নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রাতের জৌলুস হারিয়ে এখন প্রায় জনশূন্য ৩০০ ফিট

২০২৩ সালের শেষের দিকে উদ্বোধনের পর থেকেই '৩০০ ফিট' নামে পরিচিত পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে একটি জনপ্রিয় আড্ডার স্থান হয়ে উঠেছিল।
ঢাকার বাসিন্দাদের যেখানে খোলা স্থানের দেখা পাওয়া প্রায় অসম্ভব, সেখানে ৩০০ ফিটের বিশালাকৃতির গোলাকার জাংশন ঢাকার বাসিন্দাদের জন্য নতুন আকর্ষণ হয়ে ওঠে। বাইক রেস, টিকটক শুটিং বা রাতের আড্ডা– কুরিল বিশ্বরোড থেকে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত বিস্তৃত ৩০০ ফিটে এসব জিনিসের দেখা মিলত।
এক বছর পর, হইহুল্লোড় অনেকটাই কমে গেছে এবং সেটি মূলত নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে।
যখন আমরা গত বছরের মার্চে স্থানটি পরিদর্শন করেছিলাম, তখন আমরা স্থানটি নিয়ে এতটা উত্তেজনার কারণ দেখতে পেয়েছিলাম।
সন্ধ্যা নামতেই এবং বাতিগুলো জ্বলার সাথে সাথেই, প্রশস্ত রাস্তাটির আশেপাশের পরিবেশ জীবন্ত হয়ে ওঠে এবং ভিড় আরও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। মানুষ দৃশ্য উপভোগ করতে জড়ো হন এবং কিছু মানুষ সুন্দর সূর্যাস্ত দেখার জন্য বিরতি নেন। পাশাপাশি, ফটোগ্রাফাররা টাকার বিনিময়ে দর্শনার্থীদের ছবি তোলার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। টিকটকাররা ভাইরাল নাচের রুটিন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, আবার তরুণদের রাতে গাড়ি প্রদর্শনীর আয়োজন করতে দেখা যায়। এটা কি আসলেই বহুলেনের ব্যস্ত মহাসড়ক, নাকি জনসাধারণের জন্য একটি পার্ক– সেটি বুঝে ওঠা কঠিন ছিল।
কিন্তু যখন আমি এ বছরের ১৫ মার্চ আবারও ৩০০ ফিট পরিদর্শন করি, দৃশ্যপট সম্পূর্ণভাবে পাল্টে গেছে।
আমি কুরিল বিশ্বরোড থেকে নীলা মার্কেট পর্যন্ত একটি অটোরিকশা নিয়েছিলাম। যখন আমি রিকশা থেকে নামলাম, তখন চারপাশে খুবই কম মানুষ ছিল। শুধু সমস্ত দিক থেকে গাড়ির অবিরাম চলাচল লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। একপাশে কয়েকজন যুবক ক্যামেরা হাতে ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিল।
ঘড়িতে সময় তখন বিকেল ৪টা।
এখানে সড়ক পার হওয়া অনেকটা গোলকধাঁধার ভেতর দিয়ে পথ চলার মতো। তবে আমি সতর্কতার সঙ্গে সড়ক পার করে রূপগঞ্জের বালু নদীর তীরের খাবারের দোকানগুলোতে চলে গেলাম। হাঁসের মাংসের লোভ সামলাতে না পেরে, সেখানেই আমার ইফতার করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এদিকে, আমি এলাকা ঘুরে দেখছিলাম। নীলা মার্কেটে দোকানদাররা তাদের খাবারের দোকান খোলার কাজে ব্যস্ত ছিলেন, কারণ ইফতারের তখন মাত্র দুই ঘণ্টা বাকি ছিল। তবে, চোখে পড়ার মতো তেমন কোনো ভিড় ছিল না।
পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানতাম, সূর্যাস্তের পর এখানকার পরিবেশ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। তাই আমি সূর্যাস্তের জন্য অপেক্ষা করলাম।
কিন্তু যখন আকাশ ক্রমশ অন্ধকার হতে লাগল এবং রাত নেমে এল, তখন আমি লক্ষ্য করলাম, মানুষ আসার পরিবর্তে উল্টো যারা সেখানে ছিলেন, তারাই তাড়াহুড়া করে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তখনই আমি বুঝতে পারলাম, পরিস্থিতি বদলে গেছে।
আমি লক্ষ্য করলাম, নীলা মার্কেটের অর্ধেকেরও বেশি দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। এক চায়ের দোকানির কাছে আমি এর কারণ জানতে চাইলাম।
তিনি উত্তর দিলেন, 'তারা রাত ১২টা পর্যন্ত কতটাই আর কামাই করতে পারে?' তিনি তিনি ব্যাখ্যা করলেন, দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায়, এই রমজানে সেনাবাহিনী এখানে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
'রাত ১২টা বাজলেই সেনাবাহিনী টহল শুরু করে। শুধু টহলই নয়, তারা জোর করে সব দোকান বন্ধ করে দেয়। আগে দোকানগুলো সারারাত খোলা থাকত। এখন আমাদের ব্যবসা কীভাবে টিকবে?'
