জলবায়ু-সহনশীল ‘উভচর বাড়ি’: ভেসে থাকে বন্যায়ও, তাপপ্রবাহে থাকবে শীতল

এমন একটি বাড়ি, যা কিনা শুষ্ক মৌসুমে মাটিতে স্থির থাকবে, তবে বন্যার সময় পানিতে ভেসে থাকবে নৌকার মতো আর তপ্ত গ্রীষ্মের মধ্যেও ভিতরে থাকবে ঠাণ্ডা—এমন বাড়ির কথা শুনলে তা যেন স্বপ্নের বাড়ির মতো মনে হয়। বাংলাদেশের যেসব বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে, যেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার বাড়ি পানিতে ডুবে যায়, আবার গরমের দিনগুলোতে ঘরগুলো এক প্রকার চুলার মতো হয়ে ওঠে, সেখানে এমন একটি 'স্বপ্নের বাড়ি'র সন্ধান মিললে তো মন্দ হয় না।
তবে এরকম বাড়ি এখন আর শুধু কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ নয়; বাস্তবে তৈরি হয়েছে এর একটি প্রোটোটাইপ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে একাধিক উদ্ভাবনী, জলবায়ু-সংবেদনশীল স্থাপত্য দেখা গেছে। সাশ্রয়ী মূল্যের বাঁশের কাঠামো থেকে টিনের ঘর পর্যন্ত নানা নকশা স্থানীয় সম্প্রদায়কে সাহায্য করেছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়তে থাকা ক্ষয়-ক্ষতি মোকাবিলা করতে, বিশেষ করে উপকূলীয় এবং নদীপথ সংলগ্ন এলাকায়।
সাসটেইনেবল ডিজাইনার ড. নন্দন মুখার্জী এক সহজ প্রশ্ন করেছিলেন—বাংলাদেশির স্বপ্নের ঘর ঠিক কেমন হওয়া উচিত? হাজার হাজার মানুষের প্রতিক্রিয়ার পর তিনি এমন একটি নকশা তৈরি করলেন, যা শুধু দেখতে সুন্দর নয়, বরং জলবায়ু বিপর্যয় এবং প্রায় আট মাত্রার ভূমিকম্পের আঘাতও সহ্য করতে পারে। এটি মূলত বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের 'স্বপ্নের বাড়ি'র ধারণাকে প্রতিফলিত করে।
'বাঁশের ঘর খুবই ভালো, কিন্তু আমার স্বপ্নের ঘর বাঁশের নয়—এটি হবে একটি পাকা (ইট ও মর্টার) ঘর,' গবেষণার মাধ্যমে যা তিনি আবিষ্কার করেছেন, তার সারমর্ম তুলে ধরলেন নন্দন। বর্তমানে ড. নন্দন মুখার্জী ইউনেস্কো সেন্টার ফর ওয়াটার ল, পলিসি অ্যান্ড সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি-তে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন।

অ্যাম্ফিবিয়াস বা 'উভচর বাড়ি' বলতে বোঝায় যা কিনা শুষ্ক মাটিতে স্থির থাকবে, আবার বন্যার সময় ভেসে উঠতে পারে।
ঢাকার উত্তরখান এলাকায় অবস্থিত এই 'উভচর বাড়ি' প্রথম নজরে সাধারণ একটি তিন তলা ভবনের মতোই মনে হয়—বাঁশের সিঁড়ি, বড় জানালা বাতাসপ্রবাহের জন্য এবং মাটির রঙের দেয়াল। তবে এর ফাউন্ডেশনের নিচে লুকানো রয়েছে ভাসমান ভিত্তি, যা বন্যার সময় পুরো কাঠামোকেই জলস্তরের সঙ্গে ভেসে উঠতে সাহায্য করে।
বাড়িটির কোণের চারটি উল্লম্ব গাইডপোস্ট একে স্থিতিশীল রাখে এবং ভাসমান অবস্থায় তা বয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। বন্যার পানি নামার পর ঘরটি ধীরে ধীরে আবার মাটিতে ফিরে বসে।
