পদ্মায় লাল মুনিয়ার ছবি তুলতে গিয়ে হঠাৎ যেভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা মিঠাপানির কুমিরের দেখা মিলল

অক্টোবর মাস। এই সময়টাতে কাশবনের মধ্যে খুবই সুন্দর একটা পাখির দেখা মেলে। নাম 'লাল মুনিয়া'। ইংরেজি নাম 'Red Avadavat'।
আমার বাড়ি থেকে খুব কাছেই পদ্মা নদী। আই বাঁধ থেকে অপর পাশে পদ্মা নদীতে যে চর, সেখানে কাশবনের মধ্যে লাল মুনিয়ার ছবি তুলতে যাব। তাই সকাল সকাল নৌকা করে আমি ও আমার সঙ্গী মো. ইমরুল কায়েস রওনা হলাম, চর মাঝারদিয়ার উদ্দেশে।
নৌকা থেকে নেমে আমরা সরাসরি গেলাম লাল মুনিয়া খুঁজতে। সকালের সময়টুকু শুধু লাল মুনিয়ার ছবি তুলব এটাই পরিকল্পনা ছিল। অবশেষে কিছু দূর খোঁজাখুঁজির পর লাল মুনিয়ার দেখা পেলাম। দূর থেকে বেশ কয়েকটি ছবিও তুললাম। যেহেতু আমার কাছে ২৫০ মিমি. লেন্স ছিল, তাই খুব একটা ভালো ছবি তুলতে পারছিলাম না।
আর কায়েসের কাছে ছিল ৬০০ মিমি. লেন্স। সে কিছুক্ষণ সময় দিয়ে বেশ ভালো ছবি পেয়েছে। এদিকে সকাল গড়িয়ে দুপুর হওয়ার উপক্রম। একদিকে রোদ, আরেকদিকে ভালো ছবি পাচ্ছি না। তাই আমার শরীর ও মন দুটোই খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। অর্ধভেজা কাঁদা ও ঘাসযুক্ত জায়গা দেখে ধপ করে বসে পড়লাম।
আমার মন খারাপ দেখে কায়েস তার ক্যামেরাটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, 'আমি ভালো ছবি পেয়েছি, এবার আপনি তোলেন'। বেশ কিছুক্ষণ তার ক্যামেরা দিয়ে লাল মুনিয়া ছাড়াও আরও বেশ কিছু পাখির ছবি তুললাম। ছবি তুলতে তুলতেই দুপুর হয়ে গেল। কিছু খাওয়া প্রয়োজন। আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে কিছুটা দূরে চরের মধ্যে ঘাটের কাছে একটি দোকান আছে। সেই দোকানের উদ্দেশে রওনা দিলাম দুজনই। দোকানে গিয়ে চানাচুর, বিস্কুট আর একটি ঠান্ডা মোজো নিলাম। ক্লান্ত শরীর, তাই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই কায়েসের মোবাইল ফোনে কল আসে বন বিভাগ থেকে।
ফোন করেছিলেন রাজশাহী বিভাগীয় বন্যপ্রাণী অধিদপ্তরের ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর কবির। তিনি জানালেন, চরে গরু চরাতে গিয়ে একটি ছেলে কুমির দেখতে পেয়েছে। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কাছ থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর ফোন নম্বর নিয়ে রওনা হলাম কুমিরের খোঁজে।
কিছু দূর যেতে যেতে বেশ কিছু খাঁড়ি দেখতে পাই। ক্যামেরার আইপিসে চোখ লাগিয়ে কুমির খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কুমির দেখতে পাচ্ছিলাম না। দেখতে না পেয়ে আমরা আবার সামনে এগোতে লাগলাম।
যতই আগাচ্ছি, ততই নরম কাঁদার মধ্যে পা দেবে যাচ্ছিল। কোনোমতে একটু শক্ত এক ডাঙ্গায় উঠতে না উঠতেই সামনে দেখি আবারও বেশ কিছু খাঁড়ি। আবারও ক্যামেরার আইপিসে চোখ রাখলাম কুমির দেখার জন্য। এদিক-ওদিক কোনোদিকেই কুমির দেখতে পাচ্ছি না। এবার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। একে তো রোদে শরীরটা আগে থেকেই খারাপ লাগছিল, তার মধ্যে এতটা পথ নরম কাঁদা পানি পার হয়ে এসেও কুমিরের দেখা পেলাম না।
আমি প্রায় হতাশ! কায়েস কে বললাম, কুমির মনে হয় এতক্ষণে চলে গেছে। কিন্তু কোনোভাবেই পাগল মনটা বুঝতে চাচ্ছিল না যে কুমিরের দেখা পাব না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এগুলোই ভাবছিলাম। সেই প্রত্যক্ষদর্শীকে আবারও কল দিল কায়েস; কুমির এখনো আছে কি না জানার জন্য। আমি এদিকে এখনো হাল ছাঁড়তে রাজি না। কুমির যে প্রান্তেই থাকুক আমি দেখতে যাবই।
