'৯ মাসেও ছেলেকে কোলে নিতে পারিনি'—ভারতীয় ভিসা জটিলতায় বিপর্যস্ত পরিবারগুলো

যশোরের আরিফ বিল্লাহ। পেশায় ইন্টেরিয়র ডিজাইনার। অনলাইনে পরিচয় থেকে ভারতের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার এক মেয়েকে ২০২৩ সালে বিয়ে করেন তিনি। দুই পরিবারের সম্মতিতেই বিয়ে হয় দুজনের।
কিন্তু গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে শত চেষ্টা করেও ভারতের ভিসা পাচ্ছেন না আরিফ। ভিসার জন্য তিনি ভারতীয় দূতাবাসেও গিয়েছেন, তাতেও কাজ হয়নি। তাই তিনি ভারতে যেতে পারছেন না এবং তার ছেলেরও পাসপোর্ট করাতে পারছেন না। এ কারণে তার স্ত্রী-ছেলেও বাংলাদেশে আসতে পারছেন না।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নিজের হতাশা প্রকাশ করেন আরিফ। তিনি বলেন, 'আমি এমন এক হতভাগা বাবা যে সন্তান হওয়ার ৯ মাস পরেও ছেলেকে কোলে নিতে পারিনি।'
তিনি আরও বলেন, 'আমার ছেলে হওয়ার সময় আমার স্ত্রী ও আমি দুজন দুই জায়গায়। গত ৭ মাস ধরে ভারতীয় ভিসার স্লট নেওয়ার জন্য চেষ্টা করছি। কিন্তু সীমিত পরিসরে স্লটের কারণে আমি ভিসার আবেদন জমা দিতে পারছি না। এই সময় ভিসা পাওয়াটা আমার খুবই জরুরি। কারণ, আমার স্ত্রী এক বছর ধরে ভারতে আটকে আছেন।'
আরিফ বলেন, `আমার ছেলের কোনো ট্রাভেল ডকুমেন্ট না থাকায় স্ত্রীকে এতোদিন ভারতে থাকতে হচ্ছে। আর ছেলের পাসপোর্ট করাতে হলে আমাকেও পাসপোর্ট অফিসে থাকা লাগবে, যেহেতু আমি ভিনদেশি। পাসপোর্ট-ভিসা না হলে সে বাংলাদেশে আসতে পারছে না। আর এদিকে আমিও এই ভিসা জটিলতায় ভারতে যেতে পারছি না। এমন অসহায়ত্বের মধ্যে দিনানিপাত হচ্ছে সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।'
ভারতীয় ভিসা জটিলতায় বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশি ও ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যকার শতাধিক আন্তদেশীয় পরিবার। ভিসা আবেদনে স্লট না পাওয়া, ভিসা প্রত্যাখান হওয়াসহ একাধিক কারণে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে পারছে না ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।
এমনকি গর্ভবতী স্ত্রীকে চিকিৎসা করাতে না পারা, সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের কাছে না থাকতে পারার বিড়ম্বনাও জানা গেছে কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিকের কাছে। জানা গেছে এরকম পরিবারের সংখ্যা দুই শতাধিক।
এ রকমই একজন ঢাকার কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা মো. রুবেল হোসেন। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আমার স্ত্রী বর্তমানে ৭ মাসের গর্ভবতী। এ মুহূর্তে তার পাশে থাকা খুব প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে ভিসা জটিলতার কারণে আমি গত ১৫ দিন চেষ্টা করেও ভিসা আবেদন জমা দেওয়া জন্য স্লট পাইনি। এদিকে ভারতীয় এন্ট্রি এক্স-১ ভিসা পেতে গেলে ম্যারেজ সার্টিফিকেট ভারতীয় হাইকমিশন থেকে এটাস্টেড করা লাগে। সেখানে ভারতীয় স্পাউসকে উপস্থিত থাকতে হয়। আমার স্ত্রী এই অবস্থায় জার্নি করে বাংলাদেশে এসে সব কাজ শেষ করল।
