ইউক্রেনের যে পাঁচ দিকের প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেওয়ার মুখে রাশিয়া

রুশ বাহিনীর একের পর এক আক্রমণ ঠেকাতে দিশেহারা হয়ে লড়ছে ইউক্রেন। গত শনিবার ভোরে ইউক্রেনীয়দের দীর্ঘদিনের শক্তঘাঁটি আভদিভকাও দখল করেছে রুশ সেনারা। গত বছরের মে মাসের পর এটি ইউক্রেনে মস্কোর প্রথম বড় জয়ের ঘটনা। মে মাসে বাখমুতের পতন ঘটে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্ত্ররীণ রাজনীতিতে ইউক্রেনকে সহায়তা পাঠানোর বিরোধিতা করছে রিপাবলিকান দল। পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ বা কংগ্রেসে তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, যাদের বাধার মুখে ইউক্রেনকে আগের মতো ঢালাও সহায়তা দিতে পারছে না ওয়াশিংটন। ফলে ৬০০ মাইল দীর্ঘ সম্মুখসারিতে মোতায়েন থাকা ইউক্রেনীয় সেনারা গোলাবারুদের অভাবে ভুগছে। টানা দুই বছরের যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ সেনাও হারিয়েছে ইউক্রেন, সে জায়গায় নতুন সেনা ভর্তি করতেও ব্যাপক সমস্যার মধ্যে পড়েছে।
এদিকে ফ্রন্টলাইনের পাঁচ জায়গায় আসছে রুশ আক্রমণ। এসব শহর বা মফস্বল অবস্থিত ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণ অংশে। যা কেন্দ্র করে লড়াই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আসছে গ্রীষ্মে ইউক্রেন কতদিন টিকে থাকতে পারবে, তা অনেকটাই নির্ভর করছে এই লড়াইগুলোর ফলাফলের ওপর।

১. আভদিভকা
ইউক্রেনীয়দের দীর্ঘদিনের এই শক্তঘাঁটি দখল করেছে রাশিয়া। কিন্তু, মস্কো পেয়েছে কেবল ধ্বংসস্তূপ। লড়াইয়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া আভদিভকা শহর ১২ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত।
যুদ্ধের সম্মুখভাগে অস্ত্র ও রসদ সরবরাহে আভদিভকা গুরুত্বপূর্ণ রাশিয়ার জন্য। ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া সমর্থিত বিদ্রোহীদের দখলে থাকা দনেৎস্ক থেকে এর দূরত্ব মাত্র কয়েক মাইল।
বিগত কয়েক সপ্তাহে এখানে ইউক্রেনীয়দের একটি গুরুত্বপূর্ণ রসদ সরবরাহের লাইনে অনুপ্রবেশ করে রুশ সেনারা। ফলে তাঁরা ইউক্রেনীয় সেনাদের ঘিরে ফেলার মতো হুমকি তৈরি করে। এই অবস্থায়, ইউক্রেনীয় বাহিনীর পিছু হটা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না বলে জানান দক্ষিণাঞ্চলে ইউক্রেনীয় বাহিনীর প্রধান ওলেক্সান্ডার তার্নাভস্কি।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, পরিস্থিতি এতোটা ভয়াবহ যে শত্রু বাহিনী তাঁদের নিজ সেনাদের লাশ মাড়িয়ে অগ্রসর হচ্ছে, গোলা নিক্ষেপে ওরা ১০:১ অনুপাতে এগিয়ে, এই অবস্থায় সেনা প্রত্যাহারই একমাত্র সমাধান।
এখন আভদিভকার বাইরেও রুশ সেনারা অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করবে কিনা– অথবা সেটি ঠেকাতে ইউক্রেনীরা তাদের পেছনের প্রতিরোধ সারিগুলো কতোটা ভালোভাবে প্রস্তুত করতে পেরেছে- সেটি বড় প্রশ্ন। আভদিভকা থেকে মাত্র ৩৫ মাইল পশ্চিমেই রয়েছে লাখখানেক বাসিন্দার বড় একটি ইউক্রেনীয় জনপদ।