এদিকে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম তার সামনের খাঁড়িতে কোমড় সমান পানি। আমি ও কায়েস স্যান্ডেল খুলে ক্যামেরা মাথার ওপর নিয়ে খাঁড়ি পার হবো, ভয়ে ছিলাম কোনোভাবে যাতে পা না পিছলে যাই, নাহলে ক্যামেরাকে শেষ বিদায় জানাতে হবে আজ।
যাই হোক কোনোমতে আমরা দুজন খাঁড়ি পার হতে পেরেছি। খাঁড়ি থেকে ওঠার পর বুঝতে পারছিলাম না আসলে কোনদিকে যাব। আমরা না বুঝেই হাঁটা ধরলাম যেদিক দুই চোখ যায়। যেতে যেতে বেশ কিছু মানুষকে কুমির কোন দিকে আছে জানতে চাইলেও তারা কিছুই বলতে পারেননি।
আমরা হাঁটছিই…। হাঁটতে হাঁটতে আমাদের প্রত্যক্ষদর্শী সবুজের বাড়ি খুঁজে পেলাম। তার বাড়ি ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে।
আমরা ক্লান্ত হয়ে সবুজের বাসায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবারও ছুটলাম কুমিরের খোঁজে। যেতে যেতে সামনে আবারও খাঁড়ি চোখে পড়ল। সবুজ বলল, 'এই খাঁড়ির পানি হাঁটু বরাবর। যদি খাঁড়িতে নামতে না চান, তাহলে আরো দূর দিয়ে ঘুরে যেতে হবে।' তবে আমি এতটাই ক্লান্ত ছিলাম যে পায়ের ধাপগুলো ভারি হয়ে আসছিল। তাই আমি খাঁড়ি পার হতে রাজি হয়ে গেলাম।
খাঁড়ি পার হয়ে কিছু দূর যেতে আরেকটি খাঁড়ি দেখতে পেলাম। হাঁটতে হাঁটতে সবুজ বলল, 'সামনে এই খাঁড়িতে দুই ঘণ্টা আগে কুমির দেখেছিলাম। আমরা খাঁড়ির কাছে এসে দেখি কুমির নেই। এবার আবারও মনটা খারাপ হয়ে গেল, মনে হচ্ছিল কান্না করে দেই।
আবারও মন খারাপ করে ধপ করে এক গাছে নিচে বসে পড়ি। তারপর কায়েসকে বললাম, যেহেতু দুই ঘণ্টা আগে কুমির দেখা গিয়েছিল, যদি খাঁড়িতে থাকে তাহলে অন্য দিকে চলে গিয়েছে। যদি কুমিরটা পানিতে থাকে, তাহলে ড্রোন দিয়ে দেখা যেতে পারে। ভাগ্যে যদি থাকে ইনশা আল্লাহ দেখা পাবো, হাল তবুও ছাড়ব না। এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি যখন চেষ্টা করব দেখা পাওয়ার।
কিছুক্ষণ বসে থাকার পর কায়েস ড্রোন ওড়ালো। কায়েস প্রথমে ড্রোনটা আমাদের ডান দিকে পাঠালো। আমি কায়েসকে জিজ্ঞাসা করলাম কুমির পেল কি না। কায়েস মাথা নাড়া দিল। বুঝলাম কুমির নাই। আমি হতাশ হয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকলাম। একটু পর কায়েস হুট করে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, পাগলি… কুমির… আমি খুশিতে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
কায়েসকে জিজ্ঞাসা করলাম কোন দিকে কুমির? কায়েস বলল, 'ডান দিকে সামনে'। আমি আর কায়েস ড্রোন চালু রাখা অবস্থায় দুজন কুমিরের দিকে হাঁটা ধরলাম। কিছু দূর হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে প্রথমবারের মতো সামনাসামনি ওয়াইল্ডে কুমিরের দেখা পেলাম। কায়েস ড্রোন দিয়ে কিছু ভিডিও ছবি নিল। আমি ক্যামেরায় কিছু ছবি ও ভিডিও করলাম। আমরা খুশিতে আত্মহারা!
একটু পর আমাদের প্রত্যক্ষদর্শী সবুজের বাবা কায়েসকে কল দিয়ে তাদের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার জন্য দাওয়াত করল। সীমান্তের কাছাকাছি এমন জায়গা, যেখানে শহরের কোনো নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পৌঁছায় না, তাদের কষ্টের কোনো শেষ নেই। নেই বিদ্যুৎ, দোকানপাট, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানকার মানুষগুলো এতটা সাধারণ, এতটা আন্তরিক! মেহমান আপ্যায়নে কোনো কমতি নেই তাদের। খাওয়া-দাওয়া শেষে আমরা সবুজের বাবা-মাকে বিদায় জানিয়ে আবারও রওনা হলাম নিজ শহরে, নিজ ঠিকানার পথে।