ইরানের ইউরেনিয়াম মজুতের কী হয়েছে, জানেন না মার্কিন কর্মকর্তারা

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন বাঙ্কার বাস্টার বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি 'সম্পূর্ণ ও সর্বাংশে ধ্বংস' হয়েছে বলে ঘোষণা দেওয়ার একদিন পরও কর্মসূচিটির প্রকৃত অবস্থা অনেক বেশি অস্পষ্টই আছে। শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন, ইরানের কাছে থাকা প্রায়-বোমা-তৈরির-উপযোগী ইউরেনিয়ামের মজুতের কী পরিণতি হয়েছে, সে সম্পর্কে তারা কিছু জানেন না।
রোববার এবিসি নিউজের এক অনুষ্ঠানে মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেন, 'আগামী সপ্তাহগুলোতে আমরা ওই জ্বালানির বিষয়ে কিছু একটা করার জন্য কাজ করব। এ ব্যাপারে আমরা ইরানিদের সঙ্গে আলোচনা করব।' তিনি এখানে যে ইউরেনিয়ামের কথা বলেছেন, তা দিয়ে ৯-১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করা যাবে।
তবে ভ্যান্স দাবি করেন, ইরান বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, ওই জ্বালানিকে অস্ত্রে রূপান্তর করার সক্ষমতা ব্যাপকভাবে হারিয়েছে ইরান। কারণ, এ জ্বালানিকে কার্যকর অস্ত্রে রূপান্তরিত করার মতো সরঞ্জাম এখন আর তেহরানের হাতে নেই।
অন্যদিকে ইরান স্পষ্ট বলে দিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী নয়। একদিকে বিমান হামলার পরিকল্পনা, অন্যদিকে আলোচনার নামে ধোঁকা দেওয়ার অভিযোগ এনেছে তেহরান ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে। তাছাড়া এই ইউরেনিয়ামের মজুতই এখন ইরানের হাতা থাকা দরকষাকষির অন্যতম হাতিয়ার।
রোববার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ও জয়েন্ট চিফস অভ স্টাফের চেয়ারম্যান ড্যান কেইন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সর্বাত্মক সাফল্যের দাবি এড়িয়ে যান। তারা বলেন, বিমানবাহিনীর বি-২ বোমারু বিমান ও নৌবাহিনীর টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালানো তিনটি পারমাণবিক স্থাপনার প্রাথমিক মূল্যায়নে দেখা গেছে, 'ব্যাপক ক্ষতি ও ধ্বংস' হয়েছে।
প্রধান লক্ষ্যবস্তু ফোরদো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছিল পর্বতের নিচে। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, সেখানে একাধিক স্থানে বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এক ডজন ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর পাথরের গভীরে এভাবে ফাটল সৃষ্টি করেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রাথমিক বিশ্লেষণ বলছে, এই কেন্দ্রটিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা গেলেও সম্পূর্ণ ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি।
তবে গোয়েন্দা তথ্য সম্পর্কে অবগত দুজন ইসরায়েলি কর্মকর্তা জানান, হামলার আগের কয়েক দিনে ইরান ওই স্থাপনা থেকে ইউরেনিয়াম ও যন্ত্রপাতি অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছে।
পাশাপাশি প্রমাণ মিলছে যে, ট্রাম্পের উপর্যুপরি সামরিক হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে ইরান প্রায় ৪০০ কেজি ৬০ শতাংশ পরিশোধিত ইউরেনিয়াম সরিয়ে ফেলেছে। উল্লেখ্য, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য সাধারণত ৯০ শতাংশ বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম প্রয়োজন হয়।
এই ৬০ শতাংশ পরিশোধিত ইউরেনিয়াম ইরানের প্রাচীন রাজধানী ইসফাহানের কাছাকাছি এক পারমাণবিক স্থাপনার গভীরে সংরক্ষিত ছিল।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল মারিয়ানো গ্রোসি বলেন, তার নেতৃত্বাধীন জাতিসংঘের পরিদর্শক দল ইসরায়েলের হামলার এক সপ্তাহ আগে শেষবার ওই জ্বালানি দেখেছিল। রোববার সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গ্রোসি বলেন, 'ইরান এই উপাদান সুরক্ষিত রাখার বিষয়টি কখনও গোপন করেনি।'