আভদিভকায় লড়াই করার জন্য প্রায় ৫০ হাজার রুশ সেনাকে মোতায়েন করা হয়। লড়াইয়ে কয়েক হাজার রুশ সেনা হতাহত হয়েছে বলে দাবি করেছে পশ্চিমা ও ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা। তবে বিপুল হতাহতের পরেও, মস্কো দ্রুতই নতুন সেনা পাঠিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করেছে।
রুশ সেনারা আভদিভকা দখলের নেওয়ার পর, তাদের অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে প্রতিরোধ ব্যূহ স্থিতিশীল করা যদি সম্ভবও হয়– তাতেও শঙ্কামুক্ত হতে পারবে না ইউক্রেন। কারণ, আভদিভকা দিয়ে আরও সেনা ও সরঞ্জাম ফ্রন্টলাইনে আনতে পারবে মস্কো, এবং সেখান থেকে অন্য যেকোন দিকে আক্রমণ চালাতে পারবে।
২. মারিয়াঙ্কা
ধবংসস্তূপে রূপ নেওয়া এই শহরে ঘাঁটি গেড়ে, এখান থেকে আক্রমণ চালাচ্ছে রুশ বাহিনী। গত মাসে এই শহর থেকে শেষ ইউক্রেনীয় সেনাদের হটায় তাঁরা।
সম্মুখসারির যেসব জনপদ নিয়ে দীর্ঘদিন তুমুল লড়াই চলেছে, তারই একটি হলো মারিয়াঙ্কা। তীব্র গোলাবর্ষণে ধুলায় মিশে গেছে এই শহরও। এটি দখল করার ফলে রুশ বাহিনী আরও দক্ষিণ দিকে ইউক্রেনীয়দের আরেকটি শক্তঘাঁটি ভলেদার- এর দিকে মনোযোগ দিতে পারছে।
গত বছরে রুশ সেনারা দক্ষিণ দিক দিয়ে বারবার আক্রমণ করে ভলেদারে, এসময় তাঁরা মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। এমনকি এখানেই ইউক্রেন যুদ্ধের বৃহৎ এক ট্যাংক যুদ্ধ সংগঠিত হয়, যেখানে রুশ সাঁজোয়া বহরের ব্যাপক ক্ষতিও হয়।
কিন্তু, এখন মারিয়াঙ্কা নিয়ন্ত্রণে থাকায় উত্তর দিক থেকে ভলেদারে হামলা করছে রুশ সেনারা। বর্তমানে তারা নভোমিখাইলিভকা গ্রামের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, যা ভলেদার থেকে ১৩ মাইল উত্তরপূর্বে অবস্থিত।
এদিক দিয়ে ঠিক কী পরিমাণ রুশ সেনা আসছে- সেটি স্পষ্ট নয়, তবে ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের দাবি, আক্রমণের জন্য মারিওপোলের কাছাকাছি এলাকায় ৪০ হাজার সেনাকে রেখেছে মস্কো।
ভলেদার রক্ষার লড়াইয়ে যুক্ত ইউক্রেনীয় সেনারা বলছে, ৫৫ মাইল উত্তরপূর্বে আভদিভকা দখলে আসার পর সেখানকার রুশ সেনারা এখন উত্তর দিকের আক্রমণে যোগ দিতে পারবে।
৩. রোবোতিন
এখানে গত বছরে ইউক্রেন সামান্য যেটুকু এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছিল, তা আবারো কেড়ে নেওয়ার ছক কষছে রাশিয়া।
গত বছরে ইউক্রেনের গ্রীষ্মকালীন পাল্টা-আক্রমণ অভিযান চরমভাবে ব্যর্থ হয়। তবে দক্ষিণ ফ্রন্টে শত্রুব্যূহ ভেদ করে মাত্র ১০ মাইল এগোতে পারে তারা। এভাবে অগ্রসর হয়ে ছোট্ট গ্রাম রোবোতিন পর্যন্ত পৌঁছায়, তারপরে রুশ সেনাদের পাল্টা প্রতিরোধের মুখে আর এগুতে পারেনি।
ইউক্রেনীয়রা যে অংশ উদ্ধার করেছে, এখন তা পুনর্দখল রুশ বাহিনী বদ্ধপরিকর বলেই মনে হচ্ছে।