তার কণ্ঠে হতাশা ছিল। আশপাশের মানুষের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারলাম, বেশিরভাগই স্থানীয় বাসিন্দা। আমার মতো কয়েকজন দর্শনার্থী ছাড়া কেউ ছিল না।
তিনি স্বীকার করলেন, এই এলাকার পরিস্থিতি আসলেই খারাপ। বিশেষ করে চুরি এবং খুনের মতো অপরাধ বেড়েছে। তাই জননিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এত কড়া নিরাপত্তা।
এই এলাকা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের আদর্শ জায়গা হয়ে উঠেছে এবং বেশিরভাগ অপরাধ রাতেই সংঘটিত হচ্ছে। এক মাস আগে কাছের একটি লেকে এক ব্যবসায়ীর ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়।
নাহিদুল ইসলাম রাফি নামে এক যুবক প্রায়ই এই রাস্তায় গাড়ি চালান। তিনি বলেন, 'এখানে চুরি এবং ডাকাতির ঘটনা ঘটে। তাছাড়া, রাতের আঁধারে ব্রিজের নিচে গোপন জায়গাগুলোতে অশ্লীল এবং সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড দেখা যায়।'
রাফি আরও বলেন, সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলো অনেক ভয় তৈরি করেছে। তারপর থেকেই পুলিশ এবং র্যাবের টহল বাড়ানো হয়েছে।
সড়কটি যানবাহন ও পথচারীদের জন্যও অনিরাপদ।
গত বছরের ডিসেম্বর মাসে একটি প্রাইভেট গাড়ির ধাক্কায় বুয়েটের একজন শিক্ষার্থী মারা যান। যথেষ্ট প্রশস্ত হলেও, বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর কারণে ৩০০ ফিটের সড়কটি মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে।
বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে এই সড়কে ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২৪ সালেই ১২ জন মারা গেছে।
এই দুর্ঘটনাগুলোর কারণ হলো– অবৈধভাবে গাড়ি পার্কিং, অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অতিরিক্ত গতি এবং হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল চালানো।
যৌথ বাহিনী প্রায়ই অপ্রত্যাশিতভাবে এখানে অভিযান পরিচালনা করে। গত বছরের নভেম্বর মাসে অবৈধ পার্কিং, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অতিরিক্ত গতি এবং অন্যান্য আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে একটি অভিযান পরিচালিত হয়। সেই সময় মোট ১১৯টি মামলা করা হয় এবং ২ লাখ ৭০ হাজার ৮০০ টাকা জরিমানা করা হয়।
আমি ফেরার পথে মূল এক্সপ্রেসওয়েতে কিছু ভিড় দেখেছিলাম। তাদের মধ্যে কেউ দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছিলেন, আবার কেউ ঠান্ডা হাওয়ায় আরাম করছিলেন। তবে, গত বছরের উন্মাদনা এখন আর নেই।