পরে টেক্সট মেসেজে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, জ্বালানির মজুতটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে—তিনি এমনটাই ইঙ্গিত করেছেন কি না। উত্তরে গ্রোসি বলেন, 'হ্যাঁ, আমি তা-ই বুঝিয়েছি।' ছোট ছোট বিশেষ পিপায় সংরক্ষিত ওই জ্বালানি প্রায় ১০টি গাড়ির ট্রাঙ্কে এঁটে যাবে।
যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে ইসফাহান ছাড়াও অন্যান্য কেন্দ্র থেকেও সরঞ্জাম ও উপকরণ লোকচক্ষুর আড়ালে সরিয়ে ফেলতে পারেন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির তত্ত্বাবধায়করা। একইসঙ্গে সম্ভবত ফোরদোকে আরও সুরক্ষিত করার চেষ্টাও করা হয়েছে।
মার্কিন হামলার কয়েকদিন আগেই ম্যাক্সার টেকনোলজিস প্রকাশিত স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, ফোরদো পর্বতের সুড়ঙ্গগুলোর প্রবেশপথের সামনে ১৬টি কার্গো ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। লন্ডনের ওপেন সোর্স সেন্টার বিশ্লেষণে বলা হয়, ইরান সম্ভবত আগেভাগেই ওই স্থাপনায় হামলার বিষয়টি টের পেয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
তবে প্রকৃতপক্ষে ওই স্থাপনা থেকে ঠিক কী সরানো হয়েছে, তা এখনও নিশ্চিত নয়।
ইরান কতটুকু উপকরণ রক্ষা করতে পেরেছে, সেটাও সীমিত। সুপারসনিক গতিতে ঘুরে ইউরেনিয়াম পরিশোধন করা বিশালাকৃতির সেন্ট্রিফিউজগুলো পাইপের মাধ্যমে সংযুক্ত এবং কংক্রিটের মেঝেতে দৃঢ়ভাবে বসানো থাকে।
একজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত শুরু হওয়ার পর ফোরদো থেকে সমস্ত সরঞ্জাম পুরোপুরি সরিয়ে নেওয়া অবাস্তব।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ফোরদোর গভীরে পারমাণবিক কর্মসূচি-সংক্রান্ত বহু ঐতিহাসিক নথিপত্র সংরক্ষিত ছিল, যা কেন্দ্রটিকে পুনর্গঠনের যেকোনো প্রচেষ্টাকে আরও জটিল করে তুলবে।
আগামীতে দিনে ইরান ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা নাতাঞ্জ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র সম্পর্কে আরও তথ্য উদঘাটনের অপেক্ষায় রয়েছে। এই কেন্দ্রটি তুলনামূলকভাবে পুরোনো, বড় এবং কম সুরক্ষিত। ইসরায়েল বহুবার এই স্থাপনাকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলি হামলায় এ কেন্দ্রের ভূ-উপরিস্থ সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র ধ্বংস এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করেছে।
পরে আইএইএর মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি বলেছিলেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেন্ট্রিফিউজগুলোর গতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল; ফলে সম্ভবত সবকটা সেন্ট্রেফিউজই নষ্ট হয়ে যায়।
এই সরঞ্জাম পুনর্নির্মাণ ও প্রতিস্থাপনে ইরানের কত সময় লাগবে, তা অজানা। সম্ভবত বেশ কয়েক বছর লেগে যাবে। তবে ইরান ইতিমধ্যে নাতাঞ্জের দক্ষিণে একটি নতুন, ভূগর্ভের আরও গভীরে বিকল্প কেন্দ্র নির্মাণ করছে। তবে তেহরান আইএইএকে বলেছে, তারা এখনও সেই নতুন কেন্দ্র চালু করেনি; তাই সেখানে এখনও দেখার মতো কিছু নেই।
ইরান যদি সত্যিই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করে, তবে এ কাজে তারা ইতিহাসের যেকোনো পারমাণবিক শক্তিধর দেশের চেয়ে বেশি সময় নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ম্যানহাটন প্রকল্প সম্পন্ন করেছিল প্রায় চার বছরের মধ্যে। এ প্রকল্পের অধীনে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ফেলা দুই বোমা তৈরি হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নও চার বছরের মাথায়, ১৯৪৯ সালে প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়। ভারত, পাকিস্তান ও ইসরায়েল—এদের সবাইই তুলনামূলকভাবে দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছিল।
