বাড়ছে অতি সংবেদনশীল মা-বাবা, সন্তানের ওপর তার প্রভাব যেমন পড়ে

যে কোনো শিশুর অভিভাবকের কাছে জানতে চাইলে তারা স্বীকার করবেন, কখনো কখনো অভিভাবকত্ব বেশ চাপের হয়ে ওঠে। এমনকি শান্তিপূর্ণ পরিবারেও মাঝে মাঝে এমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, যা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। এতে অভিভাবকেরা ক্লান্ত ও বিরক্ত বোধ করেন। স্বাভাবিকভাবেই শিশুরা চঞ্চল স্বভাবের হয় এবং প্রায়ই চিৎকার-চেঁচামেচি করে। খবর বিবিসি'র।
এটি স্বাভাবিক মনে হলেও, কিছু অভিভাবকের জন্য পারিবারিক জীবন অন্যদের তুলনায় বেশি চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। ২০১৮ সালের এক গবেষণা অনুসারে, বিশ্বের প্রায় ২০-৩০ শতাংশ মানুষ অত্যন্ত সংবেদনশীল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য আরও বেশি স্বীকৃতি পাচ্ছে।
সংবেদনশীলতা সাধারণত গন্ধ, আলো, শব্দ কিংবা অন্যান্য পরিবেশগত উপাদানের প্রতি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রবণতাকে বোঝায়। এ ধরনের ব্যক্তিরা উজ্জ্বল আলো বা উচ্চ শব্দ সহ্য করতে পারেন না, বিশৃঙ্খল পরিবেশে অস্বস্তি বোধ করেন। পাশাপাশি, তারা অন্যের আবেগ গভীরভাবে উপলব্ধি করেন এবং সহজেই সহমর্মিতা প্রকাশ করেন।
যখন অভিভাবকত্বের দায়িত্ব এর সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে ওঠে। প্রতিদিনের ইন্দ্রিয়গত ও আবেগজনিত চাপের পাশাপাশি সংবেদনশীল অভিভাবকদের সন্তানদের নিয়েও বাড়তি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়—বিশেষ করে যদি শিশুটিও সংবেদনশীল হয়। গবেষণা বলছে, সংবেদনশীলতা প্রায় ৪৭ শতাংশ ক্ষেত্রে বংশগত।
তবে এই বৈশিষ্ট্যের ইতিবাচক দিকও রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, অত্যন্ত সংবেদনশীল ব্যক্তিরা যদি নিজেদের এই প্রবণতাকে ভালোভাবে বুঝতে পারেন, তাহলে অভিভাবকত্বের অভিজ্ঞতা চাপের পরিবর্তে আনন্দদায়ক হয়ে উঠতে পারে।
প্রথমেই জানা দরকার, আপনি নিজে সংবেদনশীল কি না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানীরা সংবেদনশীলতা নির্ণয়ের জন্য একটি বিনামূল্যের অনলাইন পরীক্ষা তৈরি করেছেন। তবে সংবেদনশীলতা কোনো মানসিক সমস্যা নয়; এটি ব্যক্তিত্বের একটি বৈশিষ্ট্য, যা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মানুষের প্রতিক্রিয়া জানানোর ধরনকে নির্দেশ করে। সংবেদনশীল ব্যক্তিরা সাধারণত ইন্দ্রিয়গত উদ্দীপনার প্রতি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান, যা 'সংবেদন প্রক্রিয়াকরণ সংবেদনশীলতা' নামে পরিচিত।
লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির বিকাশমূলক মনোবিজ্ঞানী মাইকেল প্লুয়েস ব্যাখ্যা করেন, 'সংবেদনশীল ব্যক্তিরা সাধারণত পরিবেশকে খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তারা অন্যের আবেগ সহজেই বুঝতে পারেন এবং গভীর সহমর্মিতা অনুভব করেন। পাশাপাশি, তারা অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে বেশি চিন্তাভাবনা করেন, যা তাদের পরিবেশ সম্পর্কে আরও গভীর উপলব্ধি দেয়।'
