এখনও জমজমাট সিরাজগঞ্জের শতবর্ষী পাঁচলিয়া গামছার হাট

পুব আকাশে ভোরের আলো ঠিকমতো ফোটার আগেই জেগে ওঠে সিরাজগঞ্জের পাঁচলিয়া। চারপাশ যখন আবছা অন্ধকারে ঢাকা, তখনই দূর-দূরান্ত থেকে আসা তাঁতি আর পাইকারদের পদচারণায় মুখর হতে শুরু করে পুরো এলাকা। মাথায় গামছার রঙিন বোঝা নিয়ে নিয়ে তাঁতিদের হাঁকডাক, আর দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকারদের দরাদরি—এই দুইয়ে মিলে প্রাণ ফিরে পায় চারপাশ।
এটাই দেশের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন এই পাঁচলিয়া গামছার হাট। শতবর্ষী এই হাট আজও সিরাজগঞ্জের তাঁতশিল্পের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
প্রতি সপ্তাহের মঙ্গলবার ও শুক্রবার উল্লাপাড়া উপজেলার এই হাটে বসে রঙের মেলা। বাঙালির জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শত শত রঙের গামছার বিপুল সমাহার দেখা যায় এখানে—ভোর থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য।
সিরাজগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে, যমুনা সেতুর পশ্চিম প্রান্তের কাছে পাঁচলিয়া বদরুল আলম উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে ভোর থেকে সকাল নয়টা পর্যন্ত চলে এই হাটের কেনাবেচা।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড ও হাট কমিটি সূত্রে জানা যায়, প্রতি হাটে এখানে দুই থেকে তিন কোটি টাকার গামছা বেচাকেনা হয়।

স্থানীয় সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বলেন, 'এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে পাঁচলিয়ায় শুধু রঙিন গামছা বিক্রির জন্য এই বিশাল হাট বসে আসছে। এখানকার গামছার খ্যাতি এখন শুধু দেশে নয়, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা এমনকি মিয়ানমারের কিছু অংশেও ছড়িয়ে পড়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'ব্যবসায়ীরা এখান থেকে গামছা কিনে বিদেশেও পাঠান। বিশেষ করে ইউরোপ, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় থাকা প্রবাসীদের মধ্যে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।'
পাঁচলিয়া গামছার হাটের গোড়াপত্তন হয়েছিল এক শতাব্দীরও বেশি আগে, যখন সিরাজগঞ্জের বয়নশিল্পের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্থানীয় কারিগরদের দক্ষ হাতে তৈরি উন্নত মানের গামছার জন্য এই জেলা বিখ্যাত হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে এই হাটটিই হাতে বোনা গামছা কেনাবেচার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়।
হাটের অন্যতম প্রবীণ ব্যবসায়ী মুক্তার শাহ স্মৃতিচারণা করে বলেন, 'প্রায় একশ বছর আগে গামছার ব্যবসার জন্য পাঁচলিয়ায় এই হাট বসে। তাঁতিরা মাথায় গামছার বোঝা নিয়ে ঘুরে বেড়ান। দাম পছন্দ হলে পাইকাররা তা কিনে নেন।'
এই হাটটি মূলত পাইকারি। প্রতিটি বোঁচকায় ২০ থেকে ৫০ বা তারও বেশি 'থান' কাপড় থাকে এবং প্রতি থানে থাকে চারটি গামছা। আকার ও মান ভেদে প্রতি থান গামছা ৬০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়।