'এটি মূলত আরকিমিডিসের নীতি," বলেন নন্দন মুখার্জী।
'এই ঘরটির ওজন ২৫০ টন। ফেরি যেভাবে আরকিমিডিসের নীতি ব্যবহার করে পানিতে ভেসে থাকে, তেমনই আমরা বাড়িটির নিচে ১৭টি ভাসমান বক্স স্থাপন করেছি। এই বক্সগুলো ফ্লোরসহ পুরো ঘরের ওজন ধারণ করে। প্ল্যাটফর্মটি ৩০০ টন পর্যন্ত সহ্য করতে পারে, যা ৫০ টনের নিরাপত্তা মার্জিন দেয়, যাতে এটি কখনও ব্যর্থ না হয়।'
'আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, এটি ভেসে থাকবে।'
নন্দন মুখার্জী কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে জলবায়ু সমাধানভিত্তিক স্থাপত্য নিয়ে কাজ করছেন। অবশ্য এই পথের দিকে তাকে পরিচালিত করেছিল তিস্তা নদীর তীরে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক ঘটনা।
যখন গজলডোবা বাঁধ থেকে হঠাৎ পানি ছাড়ার ফলে তিস্তা নদী অপ্রত্যাশিতভাবে ফুঁসে ওঠে, তখন নদীর তীরবর্তী একটি গ্রামে বন্যার পানি প্রবাহিত হয়। সেই সময় এক নারী বাঁশের মাচায় দাঁড়িয়ে রান্না করছিলেন। হঠাৎই জোরে পানিতে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পান।
মাচার পাশে তার সাত মাসের শিশু বন্যার পানিতে পড়ে যায়। তিনি তাকে বাঁচাতে পানিতে লাফ দেন ঠিকই কিন্তু বাচ্চাটিকে আর বাঁচানো যায় নি। আশেপাশের প্রতিবেশীরা তাকে অবহেলার অভিযোগে অভিযুক্ত করে, স্বামী তালাক দিয়ে দেয়, আর বাচ্চা হারানোর শোকসহ সব মিলিয়ে তিনি পাগলপ্রায় হয়ে যান।
এই ঘটনা নন্দন মুখার্জীর মনে গভীর ছাপ ফেলে।
'সেই সময় আমি আমারই প্রথম সন্তানের অপেক্ষায় ছিলাম,' তিনি বলেন। 'কিন্তু এই ঘটনাটি আমাকে এতটাই আঘাত করেছিল যে আমার সাইকিয়াট্রিস্ট আমাকে বলেছিলেন, আপনার সামনে দুইটি পথ আছে: হয় অপেক্ষা করুন যাতে এই কষ্ট চলে যাক, অথবা এমন মানুষের জন্য একটি সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন।'
নন্দন বেছে নেন দ্বিতীয় পথটি।

তার কাজের সূচনা হয় বন্যাপ্রবণ জেলা শারিয়তপুরে, গ্লোবাল রেজিলিয়েন্স পার্টনারশিপের কাছ থেকে ২ লক্ষ ৫০ হাজার ডলারের অনুদান নিয়ে। প্রায় পাঁচ শতাধিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি এমন একটি বাঁশের 'স্বপ্নের বাড়ি' ডিজাইন করেন, যা বন্যার সময় ভেসে উঠতে পারে এবং একই সঙ্গে নিরাপত্তা, খাদ্য ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে পারে।
২০১৭ সালে নির্মিত প্রোটোটাইপগুলো ২০১৯ সালে ইউএন রিস্ক অ্যাওয়ার্ড জিতে পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী মূল্যের হিসেবে প্রশংসিত হয়। তবে কিছুদিন পর স্থানীয় বালু ব্যবসায়ীরা ঘরগুলো ধ্বংস করে দেয়—যা নন্দনের নকশা উন্নয়নের সংকল্প আরও দৃঢ় করে তোলে।
