হুথিদের ক্রমাগত হামলা ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানের প্রস্তুতি

লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা ঠেকাতে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে হামলার পরও ব্যর্থ হওয়ায় এবার দীর্ঘমেয়াদী হামলার পরিকল্পনা করছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন। এ নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের অনেকেই উদ্বেগ জানিয়েছেন। তাদের আশঙ্কা- এ অভিযানের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশটির শান্তি পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে এবং এটি ওয়াশিংটনকে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি সংঘাতের দিকে টেনে আনবে।
হোয়াইট হাউস ইরান-সমর্থিত এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আরো কোন কোন উপায়ে প্রতিক্রিয়া জানানো যেতে পারে তা নিয়ে আলোচনার জন্য আগামী বুধবার মার্কিন কর্মকর্তাদের ডেকেছে।
ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ড গত শনিবার তাদের সর্বশেষ হামলার কথা জানিয়েছে। তারা বলছে, হুথিরা হামলার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুত রেখেছিল। সেটি মার্কিন সৈন্যরা ধ্বংস করে দিয়েছে।
ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকা এ সংঘাত গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ বন্ধে বাইডেন যে লক্ষ্য ঠিক করেছেন, তাতে একটি ধাক্কা বলেই মনে করা হচ্ছে।
এদিকে ইরান জানিয়েছে, গত শনিবার সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে পাঁচজন ইরানি সামরিক উপদেষ্টা নিহত হয়েছেন। এ বিষয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
এছাড়াও ইরাকে আইন আল-আসাদ বিমান ঘাঁটিতে একটি হামলায় একজন ইরাকি সৈন্য গুরুতর আহত হয়েছে। এ ঘাঁটিতে ইরাকের পাশাপাশি মার্কিন সেনারাও রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইরানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন কোনো দল এ হামলা চালিয়েছে।
গাজায় অব্যাহত হামলার জেরে ইসরায়েলের ওপর চাপ প্রয়োগের উপায় হিসেবে গত নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত হুথিরা বাণিজ্যিক ও নৌ জাহাজে ৩০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। আর এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রও এখন হুথিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে।
মার্কিন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুক্তরাষ্ট্রের এই কৌশলকে ইয়েমেনে হুথিদের উচ্চস্তরের সামরিক সক্ষমতা কমানোর একটি প্রচেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যাতে করে তারা হুথিদের হামলা বন্ধ করার মাধ্যমে এডেন উপসাগর ও লোহিত সাগর দিয়ে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারেন।
বাইডেন প্রশাসন চলতি সপ্তাহে হুথিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। জ্যেষ্ঠ এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, 'হুথিরা কারা এবং তাদের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আমরা স্পষ্ট। সুতরাং আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না যে তারা তাৎক্ষণিকভাবে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিচ্ছে। তবে আমরা অবশ্যই তাদের সামরিক সক্ষমতা কমানো ও ধ্বংসের চেষ্টা করছি।'
বাইডেন এ সপ্তাহে স্বীকার করেছেন যে হুথি নেতাদের ঠেকাতে তাদের হামলাগুলো ব্যর্থ হয়েছে। এসব হামলার ঘটনায় হুথিরা যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে।
বাইডেন সাংবাদিকদের বলেন, 'হামলায় কি হুথিরা থামছে? না। তারা কি হামলা অব্যাহত রাখবে? হ্যাঁ।'
কর্মকর্তারা বলছেন, তারা আশা করেন না যে ইরাক, আফগানিস্তান বা সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের আগের যুদ্ধগুলোর মতো এ অভিযানটি কয়েক বছরব্যাপী দীর্ঘ হতে পারে। একই সময়ে তারা স্বীকার করেন যে তারা এ সংঘাতের কোনো শেষ তারিখ নির্দিষ্ট করতে পারবেন না কিংবা ইয়েমেনিদের সামরিক সক্ষমতা কখন যথেষ্ট পরিমাণে কমে আসবে সে বিষয়েও কোনো অনুমান করতে পারবেন না। হুথিদের থামানোর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে মার্কিন নৌবাহিনী ইরান থেকে অস্ত্রের চালান ঠেকানোর জন্য কাজ করছে।
ইস্যুগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজন কূটনীতিক বলেছেন, 'আমরা হুথিদের পরাজিত করার চেষ্টা করছি না। আমাদের ইয়েমেন আক্রমণের কোন ক্ষুধা নেই। আমাদের ক্ষুধা হলো তাদের এ ধরনের আক্রমণ চালানোর সক্ষমতা কমানো।'