তাঁতিদের সুখ-দুঃখের উপাখ্যান
কাছের হাতিমকুমরুল ইউনিয়নের পাচিল গ্রামে ঢুকতেই কানে আসে তাঁতের খটখট শব্দ। এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই চলে তাঁতের কাজ। সুতায় রং করা, চরকায় সুতা কাটা থেকে শুরু করে তাঁত চালানো—সব কাজই নারী-পুরুষ মিলে করেন।
হেদায়েতুল্লাহ নামের এক তাঁতি বলেন, 'একজন তাঁত শ্রমিক দিনে আট থেকে দশটি গামছা বুনতে পারেন। এক থান বা চারটি গামছা বুনে আমরা ১২০ টাকা মজুরি পাই।'
যারা এই কাপড় বোনেন, তারা 'কারিগর' হিসেবে পরিচিত। একসময় তাচ্ছিল্য করে 'জোলা' বলা হলেও এখন সেই পরিচয়ের গণ্ডি পেরিয়েছে অনেকে। কৃষিকাজ ছেড়েও বহু পরিবার এখন তাঁতশিল্পকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে, নিজেরা কারখানা গড়ে তুলেছে।
সিরাজগঞ্জের হাজার হাজার পরিবারের জীবিকা এই গামছাকে কেন্দ্র করেই চলে। কিন্তু তাঁতিদের জীবনে সংকটও কম নয়। পাচিলা গ্রামের তাঁতি আজাহার শাহ বলেন, 'শুধু তাঁত বুনে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। তবু এই পেশা ছাড়তে পারি না, কারণ এছাড়া আর কোনো কাজ আমরা জানি না।'
একই সুর শোনা গেল নিজের ছোট কারখানার গামছা হাটে বেচতে আসা রঞ্জু মিয়ার কথায়। তিনি বলেন, 'বারবার সুতা ও রঙের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় আমাদের তেমন লাভ থাকছে না। একটা সময় লাভ হলেও এখন আর তেমন কিছুই থাকে না।'
ক্রমবর্ধমান খরচ আর কমে আসা লাভের মুখে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি সহায়তা জরুরি বলে মনে করেন তাঁতিরা। সুতা ও রঙের দাম কমানো এবং সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা না গেলে এই শিল্পকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা তাদের। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় এক লাখের বেশি মানুষের জীবন এখন তাঁতের শব্দের সঙ্গেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
এই হাটে শুধু গামছাই নয়, গামছা তৈরির সুতাও বিক্রি হয়। তাঁতিদের অভিযোগ, সুতা ও রঙের দাম ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, যা তাদের লাভের অংশ প্রায় কেড়ে নিচ্ছে।

মাস দুয়েক আগেও ৬০ কাউন্টের এক পাউন্ড সুতার দাম ছিল ২৭৫ থেকে ২৮০ টাকা, যা এখন বেড়ে ২৯৩ থেকে ২৯৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। পাউন্ডপ্রতি সব ধরনের সুতার দামই ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে। একইভাবে, চীন থেকে আমদানি করা তাঁতের যন্ত্রাংশের দামও ঊর্ধ্বমুখী।
বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামের তাঁতি আমিরুল ইসলাম বলেন, 'সুতার দাম বেড়েছে, যন্ত্রপাতির দামও বাড়তি। এতে আমাদের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু সেই তুলনায় হাটে কাপড়ের দাম পাচ্ছি না। ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।'
বদলে গেছে হাটের চিত্র
যদিও আগের সেই রমরমা অবস্থা এখন আর হাটে নেই। পাইকশা গ্রামের বিক্রেতা একরামুল শাহ বলেন, 'আগের চেয়ে বেচাকেনা অনেক কমে গেছে। সুতা, রং ও অন্যান্য উপকরণের দাম বাড়লেও সেই অনুপাতে গামছার দাম বাড়েনি। ফলে আমাদের তেমন লাভ থাকছে না। তার ওপর কয়েক মাস ধরেই বাজারে গামছার চাহিদা কম।'
একসময় সকাল ৮টার মধ্যেই হাট প্রায় শেষ হয়ে যেত। এখন অনেক বিক্রেতাকে অবিক্রীত মাল নিয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। রেহান হোসেন নামের একজন বলেন, 'আগে সকাল ৬টা-৭টার মধ্যেই গামছা বেচে টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। আর আজ ৯টা বেজে গেছে, এখনো গামছা বিক্রি হয়নি। কারণ হাটে মহাজনই নেই।'
পাইকারি ক্রেতারাও লোকসানের কথা বলছেন। বিপুলবাড়িয়া থেকে আসা পাইকার হানিফ শাহ বলেন, 'যে গামছা আগে ৪০০ টাকায় বিক্রি করতাম, এখন সেই একই গামছা ৩০০ টাকায় বেচতে হচ্ছে। খরচ বাদ দিলে লাভ প্রায় থাকেই না।'
নূর-এ-আলম নামের এক ব্যবসায়ী যোগ করেন, 'বাজারের এই মন্দার কারণে অনেকেই পেশা বদল করছেন। যে গামছা আগে ২৫০ টাকায় বিক্রি হতো, তা এখন ১৫০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।'
তবে এত হতাশার মাঝেও কেউ কেউ আশাবাদী। শাহ কামারখন্দের আলম ও কাজীপুরের আনু শাহর মতো ব্যবসায়ীরা প্রায় ২০ বছর ধরে এই পেশায় আছেন। আলম বলেন, 'এখন বাজার কিছুটা ভালো। গত সপ্তাহে যে থান ৩৫০ টাকায় কিনেছি, এ সপ্তাহে তা ৪০০ টাকা। এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে বাঁচাতে হলে সুতা ও রঙের বাজারের ওপর সরকারি নজরদারি এবং ঋণের ব্যবস্থা করা জরুরি।'