পরে নন্দন ও তার দল বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাছে পুনরায় জিজ্ঞেস করেন, তারা তাদের 'স্বপ্নের বাড়ি' কেমন দেখতে চায়। অধিকাংশের উত্তর ছিল—বাঁশের কুঁড়েঘর নয়, তাদের চাই পাক ঘর, কংক্রিটের বাড়ি।
কিন্তু প্রচলিত কংক্রিট ব্যবহার বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। বিকল্প খুঁজতে গিয়ে নন্দনের দল ইতিহাসের দিকে নজর দেয়া শুরু করেন, বিশেষ করে হাজার বছর ধরে টিকে থাকা পাথরের পিরামিডের দিকে।
এবং শেষমেশ তাদের উত্তর মিলল আর্থ ব্লকের মধ্যে, যা তৈরি হয় মাটি, বালি ও চুনের একটি মিশ্রণ থেকে। এই ব্লক উৎপাদনের সময় ভাটিতে পোড়ানো ইটের মতো প্রচুর কার্বন নির্গমন হয় না, ফলে ঘরগুলো শুরু থেকেই কার্যত নেট-জিরো।
তবে প্রচলিত যন্ত্রপাতি এই ব্লকগুলো তৈরি করতে যথেষ্ট ছিল না। নন্দন বলেন, 'একসাথে বিশটি ৫ টনের ট্রাকের চাপে এটি তৈরি হয়। পাঁচটি যন্ত্র পরীক্ষা করার পর, ছয় নম্বর যন্ত্রটি শেষ পর্যন্ত নিখুঁত ইট উৎপাদন করল।'
'ঘরটি তৈরি করা হয়েছে কম-কার্বন ইট দিয়ে, যা প্রচলিত ইটের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি শক্তিশালী এবং ৭৫ শতাংশ কম কার্বন নির্গমন করে,' তিনি আরও যোগ করেন।
'বাজারের একটি সাধারণ ইটের দাম প্রায় ১৫ টাকা, কিন্তু আমাদের ইটের দাম মাত্র ৭ দশমিক ৫ টাকা। বুয়েট-এর গবেষণা অনুযায়ী, আমাদের ইট বাজারের ইটের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি শক্তিশালী। সাধারণ ইটের কম্প্রেসিভ শক্তি ২১ মেগাপাস্কাল কিন্তু আমাদের ইট ৩৬ মেগাপাস্কাল পর্যন্ত শক্তিশালী। বাজারের ইট হাজারটি ইটে ২৫৬ কেজি কার্বন নির্গমন করে—আমাদের ইট মাত্র ২৫ কেজি নির্গমন করে, কারণ আমরা এগুলো পোড়ানোর পরিবর্তে কম্প্রেস করি।'

এরকম একটি উভচর বাড়িতে বসবাস করেন মোহাম্মদ সোহেল, পেশায় তিনি শ্রমিক। হাসতে হাসতে বলেন, 'সবচেয়ে তপ্ত রাতেও আরাম করে ঘুমানোর জন্য আমাকে কম্বল নিতে হয়।' ঘরের নকশাই এই আরামদায়ক তাপমাত্রার কারণ।
বাড়িটির নকশা নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বাস্তুসংস্থান হিসেবে কাজ করে। বাড়িটির নিচ তলা খাদ্য ও পানির নিরাপত্তার জন্য উৎসর্গীকৃত।
এছাড়া বাড়িটিতে একটি অ্যাকুাপনিক্স সিস্টেম আছে, যেখানে একই সঙ্গে মাছ এবং সবজি চাষ করা হয়। চাইলে মুরগিও পালন করা যায়। বৃষ্টির পানি সংগ্রহের ট্যাংকে ১৭ হাজার লিটার পানি জমা রাখা যায়, যা পরিস্কার পানীর নিশ্চয়তা দেয়।
আর উপরের তলা বসবাসের জন্য। সেখানে 'গুলগুলি' নামে প্রাকৃতিক বায়ুপ্রবাহের পথ রয়েছে, যা গরম বাতাস ঘরের বাইরে বের করে এবং ঘরের তাপমাত্রা সারাবছর প্রায় ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বজায় রাখে।