আভদিভকার চেয়ে এই ফ্রন্টেই বেশি সেনা জড়ো করেছে রাশিয়া। চলতি সপ্তাহে এমনটাই জানান দক্ষিণে লড়াইরত ইউক্রেনীয় সেনাদলের মুখপাত্র দিমিত্র লিখোভি।
তিনি বলেন, "মনে হচ্ছে রাশিয়ানরা কিছু সাফল্য পেতে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, এবং সেজন্যই ঝটিকা হামলা করছে। যেমনটা তারা আভদিভকাতেও করছে।"
৪. ক্রেমিন্না
২০২২ সালের শেষদিকে ক্রেমিন্নার উত্তরপূর্বের যেসব ছোট মফস্বল ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, সেগুলো পুনর্দখল নিতে এদিকে অগ্রসর হতে চাইছে রুশ সেনারা।
এক বছরের বেশি সময় আগে অধিকৃত এই এলাকাগুলো থেকে রুশ বাহিনীকে তাড়িয়ে দেয় কিয়েভের বাহিনী। এসময় রাশিয়া ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা এবং ৫০০ জনপদের নিয়ন্ত্রণ হারায়। এখন এগুলোর পুনর্দখল নিতে চাইছে।
গত বছর এই ফ্রন্টের বনাঞ্চলে তীব্র লড়াই হলেও সামান্য কিছু এলাকা হাতবদল হয়। এখন রুশ সেনারা আবারো এগিয়ে আসছে, তবে ইউক্রেনীয় প্রতিরোধের মুখে সেই গতি অনেকটাই ধীর।
ক্রেমিন্না থেকে দুই দিকে– উত্তরের কুপিয়ানস্ক শহর, এবং ৮০ মাইল দক্ষিণের লিম্যানের দিকে এগোচ্ছে রুশ বাহিনী।
এই এলাকায় কয়েক মাস ধরে এক লাখ ১০ হাজারের মতো সেনাশক্তি মোতায়েন রেখেছে রাশিয়া। চলতি মাসের শুরুর দিকে এই অঞ্চলে রুশ সামরিক বাহিনীর একজন মুখপাত্র ইলিয়া ইয়েভলাশ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
৫. বাখমুত
টানা কয়েকমাস ব্যাপক রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর গত বছরের মে মাসে বাখমুতের দখল নেয় রাশিয়া। এই ফ্রন্টে রুশ বাহিনীর অগ্রযাত্রায় গতি রয়েছে, এবং অচিরেই তাঁদের কামানের পাল্লার মধ্যে চলে আসতে পারে ইউক্রেনের প্রধান একটি শহর।
মূল ফ্রন্টের পেছন দিক দিয়ে এসে বাখমুত শহরে আক্রমণ করে রুশ সেনাদের দিশেহারা করতে চেয়েছিল ইউক্রেনীয়রা, কিন্তু, সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এখন রুশ বাহিনী রয়েছে সুবিধাজনক অবস্থানে এবং প্রথম পদক্ষেপ নেওয়ার সুবিধাও তাঁদের রয়েছে।
ইউক্রেনের সদ্য নিয়োগ পাওয়া সেনাপ্রধান জেনারেল ওলেক্সান্ডার সিরস্কি বলেছেন, চাসিভ ইয়ার এলাকার কাছে রুশ সেনারা ইউক্রেনের প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়ে এগোতে পারে, ফলে তাঁরা এখানকার উচ্চভূমির নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে। যেখান থেকে তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে আধিপত্য করতে পারবে। ক্রামাতোর্স্ক শহরও চলে আসবে তাঁদের কামানের পাল্লার আওতায়।
ইউক্রেনের অনুমান, প্রায় ৬২ হাজার রুশ সেনা বাখমুত ফ্রন্টে মোতায়েন রয়েছে।
চলতি মাসের শুরুতে এক বিবৃতিতে জেনারেল সিরস্কি বলেন, "পরিস্থিতি বর্তমানে শ্বাসরুদ্ধকর, সার্বিক পরিস্থিতির দিকে সবসময় নজর রাখতে হচ্ছে এবং মাঠ পর্যায়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।"
অনুবাদ: নূর মাজিদ