মশারি নামানো হয় না যে হাসপাতালে, ভরসা হয়ে উঠেছে ডেঙ্গু চিকিৎসায়

১২ জুলাই, দুপুরবেলা। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১১ তলার ওয়ার্ডজুড়ে ঝুলে আছে অর্ধশতাধিক মশারি—এক অদ্ভুত দৃশ্য! সাদা বিছানা, অসুস্থ শরীর, ক্যানোলা লাগানো হাতে ঝুলছে স্যালাইনের পাইপ, আর তার ওপরে ছাতার মতো ঝুলে থাকা মশারির ছায়া—যেন একমাত্র আশ্রয়। এই দৃশ্য যেন নিজেই বলে দিচ্ছে, এখানে চলছে 'ডেঙ্গু যুদ্ধ'।
মায়ের সঙ্গে এই যুদ্ধে শরিক হয়েছে ছোট্ট মিশকাতুল জান্নাতও। বয়স খুব বেশি না, নার্সারিতে পড়ে। স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল, পরীক্ষা ছিল, কিন্তু মা অসুস্থ। ছয়-সাত দিন ধরে মায়ের জ্বর, কিছুতেই সারে না। চারদিকে ডেঙ্গুর ভয়। তাই পরীক্ষা করানো হলো। রিপোর্টে দেখা গেল, রক্তে প্লাটিলেট স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম।
বিলম্ব না করে বাবা জান্নাতের মাকে নিয়ে এলেন মুগদা হাসপাতালে। সঙ্গে জান্নাতও। তিনজনের পরিবার, জান্নাতকে একা রেখে যাওয়ার উপায় ছিল না। প্রয়োজনীয় জামাকাপড় নিয়ে তারা চলে এলেন হাসপাতালে।
তাদের বাড়ি নীলফামারিতে। এত দূর থেকে এখনও কোনো আত্মীয় এসে পৌঁছায়নি। এর মধ্যে বাবার চাকরি নিয়েও চিন্তা—বেসরকারি অফিসে চাকরি করেন তিনি। বেশি সময় হাসপাতালে থাকলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি ভালোভাবে নাও নিতে পারেন। কিন্তু এখন এসব ভাবার সময় নেই। জান বাঁচানোই বড় কথা।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড ওয়ার্ড আছে দুটি— একটি ১১ তলায়, অন্যটি অষ্টম তলায় (শিশুদের জন্য)। ১১ তলার ওয়ার্ডে ৭০টি বেড। বছরের কোনো সময়েই তা খালি থাকে না। ১২ জুলাই, ওয়ার্ডটিতে ভর্তি ছিল ৩৩ জন রোগী। সকালে নতুন করে ভর্তি হন আরও ৩ জন।
হাসপাতালের রেকর্ড খাতা দেখিয়ে এক সিনিয়র নার্স জানালেন, এখন পর্যন্ত জুনের ২৪ তারিখে সর্বোচ্চ ৫১ জন রোগী ভর্তি ছিল। ২০ জুন একদিনেই ভর্তি হয়েছিলেন ৯ জন।

তিনি আরও জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীদের জন্য খাবার, মশারি এবং প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দিয়ে থাকে। ১২ জুলাইয়ের দুপুরে মেনুতে ছিল মুরগির মাংস, সবজি ও ডাল।
কথা হলো আক্তার হোসেনের সঙ্গে। একটু আগেই খাওয়া শেষ করেছেন। বললেন, "এখানে খাবার ভালো দেয়। আমিসহ আমার পরিবারের চারজন একের পর এক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছি এবার। সবাই এখানেই চিকিৎসা নিয়েছি। প্রথমে আমার স্ত্রী, তারপর মেঝো ছেলে, তারপর বড় ছেলে—আর এখন আমি। সব মিলিয়ে দুই মাস ধরে আমি হাসপাতালেই পড়ে আছি।"
দাউদকান্দিতে প্রবাসীর সংখ্যা বেশি, তাই স্বচ্ছল মানুষের সংখ্যাও অনেক। সারাবছরই ভবন নির্মাণ চলে। নির্মাণাধীন ভবনের ভেতরে পানি জমে থাকে দিনের পর দিন—এডিস মশার জন্য একেবারে উপযোগী পরিবেশ।
আক্তারের বয়স ৪৫। বাড়ি চাঁদপুর, তবে কর্মসূত্রে থাকেন কুমিল্লার দাউদকান্দিতে। এবার দাউদকান্দির হাজার হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়— দাউদকান্দিতে ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ বিস্তার কেন?