৫ কিলোওয়াটের সৌর প্যানেল সিস্টেম ও বায়ু টারবাইন ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। বড় জানালা এবং বাঁশের খুঁটির ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো প্রবেশ করে ঘরগুলোকে মধুর আলো দিয়ে রাঙিয়ে দেয়।
তবে বাড়িটির কেন্দ্রীয় আকর্ষণ হলো একটি বড়, বাঁকানো বাঁশের সিঁড়ি, যার মাধ্যমে তাপ উপরের দিকে উঠে মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। বাড়ির বাঁশগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করা হয়েছে প্রাকৃতিক লবণ দিয়ে, যা এটিকে স্লাইসার, পচন ও ছত্রাক থেকে রক্ষা করে। পাশাপাশি রেজিনের একটি কোটিংও দেওয়া হয়েছে, যা পানির হাত থেকে রক্ষা করে।
একটি এক-বেডরুমের 'উভচর বাড়ি' প্রায় ৫ লাখ টাকায় নির্মাণ করা যায়, আর চার-বেডরুমের সংস্করণের খরচ পড়বে প্রায় ২৫ লাখ টাকা।
নন্দন বলেন, 'এটি বাংলাদেশের বেশিরভাগ টিনের ঘরের তুলনায় প্রতি বর্গফুটে সস্তা এবং প্রচলিত পাকা ভবনের অর্ধেকেরও কম খরচে তৈরি। একটি কংক্রিট ফ্রেমের ঘরের প্রতি বর্গফুট খরচ প্রায় ৩ হাজার ৩০০ টাকা, অর্ধ-পাকা ইটের ঘর ২ হাজার ৭০০ টাকা, আর টিনের ঘর প্রায় ২ হাজার ২০০ টাকা। তুলনায়, প্রতি বর্গফুটে আমাদের ঘরের খরচ মাত্র ১ হাজার ৫০০ টাকা।'
বাংলাদেশে এই প্রোটোটাইপটি পরীক্ষা করা হয় ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, রেজিলিয়েন্স সলিউশনস, এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ (সিথ্রিইআর)-এর সহযোগিতায়।
বাংলাদেশ, যা কি না বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশগুলোর মধ্যে একটি, তার জন্য অ্যাম্ফিবিয়াস ঘর ভবিষ্যতের একটি দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় এবং অপ্রত্যাশিত বন্যা আগামী কয়েক দশকে প্রতি সাতজনের একজনকে স্থানচ্যুত করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে, এমন ঘরগুলো—যা পানিতে ভেসে উঠতে পারে, বাতাস চলাচল করতে পারে এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ—আর বিলাসিতা নয়; এগুলো হয়ে উঠছে অপরিহার্য।
'উভচর বাড়ি' শুধু একটি উদ্ভাবনই নয়; এটি দুর্ঘটনার মধ্য থেকে জন্ম নেওয়া, টিকে থাকার জন্য তৈরি এবং ভবিষ্যতের জন্য আশা নিয়ে নির্মিত একটি স্বপ্নের বাড়ি।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে নন্দন মুখার্জী বলেন, 'আমাদের গবেষণার কাজ শেষ হয়েছে। ইট থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি পর্যন্ত আমরা একটি পূর্ণ উৎপাদন লাইন তৈরি করেছি। এখন আমরা সম্প্রসারণের দিকে এগোচ্ছি। কারখানাও তৈরি হচ্ছে, এবং আগামী বছর থেকে পূর্ণ উৎপাদনে প্রবেশ করব।"