বুদ্ধদেব এখানে কখনো থাকেননি, তবে মালখানগরের বসু পরিবারের কথা উঠলে তার নামই আগে আসে

লতায় পাতায় জড়ানো বসুদের ষোলটি পরিবার ছিল মালখানগরে। মুন্সিগঞ্জের সিরাজদীখান থানার মালখানগর গ্রামটির নাম বসুরা নিয়ে গেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। কলকাতার বসুরা 'মালখানগর সম্মিলনী' নাম দিয়ে দুর্গাপূজাও করেন। কলকাতার যে প্রান্তেরই হোক না কেন, পুজোয় তারা একসঙ্গে হন এবং পূর্বপুরুষের গল্প বলেন।
পূর্বপুরুষের ভিটা অনেকেই চোখে না দেখলেও অহংবোধ নিয়ে বলেন, "আমরা সেই বাংলাদেশের মালখানগরের বসুঠাকুর।" যেমন বুদ্ধদেব বসুর কন্যা দময়ন্তী বসু সিং, যিনি জন্মেছেন কলকাতায়, স্মৃতিচারণায় লিখেছেন: 'কলকাতাই আমাদের একমাত্র শহর হওয়া সত্তেও কদাপি নিজেদের পশ্চিমবঙ্গীয় ভাবি না আমরা। দেশ-গাঁ দেখিনি তো কী, বাবা-মার দেশই আমাদের। এখনো আমরা ঢাকা-বিক্রমপুরের লোক, মালখানগরের বসুঠাকুর! আমাদের শিকড় বদ্ধমূল সেই না-দেখা দেশে-পূর্বপুরুষের অস্তিত্বহীন ভিটেয়।'
সাড়ে তিনশ বছর আগে বসুদের প্রথম পুরুষ দেবীদাস ঠাকুর মালখানগরের গোড়াপত্তন করেছিলেন। তখন মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেনাপতি শায়েস্তা খানের আমল চলছিল। মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের দমন করতে তাকে বাংলায় পাঠানো হয়েছিল। পঞ্চান্নটি গরগনা নিয়ে নওয়ারা মহাল গঠন করেছিলেন। দেবীদাস বসুকে নিয়োগ করেছিলেন সেই মহালের কানুনগো হিসেবে।
ধলেশ্বরী নদীর দুই মাইল দক্ষিণে দেবীদাস তার কাচারি বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। সেটিকে স্থানীয়রা 'মালখানা' নামে ডাকত। ধারণা করা হয়, সেখান থেকেই 'মালখানগর' নামটির উৎপত্তি। তবে আঠার শতকের দলিলপত্রে এ গ্রামের নাম দেখা যায় 'বসুরনগর' হিসেবে।
দেশভাগের আগে পর্যন্ত ওই ষোলটি বসু পরিবারের বসতি ছিল মালখানগরজুড়ে। বাড়িগুলি বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল, যেমন—উত্তরের বাড়ি, মধ্যের বাড়ি, পূবের বাড়ি, ছোট বাড়ি, বড় বাড়ি, দক্ষিণের বাড়ি, নয়া বাড়ি, দারোগা বাড়ি, অশ্বিনী কুমার বসু ঠাকুরের বাড়ি, কিশোরী মোহন বসু ঠাকুরের বাড়ি ইত্যাদি।

কবি, সমালোচক ও সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু স্বনামে ধন্য। তিনি অধ্যাপনা করেছেন আমেরিকার পেনসিভানিয়া, ইন্ডিয়ানায়, কলোরাডো, হাওয়াইয়ে; এছাড়া কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও রিপন কলেজেও। ঢাকা থেকে প্রগতি এবং কলকাতা থেকে কবিতা পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করা তার জীবনের উল্লেখযোগ্য কর্ম।
তার দাদার দাদা ছিলেন রামরাজা বসু ঠাকুর। রামরাজার নাতি ছিলেন শরৎচন্দ্র বসু ঠাকুর। শরৎ বাবুর দুই ছেলের একজন ভূদেবচন্দ্র বসু ঠাকুর, যার পুত্র ছিলেন আমাদের এই বুদ্ধদেব বসু। বুদ্ধদেবের জন্ম অবশ্য মাতুলালয় কুমিল্লায়। জন্মের কিছুকাল পরে তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। এ ঘটনায় ভূদেব গভীর দুঃখ অনুভব করে পরিব্রাজ্যা গ্রহণ করেন এবং নিরুদ্দেশ হন। বুদ্ধদেব তখন লালিত-পালিত হতে থাকেন মাতুলালয়ে।
দারোগা দাদুর (নানা) চাকরিসূত্রে তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে কুমিল্লা ও নোয়াখালিতে। তিনি মেট্রিক পরীক্ষা পাশ করেছিলেন ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল থেকে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে বিএ ও এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই ঢাকার বাংলাবাজার থেকে তার প্রথম কবিতার বই মর্ম্মবানী প্রকাশিত হয়। তিনি সেটি উপহার দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে।
১৯২৫ সালে, অর্থাৎ এখন থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে, মুন্সিগঞ্জ সদরে অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন। এই সম্মেলনের সাহিত্য শাখার সভাপতিত্ব করেন শরৎচন্দ্র। সেখানে বুদ্ধদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে শরৎচন্দ্রের।
সদর থেকে তখন নদীপথে মালখানগর ছিল আধাবেলার পথ। জীবনের অনেকটা সময় ঢাকায় কাটিয়েও বুদ্ধদেব মালখানগর কেন আসেননি? তার আত্মজীবনীতেও মালখানগরের নাম মোটে একবার এসেছে, শুধু পৈতৃক ভিটার উল্লেখ করতে গিয়ে।