জিআই পণ্যের স্বীকৃতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন
এতসব সংকটের মধ্যেও আশার আলো দেখাচ্ছে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড। সিরাজগঞ্জের গামছাকে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। এই স্বীকৃতি পেলে ঐতিহ্যবাহী এই বয়নশিল্প সুরক্ষা পাবে এবং বিশ্ববাজারে এর প্রচার বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ তাঁত বোর্ডের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা অমিত সরকার বলেন, 'গামছাকে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমরা একটি গবেষণা সন্দর্ভ জমা দিয়েছি। এটি বাংলাদেশ প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশনস দপ্তরের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।'
তিনি আরও জানান, তাঁত ব্যবসাকে উৎসাহিত করতে এবং তাঁতিদের সহজে ব্যবসা পরিচালনায় সহায়তা করতে বোর্ড সহজ শর্তে ঋণ ও আর্থিক সহযোগিতাও দিচ্ছে। সুতা ও রঙের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্যেও বোর্ড কাজ করবে বলে তিনি আশ্বাস দেন। তাঁতিদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হবে বলে জানান তিনি।
গামছা কেবল এক টুকরো কাপড় নয়, এটি বাঙালি পরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য প্রতীক। মাঠে, ঘাটে, ঘরে—সর্বত্র এর সরব উপস্থিতি। শহুরে জীবনে তোয়ালের ব্যবহার বাড়লেও গামছা তার আবেদন হারায়নি।
আর পাঁচলিয়ার মানুষের কাছে এটি শুধু একটি পণ্য নয়, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্মে বয়ে চলা এক উত্তরাধিকার, তাদের জীবন-জীবিকার মূল অবলম্বন। কাঁধে গামছার বোঝা নিয়ে বিক্রেতাদের হাঁকডাক আজও হাটের বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়, জানান দেয় তাদের টিকে থাকার গল্প। বাপ-দাদার পথ ধরেই নতুন প্রজন্মও ভোরের আলো ফোটার আগেই মাথায় গামছার বোঝা নিয়ে হাজির হয় এই হাটে, দিনের প্রথম বেচাকেনার অপেক্ষায়।
হাটের কোলাহল যখন ধীরে ধীরে মিলিয়ে আসতে থাকে, তখন চোখে পড়ে এক চিরচেনা দৃশ্য—পুরুষদের টাকা গোনার ব্যস্ততা, নারীদের রঙিন কাপড় ভাঁজ করার দৃশ্য। আর দূর থেকে ভেসে আসা তাঁতের সেই নিরন্তর খটখট শব্দটাও যেন জানিয়ে দেয় দিনের কাজের সমাপ্তি।
পাঁচলিয়া গামছার হাট তাই শুধু একটি বাজার নয়, এটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের টিকে থাকার সংগ্রামের এক জীবন্ত স্মারক। শতবর্ষী এক গল্প, যা আজও বোনা হচ্ছে—এক একটি সুতোর টানে।