অর্থাৎ সংবেদনশীল ব্যক্তিরা তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ভাবেন, ফলে তারা যা দেখেন বা অনুভব করেন, তা তাদের গভীরভাবে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক সংবেদনশীল ব্যক্তি ভৌতিক সিনেমা সহ্য করতে পারেন না।
গবেষণায় দেখা গেছে, সংবেদনশীল ব্যক্তিদের মস্তিষ্ক তুলনামূলকভাবে কম সংবেদনশীল ব্যক্তিদের চেয়ে ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, যা বৈজ্ঞানিকভাবে পরিমাপযোগ্য।
একটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের সুখী ও দুঃখী মানুষের ছবি দেখিয়ে এফএমআরআই স্ক্যানের মাধ্যমে তাদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করা হয়। দেখা গেছে, কম সংবেদনশীলদের তুলনায় সংবেদনশীল ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের 'সচেতনতা ও সহমর্মিতার সঙ্গে সম্পর্কিত অংশ' বেশি সক্রিয় ছিল। অন্যান্য গবেষণাতেও একই ধরনের ফলাফল পাওয়া গেছে।
প্লুয়েস বলেন, 'তথ্য গভীরভাবে বিশ্লেষণের প্রবণতা সংবেদনশীল মানুষকে সহজেই অতিরিক্ত উদ্দীপ্ত করে তুলতে পারে। কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ তাদের জন্য শারীরিকভাবে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠতে পারে।'
'শব্দের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা বাবা-মায়ের জন্য বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। আমার সন্তানরা চিৎকার করলে মনে হয়, যেন মস্তিষ্কের ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটছে। তবে তাদের চাহিদার প্রতি সাড়া দিতে আমাকে এই অনুভূতি সাময়িকভাবে উপেক্ষা করতে শিখতে হয়েছে। এটি তখনই সহজ হয়, যখন আমি পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে পারি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাবা-মা হওয়ার প্রথম কয়েক বছর ঘুমের অভাব অবধারিত।'—বলছেন প্লুয়েস।
অত্যন্ত সংবেদনশীল বাবা-মায়েরা বিশৃঙ্খল পরিবেশে অতিরিক্ত উদ্দীপনার কারণে বাড়তি চাপে থাকেন, যা কখনো কখনো তাদের অভিভাবকত্বের পথে চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন বাবা-মা হওয়ার শুরুর সময়ে সংবেদনশীল অভিভাবকেরা তুলনামূলকভাবে বেশি মানসিক চাপ অনুভব করেন এবং অনেক ক্ষেত্রে এ দায়িত্বকে অন্যদের চেয়ে কঠিন বলে মনে করেন। তবে একই সঙ্গে তারা সন্তানের প্রতি গভীর সংযুক্তিও অনুভব করেন।
নতুন এক গবেষণা বলছে, সংবেদনশীল বাবা-মায়েদের জন্য এই চাপ স্থায়ী হয় না। ২০২৩ সালের আগস্টে ইউরোপীয় ডেভেলপমেন্টাল সাইকোলজি কনফারেন্সে উপস্থাপিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, সংবেদনশীল বাবা-মায়েরা সন্তানের জন্মের পর প্রথম দিকে বেশি চাপে থাকলেও, যখন শিশুটি নয় মাস বয়সে পৌঁছে, তখন তারা তুলনামূলকভাবে আরও দক্ষ অভিভাবক হয়ে ওঠেন।