বসুদের কুলপুরোহিত ছিলেন চক্রবর্তীরা। পাঁচ পুরুষ ধরে তারা বসুদের বাড়ির পুজো-আচ্চা সম্পাদনা করেছেন। এখন সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন সাধন চক্রবর্তী। পরিবার নিয়ে তিনি বাস করেন নয়া বাড়িতে। সাধন চক্রবর্তী জানালেন, "সম্ভবত বাবার প্রতি অভিমান থেকেই তিনি মালখানগরে আসেননি। পিতার আদর পাননি, মাতাকে হারিয়েছেন জন্মের পরপরই, সেই অর্থে ছিলেন অনাথ। তবে মেধাবী ছিলেন, খুব মেধাবী। আমার বাবার মুখে শুনেছি, একবার মালখানগর উচ্চ বিদ্যালয়ের সুধী সমাবেশে এসেছিলেন। হয়তো আরও দু'চারবার এসেছেন, তবে নিয়মিত আসেননি।"
মালখানগর হাই স্কুলে পড়েছেন সাধন চক্রবর্তী। একাত্তর সালে তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। বসু পরিবারের উদ্যোগে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯৮ সালে, তখন নাম ছিল ইংলিশ হাই স্কুল। গিরিশ চন্দ্র বসুঠাকুর ও মহিম চন্দ্র বসুঠাকুর ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। তারা স্কুলে পাঠদান করেছেন বলে ধারণা করেন সাধন চক্রবর্তী। তবে গিরিশ চন্দ্র বসুর সময় কম ছিল, কারণ তিনি ১৮৯৮ সালে মারা যান। মহিম চন্দ্র বসু ছিলেন স্কুলের সচিব। তাদের পরবর্তী প্রজন্মও স্কুলে পাঠদান করেছেন।
স্কুলের জমিতে মহেন্দ্র চন্দ্র রায় কর্ম্মকার নামে একটি হলঘর আছে। এটি সম্ভবত প্রতিষ্ঠাতার বাবার নামে নির্মিত। নামটি বড় রাস্তা থেকেও দেখা যায়। কর্ম্মকারদের নাম স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় নিশ্চয়ই বসুরা কুপিত হয়েছিলেন, তবে যে কারণে হোক মেনে নিয়েছিলেন।
মালখানগরে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পায় হাই স্কুলেরও আগে, ১৮৫৬ সালে।

বসুদের অধিকাংশ ছিলেন জমিদার। তাদের তালুক ছিল ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, বরিশাল। কেউ কেউ চাকুরিজীবী ছিলেন, আবার অনেকে নিজেদের ইচ্ছেমতো পেশা বেছে নিয়েছিলেন। যেমন, বুদ্ধদেব বসুর বাবা ছিলেন ঢাকা বারের উকিল।
বুদ্ধদেবের স্ত্রী রানু সোমের—যিনি প্রতিভা বসু নামে স্বনামধন্য—পৈতৃক বাড়ি আড়িয়ল বিলের হাঁসাড়া গ্রামে। মালখানগরে ছিল তার মামাবাড়ি, কিন্তু কোনো কারণে তিনি মালখানগরের প্রতি বিরূপ ছিলেন। তিনি নিজের কন্যাকে খোঁটা দিয়ে বলতেন, "মালখানগরের প্রোডাক্ট।" মালখানগরের লোকেরা তার কাছে ছিলেন উগ্র, মারকুট্টে আর পেটুক। "এরা বোঝে কেবল খাওয়া আর খাওয়া। পারে শুধু এক খাওয়া শেষ হতে না হতেই আরেক খাওয়ার গল্প শুরু করতে।"
কথাগুলো সম্পূর্ণ সত্য নয়, তবে কিছুটা যে মিথ্যেও নয় তার প্রমাণ পেলাম দুলালদের কথায়। তালতলা বাজারের অনিল বাবুর গহনালয়ে বসে আড্ডা হচ্ছিল। সেখানে চুরানব্বই বছর বয়সী দুলাল দে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বসুদের ফাই ফরমাশ খাটতেন। নবীন বসুর গল্প শোনালেন, "খুব অত্যাচারী ছিলেন। তার সামনে দিয়ে কেউ জুতা পরে হেঁটে যেতে পারত না। বাজারের সবচেয়ে বড় মাছটি তার ভোগে না এলে খেপে যেতেন।"
আরও জানান, "একবার শ্রীনগরের একজন তালতলা বাজার পার হচ্ছিলেন। জেলের ঝুড়িতে একটি বড় বোয়াল মাছ দেখে কিনে ফেললেন। খবরটি নবীন বাবুর কানে গেলে তিনি ঘোড়া দিয়ে লোক পাঠিয়ে সেই ব্যক্তিকে ধরে আনলেন। তারপর নাকে খৎ দিয়ে দিলেন যেন আর কোনোদিন এই ভুল না হয়।"