এক মার্কিন কর্মকর্তা জানান, হুথিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যৌথ হামলায় তাদের সামরিক সক্ষমতাগুলো 'উল্লেখযোগ্য পরিমাণে' ধ্বংস করা গেছে। এর অর্থ এই নয় যে হুথিদের আর কোনো সক্ষমতা নেই। তবে তাদের এখন অনেক কিছুই নেই যা আগে তাদের ছিল।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেন, হুথিদের সবচেয়ে উন্নত সরঞ্জামগুলোর সরবরাহকারী হলো ইরান। আর ইরান চোরাচালানের মাধ্যমে এসব সরঞ্জাম সরবরাহ করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের আশা, তাদের এসব হামলার কারণে ধীরে ধীরে হুথিরা সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রের সংকটে পড়বে।
আরেক মার্কিন কর্মকর্তা জানান, তারা গত ৯ জানুয়ারি হুথিদের বিরুদ্ধে যে পরিসরে আক্রমণ চালিয়েছিল, এর পর আর সেই মাত্রায় কোনো আক্রমণ চালায়নি। তিনি বলেন, হুথিরা হামলার জন্য ইরান থেকে সহায়তা পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, অর্থনীতির পরিবর্তে মতাদর্শই এ অভিযানের বিষয়ে বাইডেনকে সিদ্ধান্ত নিতে মূল ভূমিকা রেখেছে। যদিও হামলাগুলো এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ইউরোপেরই বেশি ক্ষতি করেছে।
হুথিদের এই আক্রমণের কারণে ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী শিপিং রুটের মানচিত্র পাল্টে যাচ্ছে। কিছু কোম্পানি তাদের জাহাজকে এ রুটের বদলে দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে গন্তব্যে পাঠাচ্ছে।এছাড়াও বিপি ও শেলের মতো বড় বড় তেলের কোম্পানি ওই রুট দিয়ে তাদের জাহাজ চলাচল স্থগিত করেছে।
মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, বাইডেন বিশ্বাস করেন যে যুক্তরাষ্ট্রের এ বিষয়ে নীরব থাকার সুযোগ নেই। অবশ্যই এ বিষয়ে দেশটির পদক্ষেপ নিতে হবে। কানাডা, বাহরাইন, জার্মানি ও জাপানসহ বিভিন্ন দেশ হুথিদের গত ৩ জানুয়ারির কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।
কর্মকর্তারা ইউক্রেনের সমর্থনের সাথে হুথিদের মোকাবিলার বিষয়ে বাইডেনের অবস্থানের তুলনা করেছেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাইডেন কিয়েভকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র সহায়তার অনুমোদন দিয়েছেন।
এক্ষেত্রে কর্মকর্তারা বলেছেন, বাইডেন প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ জলপথগুলোতে নিরাপদ জাহাজ চলাচল নিশ্চিত করতে এবং আরও সাধারণভাবে নৌচলাচলের স্বাধীনতার নীতিকে রক্ষা করতে চায়। তারা আশা করেন যে হুথিদের বিরুদ্ধে এসব হামলার মধ্য দিয়ে এই রুটে জাহাজ চলাচল আগের মতোই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।
নাভান্তি গ্রুপের ইয়েমেন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ আল-বাশা বলেছেন, চাপ দেওয়ার জন্য হুথিদের শক্তিশালী উৎসাহ রয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে এবং সৌদি আরবে তেল স্থাপনায় হামলার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'যখন হুথিরা আবু ধাবি বিমানবন্দরে হামলা করেছিল, তখন তারা অনেক মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। যখন তারা আরামকো আক্রমণ করেছিল তখন তারা আরও বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু লোহিত সাগরের আক্রমণ থেকে তারা আজ মনোযোগ পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। তাই তারা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।'
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, যেসব দেশ হুথি সহিংসতা মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগ দিয়েছে তারা সবাই 'ভিন্ন ভূমিকা' পালন করছে।
তিনি বলেন, 'এখানে ৪০টিরও বেশি দেশ রয়েছে যারা হুথিদের হামলার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। হুথিদের আক্রমণ ঠেকাতে ২০ টিরও বেশি দেশ নিয়ে জোট করেছি।'
কিছু কর্মকর্তা এ বিষয়ে মার্কিন সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে এই পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই ভয়াবহ সংকটে থাকা দেশটির মানবিক পরিস্থিতিকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ও ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের কয়েকজন কর্মকর্তা উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, মার্কিন হামলার ফলে হুথিরা সৌদির সম্পদ বিশেষ করে তেল শোধনাগারগুলোতে হামলা জোরদার করতে পারে। এছাড়াও এটি নয় বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটাতে শান্তি বন্দোবস্ত করার প্রচেষ্টাকে লাইনচ্যুত করতে পারে।
যদিও মার্কিন আইন প্রণেতারা ইয়েমেনে হামলার বিষয়ে ব্যাপক সমর্থন করেছেন, তবে তারা বলেছেন প্রশাসন এখনও একটি স্পষ্ট কৌশল বা এ সংঘাত বন্ধের কোনো রূপরেখা দিতে পারেনি। তারা বলছেন, এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যের ক্রমবর্ধমান সংঘাতের উদ্বেগ দূর করতে পারেনি।
সিনেটর বেন কার্ডিন সাংবাদিকদের জানান, হুথিদের হুমকি মোকাবিলায় মার্কিন প্রশাসন বড় পরিসরে কোনো পরিকল্পনা নিতে চলেছে বলেই মনে হচ্ছে।