খরচ ভাগাভাগি ও যুদ্ধবিমানের চূড়ান্ত স্পেসিফিকেশন নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে ভারত ২০১৮ সালে এই বিমান যৌথভাবে উৎপাদনের প্রকল্প থেকে বেরিয়ে আসে।
ভারতের বিমান বাহিনী ক্রমশ পুরনো হয়ে পড়ছে এবং পর্যাপ্ত যুদ্ধবিমানও নেই। বর্তমানে বাহিনীতে ৩১টি ফাইটার ও কমব্যাট স্কোয়াড্রন রয়েছে, যার বেশিরভাগই রুশ ও সোভিয়েত আমলের বিমান। অথচ অনুমোদিত স্কোয়াড্রনের সংখ্যা হতে পারবে সর্বোচ্চ ৪২টি পর্যন্ত।
ভারতের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো রাশিয়া থেকে কেনা সুখোই-৩০ যুদ্ধবিমানের দীর্ঘমেয়াদি বিকল্প খুঁজে বের করা।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) 'মিলিটারি ব্যালেন্স' রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে চীন তার বিমান বাহিনীতে ৪৩৫টি নতুন যুদ্ধবিমান ও গ্রাউন্ড অ্যাটাক এয়ারক্রাফ্ট যুক্ত করেছে, পাকিস্তান যুক্ত করেছে ৩১টি। অথচ একই সময়ে ভারতের বিমান সংখ্যা কমেছে ১৫১টি।
ভারত মূলত দেশীয় প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ যুদ্ধবিমান বহর সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে। দেশটির লক্ষ্যমাত্রা আগামী কয়েক বছরে ৫০০-এর বেশি নতুন যুদ্ধবিমান অন্তর্ভুক্ত করা, যার বেশিরভাগই হবে হালকা যুদ্ধবিমান।
ভারত ইতোমধ্যে ৮৩টি দেশীয় তেজাস মার্ক ১এ যুদ্ধবিমান অর্ডার করেছে এবং শিগগিরই আরও ৯৭টি কেনার পরিকল্পনা করছে। একই সঙ্গে, ভারী ও উন্নত সংস্করণ তেজাস মার্ক ২ বর্তমানে উন্নয়নাধীন। তবে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি স্টেলথ যুদ্ধবিমান এখনও অন্তত এক দশক দূরেই রয়েছে।
এছাড়া, আইএএফ ১১৪টি মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা করছে, যার জন্য ২০ বিলিয়ন ডলারের 'মাল্টি-রোল ফাইটার এয়ারক্রাফ্ট' (এমআরএফএ) প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তবে শর্ত হলো, বিদেশি সংস্থাগুলোকে প্রযুক্তি স্থানান্তরের ভিত্তিতে ভারতে এই বিমান উৎপাদন করতে হবে, যা একইসাথে ভারতের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।

২০১৯ সাল থেকে প্রকল্পটি স্থগিত রয়েছে। এর আগে, ভারত সরকার জি-টু-জি চুক্তির মাধ্যমে ৩৬টি রাফাল কেনার সিদ্ধান্ত নেয়, যা সমালোচনার মুখে পড়ে। এবার সরকার স্বচ্ছ ক্রয় প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে চায়। এখন পর্যন্ত পাঁচটি প্রতিদ্বন্দ্বী যুদ্ধবিমানের তালিকায় আইএএফ-এর পছন্দের শীর্ষে রয়েছে রাফাল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের বিমান বাহিনী আধুনিকীকরণ পরিকল্পনার পথে তিনটি প্রধান বাধা রয়েছে—অর্থায়নের ঘাটতি, দীর্ঘসূত্রিতা এবং বিদেশি যুদ্ধবিমানের ওপর নির্ভরতা।
প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় কমে যাওয়ায় বিদেশি যুদ্ধবিমান কেনার প্রকল্প দীর্ঘায়িত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ভারত নিজস্ব প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিলেও ডিআরডিওর দীর্ঘসূত্রিতা বারবার বিদেশি বিকল্পের দিকে দেশটিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ইউরেশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষক রাহুল ভাটিয়ার মতে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতির সঙ্গে ভারতীয় বিমান বাহিনীর চাহিদার ফারাক বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তেজাস মার্ক ১ শুরুতে বিমান বাহিনীর সমালোচনার মুখে পড়ে, যার ফলে উন্নত সংস্করণ মার্ক ১এ ও মার্ক ২-এর উন্নয়ন শুরু হয়। তবে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন চক্র সশস্ত্র বাহিনীর জন্য হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভাটিয়া বলেন, 'প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ক্রমাগত উন্নত হওয়ায় বাহিনীর প্রয়োজনীয়তাও বদলাচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘ উন্নয়ন প্রক্রিয়াতে নতুন চাহিদাগুলোও যুক্ত হতে থাকে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে আরও দেরি হয়।'
সম্প্রতি এক সেমিনারে বিমান বাহিনী প্রধান এপি সিংহ হতাশা প্রকাশ করে বলেন, 'আমি যদি শপথ নিই যে বাইরের কিছু কিনব না বা শুধুমাত্র ভারতীয় প্রযুক্তির অপেক্ষা করব, তাহলে সেটা বাস্তবে সম্ভব নাও হতে পারে।'
তিনি মূলত তেজাস মার্ক ১এ-এর সরবরাহে দেরির ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। এটি গত ফেব্রুয়ারিতে সরবরাহ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখনও হয়নি।
ভারত দেশীয় স্টেলথ যুদ্ধবিমান প্রকল্পের উন্নয়নে ইতোমধ্যে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি বরাদ্দ দিয়েছে। বিশ্লেষক ভাটিয়ার মতে, জরুরি নিরাপত্তা পরিস্থিতির উদ্ভব হলে ভারত বিদেশি স্টেলথ যুদ্ধবিমান কেনার কথা বিবেচনা করতে পারে। তবে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই মনে করেন, ভারত শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার কোনো বিমানই কিনবে না।
ভারতের আকাশ-শক্তির ভবিষ্যৎ শুধুমাত্র যুদ্ধবিমান কেনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর মূল লক্ষ্য নিজস্ব প্রযুক্তিতে যুদ্ধবিমান তৈরি করা। তবে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য দেশীয় যুদ্ধবিমান নির্ধারিত সময়ে সরবরাহ নিশ্চিত করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।