আড্ডার আরেক অংশী স্বপন দাস—যিনি সুশীল বসুকে দেখেছেন—বললেন, তিনি ছিলেন ডাকসাইটের জমিদার বিনয় বসুর ছেলে। বিনয় বসু ফেকুনাসারের জেলেদের খুঁজে পাওয়া কালাচাঁনের মূর্তি দেখে বলেছিলেন, "তোরা তো যত্ন নিতে পারবি না, আমি মন্দির গড়ে সোনার আসনে রাখব। তোরা পূজার প্রসাদ পাবি।" বসুদের গড়া এই কালাচাঁন মন্দিরটি আজও টিকে আছে, সংস্কার হয়ে শ্রীবৃদ্ধিও হয়েছে।
সুশীল বসু দেশ স্বাধীন হওয়ার চার বছর পরে দেশ ছেড়েছিলেন। তার চলন-বলনে জমিদারি ঠাট ছিল, শরীর ছিল শক্তপোক্ত। কথা আর কাজে মিল ছিল। দোনলা বন্দুক ছিল তার, পাঠা বলি দিতেন। তালতলা বাজারে শখের বশে ওষুধের দোকানও দিয়েছেন। স্বপন দাস যখন এসব কথা বলছিলেন, মনে হচ্ছিল তিনি সুশীল বাবুকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন।
সাধন চক্রবর্তীর কথাতেও সুশীল বাবুর কথা ভুলে যাননি। বসুদের ক্লাবঘরের কথাও মনে রেখেছেন। ক্লাবঘরের পাশে যে ষোলআনি মাঠ আছে, সেখানে যাত্রা হত দুর্গাপুজোর পরের সাতদিন। বাবুল অপেরা, অম্বিকা অপেরার পালা এখনো তার চোখে লেগে আছে। ষোলআনি মাঠ আজও আছে, সবুজ ঘাসে ঢাকা। এই মাঠে বসুদের সব শরিকের অংশ ছিল; সবার ছেলে-মেয়েরা খেলাধুলা করত। সুশীল বাবু ভালো ফুটবল রেফারিও ছিলেন।

তালতলা বাজারেরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বসু পরিবার। ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা এই বাজারটি ছিল বেশ বড়। আগে যখন লঞ্চঘাট সচল ছিল, তখন বাজার আরও প্রাণবন্ত ছিল। এখন ধলেশ্বরী যৌবন হারিয়ে খুনখুনে বুড়ি, তালতলা বাজারও তেমনই।
অদ্ভুত ছিল বসু পরিবারটি। এত বড় পরিবারে ছিল নানান রকম মানুষ—স্বদেশী কর্মী, বিজ্ঞানী, কবি, খেলোয়াড়, গায়কসহ বহু প্রতিভাবান ব্যক্তি। দুর্গাপূজার সময় সবাই একত্র হতেন, আর বছরের বাকিটা সময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে—পড়াশোনা, চাকরি কিংবা ব্যবসার সূত্রে।
এই পরিবারের আরেক বিখ্যাত কবি সুনির্মল বসু। তিনিই লিখেছিলেন সুবিখ্যাত সেই কবিতা 'সবার আমি ছাত্র'। কয়েকটি লাইন তুললেই সবার মনে পড়ে যায়—
'আকাশ আমায় শিক্ষা দিল
উদার হতে ভাই রে,
কর্মী হবার মন্ত্র আমি
বায়ুর কাছে পাই রে।'
আরেকজন বিখ্যাত বসু ছিলেন ড. শচীন্দ্রনাথ বসু। তিনি ছিলেন জীববিজ্ঞানী ও লেখক। ১৯৬৫ সালে নৃতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ 'প্রাগৈতিহাসের মানুষ' রচনার জন্য তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন।

বৈবাহিক সূত্রেও বসু পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তি। তাদের একজন ঠাকুরমার ঝুলির রচয়িতা দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৭৭ সালে, সাভারের উলাইল গ্রামে। ১৯০৮ সালে তিনি বসু পরিবারের কন্যা গিরিবালা দেবীর সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তাদের ঘরে জন্ম নেয় এগারটি সন্তান।
এখন আর বসু পরিবারের লোকেরা মালখানগরে নেই। তবে স্মৃতিচিহ্নগুলো পুরোপুরি মুছে যায়নি। এখনও টিকে আছে ষোলআনি মাঠ, কালাচাঁন মন্দির, ঈশ্বরচন্দ্র বসুঠাকুরের বাড়ির মঠসহ কিছু নিদর্শন। অনেক চিহ্ন মুছে গেলেও স্মৃতি টিকে আছে, বিশেষ করে বয়োজ্যেষ্ঠদের মনে। যতদিন তারা বেঁচে থাকবেন, ততদিন ভালো-মন্দে মিলিয়ে বেঁচে থাকবে বসুদের সেই ঐতিহ্যও।