মাথার চুল বদলে ফেলতে জুড়ি নেই ইস্তাম্বুলের ক্লিনিকগুলোর, তবে পড়তির দিকে রমরমা

ইস্তাম্বুলের ব্যস্ত শহরে মাথায় রক্তের দাগ আর ব্যান্ডেজ পরা পুরুষদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। কেউ বাজারের রাস্তায়, কেউ শহরের বিখ্যাত স্থাপনার সামনে ছবি তোলেন। চুল প্রতিস্থাপনের পর এমন দৃশ্য এখানে খুবই সাধারণ।
ইউরোপ ও এশিয়াকে সংযোগকারী বসফরাস প্রণালীর তীরে অবস্থিত ইস্তাম্বুল এখন বিশ্বজুড়ে চুল প্রতিস্থাপনের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। শহরটিতে প্রায় পাঁচ হাজার ক্লিনিক রয়েছে। শীতকাল এই ক্লিনিকগুলোর জন্য সবচেয়ে ব্যস্ত সময়। তবে এখন প্রশ্ন উঠেছে—ইস্তাম্বুল কি এই খেতাব ধরে রাখতে পারবে?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে রোগীরা চুল প্রতিস্থাপনের জন্য এখানে আসেন। সুইজারল্যান্ডের জুরিখ থেকে আসা ২৭ বছর বয়সী আয়দিন কেস্তি তেমনই একজন। তিনি ক্লিনিকে শুয়ে আছেন, ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া হয়েছে, আর বিশেষজ্ঞরা তার মাথার ত্বকে নিখুঁতভাবে চুলের ফলিকল প্রতিস্থাপন করছেন।
কেস্তি জানান, মূলত আত্মবিশ্বাস বাড়াতেই তিনি এই চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসার পাশাপাশি ইস্তাম্বুলে ছুটি কাটানোর সুযোগও নিচ্ছেন তিনি। শহরের সুনাম এবং এক বন্ধুর সুপারিশ পেয়ে তিনি আসমেড ক্লিনিক বেছে নিয়েছেন।
তবে ইস্তাম্বুলের হাসপাতালগুলো এখন শুধু মাথার চুল নিয়েই কাজ করছে না। দাড়ি, গোঁফ, ভ্রু এমনকি বুকের চুল প্রতিস্থাপনের চাহিদাও বাড়ছে। কিছু ক্লিনিকে চুল প্রতিস্থাপনের পাশাপাশি নাকের আকার পরিবর্তনসহ অন্যান্য প্রসাধনী শল্যচিকিৎসার ব্যবস্থাও রয়েছে।
ড. সেরকান আয়গিন ক্লিনিকের তথ্যমতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চুল প্রতিস্থাপনের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। আধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত এই ক্লিনিক যেন এক রকম কারখানায় পরিণত হয়েছে। এটিতে প্রবেশ করলে দেখা যায়, পুরুষরা মাথা শেভ করে পরবর্তী ধাপের জন্য লাউঞ্জে অপেক্ষা করছেন। আর যাদের অস্ত্রোপচার শেষ হয়েছে, তাদের মাথায় এখনো তাজা রক্তের দাগ স্পষ্ট।
একসময় গোপনে চুল প্রতিস্থাপন করা হতো, কিন্তু এখন এটি সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে। অনেক রোগী সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের নতুন হেয়ারলাইন দেখাচ্ছেন, আর ক্লিনিকগুলো মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের মাধ্যমে নিজেদের প্রচার বাড়াচ্ছে। দীর্ঘদিনের প্রচলিত ধারণা ভেঙে দিয়ে এখন নারীরাও চুল প্রতিস্থাপনের দিকে ঝুঁকছেন।

তবে সবার অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। অনলাইনে অনেকে অভিযোগ করেন, অস্ত্রোপচারের পর চুল ভুল দিকে বাড়ছে, ঘনত্ব আশানুরূপ হচ্ছে না কিংবা কয়েক বছর পর প্রতিস্থাপিত চুল পড়ে যাচ্ছে। তবু তুরস্কের স্বাস্থ্য পর্যটন খাত এখনো সুনাম বজায় রেখেছে।
২০২৩ সালে প্রায় ১৫ লাখ স্বাস্থ্য পর্যটক তুরস্কে যান, যার মধ্যে চুল প্রতিস্থাপন ছিল দ্বিতীয় সর্বাধিক চাহিদাসম্পন্ন চিকিৎসা।
আসমেড ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাতা ও চিকিৎসক কোরায় এরদোয়ান জানান, ইস্তাম্বুলে ভালো-মন্দ দুই ধরনের ক্লিনিকই রয়েছে। ২০০১ সালে তিনি যখন তার ক্লিনিক চালু করেন, তখন প্রচলিত পদ্ধতিতে মাথার পেছন থেকে চামড়ার বড় অংশ কেটে চুল প্রতিস্থাপন করা হতো। ২০০০-এর দশকের শুরুতে তার ক্লিনিক প্রথমবারের মতো পৃথক চুলের ফলিকল প্রতিস্থাপনের পদ্ধতি চালু করে, যা দাগ পড়ার ঝুঁকি কমিয়ে আনে।
তিনি এই পদ্ধতিকে চুল প্রতিস্থাপনে 'বিপ্লব' হিসেবে উল্লেখ করেন।
তুরস্কে এটি দ্রুত জনপ্রিয় হলেও ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকরা শুরুতে সন্দিহান ছিলেন। ২০১১ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রযুক্তি উপস্থাপন করলেও কেউ তখন গুরুত্ব দেয়নি।
এরদোয়ান মনে করেন, এই অবস্থাই তুরস্কের জন্য সুযোগ তৈরি করেছে। নতুন প্রযুক্তির প্রতি খোলা মনোভাব ও তুলনামূলক কম খরচের অস্ত্রোপচার তুরস্ককে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রেখেছে।
তবে সময় বদলাচ্ছে। দেশটির স্বাস্থ্য পর্যটন খাত আশানুরূপ বাড়ছে না। তুরস্কের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশটি স্বাস্থ্য পর্যটন থেকে প্রায় ২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে, যা আগের তুলনায় অনেক কম।
এদিকে, ইউরোপের হাসপাতালগুলোতে এখন মাত্র ২,০০০ ডলারে চুল প্রতিস্থাপন সম্ভব, যা কয়েক বছর আগেও কল্পনা করা যায়নি। এতে তুরস্কে রোগীদের আসার প্রবণতা কমছে। এরদোয়ান মনে করেন, তুরস্কের এই স্বর্ণযুগ হয়তো শেষের পথে।