ইসরায়েলসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের দাবিমতে, ইরানিরা ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে কাজ করছে। কয়েক বছর আগে তেহরানের এক ওয়্যারহাউস একটি গোপন তথ্যভান্ডার চুরি করে ইসরালি গোয়েন্দারা। তাদের দাবি, ওই তথ্যভান্ডার থেকে জানতে পেরেছে যে ইরানি প্রকৌশলীরা এমন পরমাণু ট্রিগার ও প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন, যা কেবল একটি পারমাণবিক অস্ত্র বিস্ফোরণে ব্যবহৃত হয়। ঘটনাটি ছিল ২০০৩ সালের দিকে। তবে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, সে সময় প্রকৌশলীদের অস্ত্রীকরণ-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
সম্প্রতি ট্রাম্প ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাজ ফের শুরু করেছে। কিন্তু এই দাবির পক্ষে এখনও কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি তারা। আর তাদের দাবি যদি সত্যি হয়, তবে ফোরদো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানের হামলার পর হয়তো ইরানের নেতারা মনে করবেন যে রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখতে হলে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োজন।
ইতিহাসও বলে, কোনো দেশ যাতে পারমাণবিক অস্ত্রের পেছনে না ছোটে, সেই নিশ্চয়তা আদায়ের ক্ষেত্রে কূটনীতি সাধারণত অন্তর্ঘাতমূলক বা সামরিক হামলার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর।
প্রায় ১৫ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ সাইবার হামলার নাতাঞ্জ কেন্দ্রে ইরানের ৫ হাজার সেন্ট্রিফিউজের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ধ্বংস হয়ে যায়।
কিন্তু ইরান সেগুলো শুধু পুনর্নির্মাণই করেনি, বরং আগের চেয়েও উন্নত প্রযুক্তির সেন্ট্রিফিউজ স্থাপন করে। চলতি মাসের ইসরায়েলি হামলার আগপর্যন্ত ইরানের প্রায় ১৯ হাজার সেন্ট্রিফিউজ সচল ছিল।
২০১৫ সালে ওবামা প্রশাসন ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করার সময়ই কেবল আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের সুবাদে দেশটির সক্ষমতা সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ট্রাম্প এই চুক্তিকে 'বিপর্যয়' আখ্যা দিয়ে তা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিলে সেই পরিদর্শন কার্যক্রম হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়।
এর প্রতিক্রিয়ায় তেহরান সেন্ট্রিফিউজের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি তারা এমন মাত্রায় ইউরেনিয়াম পরিশোধন করে যা কেবল পরমাণু অস্ত্রধারী রাষ্ট্রগুলোর প্রয়োজন হয়।
ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত শুরু হওয়ার সময় আইএইএর যে পরিদর্শক দল ইরানে অবস্থান করছিল, তাদের ফের কাজ শুরু করার অনুমতি দেওয়া হবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তাদের কাজের মধ্যে ছিল বোমা তৈরির উপযোগী ইউরেনিয়ামের অবস্থান ও নিরাপত্তা যাচাই করা।
ইরানি কর্মকর্তারা বলেছেন, যুদ্ধাবস্থায় সব ধরনের আন্তর্জাতিক পরিদর্শন স্থগিত থাকবে। আর যদি পরিদর্শন ফের শুরু হয়ও, তবু সংশ্লিষ্ট পরিদর্শকরা হয়তো গুঁড়িয়ে দেওয়া ফোরদো ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় বা নাতাঞ্জের ধ্বংসাবশেষে প্রবেশ করতে পারবেন না।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে পেন্টাগনের সাবেক কর্মকর্তা এবং সিআইএ-র সাবেক কর্মকর্তা মিক ম্যালরয় এই হামলা সম্পর্কে বলেন, 'যে ধরনের ও যে পরিমাণ যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি সম্ভবত দুই থেকে পাঁচ বছর পিছিয়ে যাবে।'