ডেঙ্গু আক্রান্ত বাবাকে দাউদকান্দি থেকে মুগদা হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন মোহসিনা মিশু। বাবার বয়স পঁয়ষট্টির বেশি। মিশুরা পাঁচ ভাই-বোন, ভাইয়েরা সবাই বিদেশে থাকেন। তাই মা ও মামাকে সঙ্গে নিয়ে তিনিই বাবাকে নিয়ে এসেছেন ঢাকায়।
টানা এক সপ্তাহ ধরে বাবার তীব্র জ্বর ছিল। এরপর শুরু হয় বমি। উপসর্গ দেখে সন্দেহ হয়, পরীক্ষা করালে রিপোর্টে ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। আর দেরি না করে বাবাকে নিয়ে চলে আসেন মুগদা হাসপাতালে। এখন অন্তত এক সপ্তাহ এখানেই থাকতে হবে।
মিশু জানালেন, "দাউদকান্দিতে প্রবাসীর সংখ্যা বেশি, তাই স্বচ্ছল মানুষের সংখ্যাও অনেক। সারাবছরই ভবন নির্মাণ চলে। নির্মাণাধীন ভবনের ভেতরে পানি জমে থাকে দিনের পর দিন—এডিস মশার জন্য একেবারে উপযোগী পরিবেশ। আবার সবকিছু হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে, আশপাশ পরিষ্কার রাখার দিকে কারও মনোযোগ নেই। যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয়।"
মিশুর বাবা জীবনে এই প্রথম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। শরীর তার শক্তপোক্ত। চার-পাঁচ দিন ধরে জ্বর ও মাথাব্যথা হলেও তিনি কাউকে বুঝতে দেননি। ১২ জুলাই সকালে তারা যখন মুগদা হাসপাতালে পৌঁছান, তার আগের রাতেই বাবাকে খাবার দিতে গিয়ে মিশু দেখেন, তিনি বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছেন না।
মাত্র পাঁচ দিন আগে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন মিশুর খালা। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই ভয় পেয়ে যান মিশুরা। দেরি না করে প্রস্তুতি সেরে সকালে চলে আসেন হাসপাতালে।

বৃষ্টি ও তাপমাত্রার সঙ্গে এডিস মশার প্রজননের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বাংলাদেশের জলবায়ু ডেঙ্গু সংক্রমণের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
সাধারণত মে-জুন সময়ে রোগী বাড়তে থাকে, আগস্ট-সেপ্টেম্বরে চূড়ায় পৌঁছায়। এবারের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে আগেই আশঙ্কা করেছিলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা এখন পরামর্শ দিচ্ছেন—প্রতিটি ঘরে ঘরে অভিযান চালাতে হবে। এখনই এডিস মশার বিস্তার ঠেকাতে না পারলে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
অক্টোবরের পর সাধারণত ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে, তখন মুগদা হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ড বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু গত বছর থেকে তা আর সম্ভব হচ্ছে না। সারা বছরই কিছু না কিছু রোগী থাকছেন।
চৌদ্দ বছরের শাকিল হোসেন চার দিন ধরে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। মা সবসময় মশারি টাঙিয়ে রেখেছেন। শাকিল ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ঢাকায় এসে—বোনের বাসা মানিকনগরে। ফেনী থেকে বেড়াতে এসে মাসখানেক থাকার পর জ্বর ওঠে, সঙ্গে বমি ভাব। রক্ত পরীক্ষায় দেখা গেল, প্লাটিলেট কমে পঞ্চাশ হাজারে নেমে গেছে।
ছেলের খবর শুনে মা ছুটে আসেন ফেনী থেকে। এখন দিনরাত ছেলের পাশেই থাকছেন। এরই মধ্যে কাছের একটি পানির এটিএম থেকে ২০ লিটারের জার হাতে হাজির হন শাকিলের বাবা। জানালেন, "হাসপাতালের টয়লেট নোংরা, পানি পাওয়া যায় না অনেক সময়। তাই নিজেরাই ব্যবস্থা করে নিলাম।"
এডিস মশা শুধু দাউদকান্দি বা ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ নয়— বরগুনাও এবার ডেঙ্গুতে রীতিমতো হটস্পট। ১২ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে শনাক্ত হয়েছে সাড়ে ১৪ হাজার ডেঙ্গু রোগী, যার প্রায় ২৬ শতাংশই বরগুনায়।
শাকিলের বাবা দৈনিক বাংলা মোড়ে ভাঙারির ব্যবসা করেন। বললেন, "আমার দোকানেও মশা ভনভন করে। ঢাকার সব জায়গাতেই মশা। আমাদের শরীর মানিয়ে নিয়েছে, কিন্তু ছেলেটা সহ্য করতে পারেনি।"
ডেঙ্গু ওয়ার্ড অন্য ওয়ার্ডগুলোর চেয়ে আলাদা মূলত মশারির কারণে। প্রতিটি বেডেই মশারি টাঙানো। এত মশারি একসঙ্গে টাঙানো দৃশ্য সচরাচর চোখে পড়ে না।