এই গবেষণায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে—শৈশবে পাওয়া নেতিবাচক অভিজ্ঞতা সংবেদনশীল বাবা-মায়ের অভিভাবকত্বের ধরনকে প্রভাবিত করতে পারে। গবেষক ফ্রান্সেস্কা লিওনেত্তি বলেন, 'যদি কেউ শৈশবে বাবা-মায়ের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে থাকেন, তবে পরবর্তীতে তারা নিজের সন্তানদের প্রতি বেশি হস্তক্ষেপমূলক আচরণ করতে পারেন এবং অভিভাবকত্বের সময় মানসিক চাপেও ভুগতে পারেন।'
তবে তিনি এটাও স্পষ্ট করেছেন, 'অত্যন্ত সংবেদনশীল বাবা-মা হওয়া কোনো দুর্বলতা নয়।' বরং ছোটখাটো বিষয়েও সংবেদনশীল হওয়া ভালো অভিভাবকত্বের জন্য ইতিবাচক হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, সংবেদনশীল বাবা-মায়েরা যখন নিজেদের শ্বাস-প্রশ্বাস ও শারীরিক প্রতিক্রিয়ার প্রতি মনোযোগ দেন, তখন তারা আরও ভালোভাবে সন্তানকে সামলাতে পারেন।
মনোবিজ্ঞানী মাইকেল প্লুয়েস বলেন, 'সংবেদনশীল ব্যক্তিরা স্বল্প সময়ের জন্য পরিবেশের পরিবর্তনে বেশি প্রভাবিত হন।' তবে তিনি এটাও মনে করেন, 'অত্যন্ত সংবেদনশীল বাবা-মায়েরা ব্যতিক্রমী অভিভাবক হয়ে উঠতে পারেন। তাদের সংবেদনশীলতা সন্তানকে আরও গভীরভাবে বোঝার সক্ষমতা বাড়ায় এবং তাদের চাহিদার প্রতি দ্রুত ও সঠিকভাবে সাড়া দিতে সাহায্য করে।'
অবশ্য শুধু সংবেদনশীল ব্যক্তিরাই নয়, অভিভাবকত্বের চাপে যে কেউই বিধ্বস্ত হতে পারেন। তাই সংবেদনশীল বাবা-মায়েদের জন্য কার্যকর কৌশলগুলো সব অভিভাবকের জন্যই উপকারী হতে পারে।
যেমন, নিজের আবেগ ও প্রতিক্রিয়াগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং কী কী আমাদের চাপ বাড়ায় বা প্রশান্তি দেয়, তা জানা। প্লুয়েস বলেন, 'আত্মসচেতনতা আমাদের অভিভাবকত্বের ইতিবাচক ও চ্যালেঞ্জিং দিকগুলোকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তোলে এবং যখন আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকি, তখন শান্ত থাকার উপায় খুঁজে পেতে সাহায্য করে।'
তিনি আরও বলেন, 'সংবেদনশীল ব্যক্তিরা সামাজিক সহায়তা থেকে বেশি উপকৃত হন।' গবেষণায় দেখা গেছে, অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য বিভিন্ন থেরাপি ও প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচিতে তুলনামূলকভাবে ভালো সাড়া দেন, যা তাদের মানসিক সহনশীলতা বাড়ায়। একইভাবে, সংবেদনশীল শিশুরাও বুলিং প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ থেকে অন্যদের তুলনায় বেশি উপকৃত হয়।
সংবেদনশীল ব্যক্তিদের প্রায়শই 'অর্কিড' বলা হয়, কারণ অনুকূল পরিবেশ না পেলে অর্কিডের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। অন্যদিকে, তুলনামূলকভাবে কম সংবেদনশীল ব্যক্তিদের 'ড্যান্ডেলিয়ন' বলা হয়, কারণ তারা যে কোনো পরিবেশে সহজে মানিয়ে নিতে পারেন। তবে উভয়েরই বিকাশের জন্য আলো ও উষ্ণতার প্রয়োজন হয়। আপাতদৃষ্টিতে 'ড্যান্ডেলিয়ন' প্রকৃতির মনে হলেও, কেউ হয়তো ভেতরে 'অর্কিড'-সুলভ সংবেদনশীলতা ধারণ করতে পারেন।
এই উপমাটি বোঝায় যে, আমাদের মানসিক বিকাশের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব। অভিভাবকদের ভূমিকা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ—সঠিক অভিভাবকত্ব একটি শিশুর জীবনকে 'অর্কিড-বান্ধব' করে তুলতে পারে।