তিনি আরো বলেন, এরপর ১৫ দিন ধরে স্লট না পেয়ে আমি ভারতীয় হাইকমিশনে একটি অনুরোধপত্রসহ ফাইল জমা করলাম। কিন্তু এখনও সেখান থেকে কোনো উত্তর পাইনি।
তিনি বলেন, 'বর্তমানে আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। এই মুহূর্তে যদি আমি ভিসা না পাই, তাহলে তাকে একা কীভাবে ভারতে পাঠাবো এবং বাকি কাজ সম্পন্ন করব।'
তিনি উল্লেখ্য করেন, বিয়ের কাগজপত্র সত্যায়ন বা আনুষঙ্গিক কাজগুলো যদি ভারতীয় হাইকমিশন সহজ করত, তাহলে সবাই উপকৃত হতো। কারণ বিগত দিনের তুলনায় গত বছর থেকে পার্শ্ববর্তী দুই দেশে বিয়ের প্রবণতা বেড়েছে।
রুবেল আরো বলেন, আমি ভারতীয় হাই কমিশনকে অনুরোধ করব যেন তারা এন্ট্রি এক্স-১ ভিসার জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা করেন। তাহলে এ পরিস্থিতিতে দুই দেশের যারা পারিবারিকভাবে সম্পৃক্ত, তারা উপকৃত হবেন।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা মনিকুল মশিহুর বলেন, 'আমি ২০২২ সাল থেকে এন্ট্রি এক্স-১ ভিসাতে ভারত যাতায়াত করি। বর্তমানে চলমান এই পরিস্থিতিতে আমার দুই বছর বয়সি মেয়েকে নিয়ে বিপাকে পড়েছি। মেয়েসহ আমার ভিসা শেষ হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে। তখন থেকেই আমার মেয়েসহ আমি রাজশাহীতে।
তিনি বলেন, 'তিনবার ফাইল জমা করেছি। কিন্তু প্রতিবারই ভিসা ছাড়াই শুধু পাসপোর্ট ফেরত এসেছে। আমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে রাজশাহী সহকারী হাই কমিশনারের কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে আমাকে বলা হলো স্যার নেই তাই আমরা কিছু বলতে পারছি না।'
তিনি আরও বলেন, 'আমার শ্বশুর বেঁচে নেই। আমার একমাত্র শ্যালক গত ডিসেম্বরে স্ট্রোক করে শয্যাগত। এদিকে ব্লাড সুগার ও প্রেসার বেড়ে আমার শাশুড়িও হাসাপাতালে ভর্তি। আমার স্ত্রী কোনো রকম একদিনের জন্য গিয়ে মাকে দেখেই আবার ফিরে এসেছেন। শুধু ছোট বাচ্চার জন্য আমার স্ত্রী তার মায়ের কাছে থাকতে পারে নাই।'
মশিহুর বলেন, 'এসব কারণে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। সে গত ৪ মাস ধরে বাংলাদেশে। সে শুধু অপেক্ষা করছে কবে মেয়ের ভিসা হবে আর মায়ের কাছে যাবে।'
তিনি বলেন, 'আমি রাজশাহীতে ভিসা না পেয়ে ঢাকায় ফাইল জমা দেওয়ার জন্য গত ৩৫ দিন ধরে চেষ্টা করেও স্লট পাইনি। পরে গত ৪ মার্চ ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের কার্যালয়ে একটি অনুরোধপত্রসহ ফাইল জমা করেছি। কিন্তু এখনো কোনো ফোন পাইনি।'
তিনি বলেন, ভারতীয় হাইকমিশন যদি এন্ট্রি এক্স-১ ভিসার আবেদন জমার বিষয়টি অন্য সব ক্যাটাগরি থেকে আলাদা করে, তাহলে আমরা উপকৃত হব। কারণ আমাদের একটা ইন্দো-বাংলা গ্রুপ আছে সেখানে ২৫০ জনেরও বেশি সদস্য যারা কোনো না কোনোভাবে সমস্যার মধ্যে আছেন।
অনন্ত স্পাউসদের কথা ভেবে হলেও ভারতীয় হাইকমিশন একটা সুন্দর ও সহজ সমাধান করবে বলে আশা প্রকাশ করেন মশিহুর।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের জানানো হয়নি। যেহেতু ভিসা প্রদানের বিষয়টি একান্তই ভারতের ব্যাপার, এরপরেও আমাদের কিছু প্রচেষ্টা থাকবে। তবে এই জটিলতায় ভারতীয় নাগরিকদের স্বার্থও জড়িত আছে। সুতরাং তারাও এগিয়ে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে বিষযটি সহজ হবে।