প্রতারণা করে গ্রাহকের ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার: অভ্যন্তরীণ তদন্ত

ইউনিয়ন ব্যাংকের হাটখোলা শাখার ম্যানেজার জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে অভিনব পন্থায় গ্রাহকদের অ্যাকাউন্ট থেকে ৮ কোটির বেশি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে অভ্যন্তরীণ তদন্তে।
কয়েক বছর ধরে তিনি গ্রাহকদের সঞ্চয়ী ও মেয়াদি আমানত অ্যাকাউন্টের বিপরীতে ঋণ সৃষ্টি, ডুপ্লিকেট অ্যাকাউন্ট সৃষ্টি ও এক অ্যাকাউন্টের টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে টাকা সরাচ্ছিলেন।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে এক গ্রাহক তার জমানো টাকা তুলতে এলে তার এই অনিয়ম ধরা পড়ে। পরে ইউনিয়ন ব্যাংকের তাৎক্ষনিক তদন্তেও গ্রাহকদের সঙ্গে শাখা ব্যবস্থাপকের এই জালিয়াতির ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এ অপরাধে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। পাশাপাশি তাকে চিঠি দিয়ে আর্থিক অনিয়মের কারণে তার বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা-ও জানতে চেয়েছে ব্যাংক।
টাকা ফেরত পাওয়ার অপেক্ষায় ভুক্তভোগী গ্রাহকরা
প্রতারণার প্রমাণ পাওয়ার পরও ভুক্তভোগী গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিচ্ছে না ব্যাংক। অন্তত ২০ জন গ্রাহক তাদের জমানো টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য কয়েক মাস ধরে ব্যাংকের শাখা ও প্রধান কার্যালয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ টাকা ফেরত দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা না করে শাখা ব্যবস্থাপকের কাছ থেকে আদায় করে গ্রাহকদের টাকা দেওয়া হবে বলে মৌখিকভাবে আশ্বাস দিচ্ছে।
তদন্তে যা পাওয়া গেছে
টিবিএসের হাতে আসা ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাকির হোসেন দুই মেয়াদে হাটখোলা শাখায় ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথম দফায় দায়িত্বে ছিলেন ২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এরপর ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত। উভয় মেয়াদেই তিনি এ ধরনের নিয়ম-বহির্ভূত কাজ করেছেন।
তদন্তে উঠে এসেছে, জাকির হোসেন ভুয়া বিনিয়োগ বা ঋণ সৃষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে টাকা স্থানান্তর ও উত্তোলন করেছেন। মুদারাবাদ টার্ম ডিপোজিট (এমটিডিআর) ব্লকের ডুপ্লিকেট তৈরি করে তার বিপরীতে ঋণ সৃষ্টির মাধ্যমে টাকা তুলেছেন।
এছাড়া এক গ্রাহকের সঞ্চয়ী হিসাবে লেনদেনের মাধ্যমে অন্য গ্রাহকের ঋণ সমন্বয় করেছেন। এছাড়া গ্রাহকের সঞ্চয়ী হিসাবের টাকা অন্য হিসাবে স্থানান্তর করে উত্তোলন করেছেন। তদন্তে দেখা গেছে, জাকির হোসেন গত ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হাটখোলা শাখার বিভিন্ন গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে ৮ কোটি ৬ লাখ ৮৮ হাজার টাকা সরিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবির গত ১৬ জুন টেলিফোনে টিবিএসকে বলেন, 'শাখা ব্যবস্থাপক ও কিছু অসাধু গ্রাহক যৌথভাবে এই অনিয়ম করে এখন ব্যাংকের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এখন তদন্ত হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষে এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে। এছাড়া জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপে রাখা হয়েছে।'
অভিযুক্ত শাখা ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। অডিট ডিপার্টমেন্ট এটা নিয়ে কাজ করছে। অডিট ডিপার্টমেই এ বিষয়ে বলবে।'
একজন গ্রাহকের বক্তব্য
ইউনিয়ন ব্যাংকের হাটখোলা শাখার গ্রাহক মিজানুর রহমান দুটি এমটিডিআর হিসাবে ৬০ লাখ টাকা রেখেছিলেন। এমটিডিআর হচ্ছে একটি ইসলামিক ব্যাংকিং প্রোডাক্ট, যা মুদারাবা নীতির ওপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য অর্থ জমা রাখার একটি স্কিম।
মিজানুর টিবিএসকে বলেন, 'আমার প্রথম এমটিডিআরের বিপরীতে ঋণ ছিল। সেটি আমি সমন্বয়ও করেছি। কিন্তু দ্বিতীয় এমটিডিআরের বিপরীতে কোনো ঋণ ছিলো না। গত জানুয়ারি মাসে দ্বিতীয় এমটিডিআরের টাকা তোলার জন্য ব্যাংকের ম্যানেজারের কাছে যাই, ম্যানেজার এমটিডিআরের মূল কপি জমা দিয়ে ২-৩ দিন পরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী ম্যানেজারের কাছে এমটিডিআরের মূল কপি রেখে আসি।
'পরে যোগাযোগ করা হলে শাখা থেকে জানানো হয় যে আমার এমটিডিআরের বিপরীতে ৬০ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। ঋণ পরিশোধ না করলে ব্যাংক আমার এমটিডিআর নগদায়ন করবে না। কিন্তু আমি ওই এমটিডিআরের বিপরীতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিইনি। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসে জানতে পারি এই ম্যানেজ্যার এভাবে ভুয়া ঋণ সৃষ্টিসহ আরও অন্যান্য পন্থায় অনেক গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'এরপর থেকে ব্যাংকের শাখায়, প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন পর্যায়ে বারবার যোগাযোগ করেও টাকা ফেরত পাচ্ছি না।'
মিজানুরের সাভারে জুতো তৈরির একটি কারখানা রয়েছে। স্থানীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জুতা তৈরি করেন তিনি। পুঁজির অভাবে অনেক অর্ডার সময়মতো ডেলিভারি দিতে পারছেন না বলে তিনি টিবিএসকে জানান।
গত বছর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেশ কয়েকটি ব্যাংক পুঁজি ঘাটতিতে থাকা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংক অন্যতম। এই ব্যাংকটি গত কয়েক মাস ধরেই বড় বড় গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে পারছে না।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, পাঁচটি ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করে একটি ব্যাংক করা হবে। এই পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকও রয়েছে।