সব বয়সের রোগীই আছে এই ওয়ার্ডে, তবে চল্লিশ থেকে ষাট বছর বয়সীদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি মনে হলো। একটি বেডের পাশে অনেকজনের সমাগম দেখে এগিয়ে গেলাম।
বেডের পাশে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে গল্প করছেন বাচ্চা-বুড়ো সবাই। রোগী সাইফুদ্দিন বসে আছেন বেডে। স্ত্রী ও ছেলে তাকে বরগুনা থেকে এখানে নিয়ে এসেছেন।
স্ত্রী বললেন, "দিনকয়েক ধরেই তার শরীর দুর্বল, মাথা ঘোরে, জ্বরও কমছে না। আমরা ভাবছিলাম ভাইরাস জ্বর। পরে পাশের একজন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু দেখে ভয় পেয়ে যাই। এরপর তাড়াতাড়ি রক্ত পরীক্ষা করাই। ফলাফল দেখে ভয় আরও বেড়ে যায়। প্রথমে ভাবছিলাম বরিশাল হাসপাতালে নেব, পরে সরাসরি মুগদা হাসপাতালে নিয়ে আসি।

চার দিন হলো সাইফুদ্দিন হাসপাতালে ভর্তি। ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। প্রতিদিন রক্ত পরীক্ষা হয়, সেখান থেকেই বোঝা যায় উন্নতি হচ্ছে না অবনতি। ঢাকায় তাদের যত আত্মীয়-স্বজন আছেন, সবাই একে একে দেখতে আসছেন।
তবে হাসপাতাল জীবনে কিছু সমস্যা থেকেই যায়—বিশেষ করে গোসল ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি। এসবের কথা জানালেন সাইফুদ্দিনের স্ত্রী। আশার কথা হলো, যেহেতু রোগীর উন্নতি হচ্ছে, হয়তো আর বেশি দিন থাকতে হবে না।
এডিস মশা শুধু দাউদকান্দি বা ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ নয়— বরগুনাও এবার ডেঙ্গুতে রীতিমতো হটস্পট। ১২ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে শনাক্ত হয়েছে সাড়ে ১৪ হাজার ডেঙ্গু রোগী, যার প্রায় ২৬ শতাংশই বরগুনায়।
গত বছরই কীটতত্ত্ববিদরা বরগুনা নিয়ে সতর্কতা দিয়েছিলেন। তারা জমে থাকা পানিতে বিপুল পরিমাণ এডিস মশার লার্ভা দেখতে পেয়েছিলেন। দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে বছরজুড়ে ব্যবহারের প্রবণতা অনেক পুরোনো। এসব জমে থাকা পানি এডিস মশার প্রজননের আদর্শ পরিবেশ গড়ে তোলে।
এডিস মশা অত্যন্ত চতুর ও অভিযোজনে সক্ষম। জলবায়ু পরিবর্তন এবং মশা নিধনে ব্যবহৃত রাসায়নিকের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে নিজেকে, বের করেছে টিকে থাকার পথ।
এর পাশাপাশি বরগুনার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বেহাল, এবং উঁচু ভবন নির্মাণ চলছে অপরিকল্পিতভাবে— যা বরগুনাকে যেন এডিস মশার খামারে পরিণত করেছে।
মুগদা হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্সও জানালেন, এই ওয়ার্ডে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীদের বেশিরভাগই এসেছেন কুমিল্লার দাউদকান্দি, ঢাকার নন্দীপাড়া ও বরগুনা থেকে।
বাংলাদেশে মশার সঙ্গে যুদ্ধ করতে কামান ব্যবহার পর্যন্ত হয়েছে, নতুন নতুন ওষুধ, যন্ত্রপাতিরও পরীক্ষা চলেছে। কিন্তু মশার সঙ্গে এই যুদ্ধ দিন দিন যেন আরও কঠিন হয়ে উঠছে।
বিশেষ করে এডিস মশা অত্যন্ত চতুর ও অভিযোজনে সক্ষম। জলবায়ু পরিবর্তন এবং মশা নিধনে ব্যবহৃত রাসায়নিকের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে নিজেকে, বের করেছে টিকে থাকার পথ।
একসময় জানা ছিল, এডিস মশা কেবল পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। এখন দেখা যাচ্ছে, তারা ডিম দিচ্ছে সুয়ারেজ, ড্রেন এমনকি লোনা পানিতেও—এবং জীবনচক্রও সম্পন্ন করছে।
এ অবস্থায় সংশ্লিষ্টরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কিউলেক্স মশা মারার ওষুধ দিয়ে এডিস মশা নিধনের চেষ্টা হাস্যকর। সেই সঙ্গে সামাজিক সচেতনতার কথা আরও জোরালোভাবে সামনে আনছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, সব বাড়ির বারান্দায় বা উঠোনে জমে থাকা পানিতে ওষুধ ছিটানো সম্ভব নয়। তাই বাসিন্দাদেরই সচেতন হতে হবে। মহল্লাবাসী সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ না নিলে এই যুদ্ধ জেতা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
- ছবি: আসমা সুলতানা প্রভা/দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড