সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে নিরাপত্তা ঝুঁকি দেখছে গোয়েন্দা সংস্থা

দেশের বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে ঈদুল ফিতরের ছুটিতে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এই ব্যপারে গোয়েন্দা সংস্থাটি একটি বিশেষ প্রতিবেদন গত ১৫ মার্চ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। এতে টার্মিনালে বড় দুর্বলতাগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
গোয়েন্দা পর্যবেক্ষণ বলছে, সদরঘাট টার্মিনালের প্রবেশ গেটে নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। এখানে প্রবেশ ও প্রস্থানের জন্য ২১টি গেট ও ১৮টি গ্যাংওয়ে রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব গেট ও গ্যাংওয়ে দিয়ে যাত্রী প্রবেশের সময় কোনো ধরনের তল্লাশি বা চেকিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় জনসাধারণ অনায়াসে টার্মিনালে প্রবেশ করতে পারে। চেকিং ব্যবস্থা না থাকায় যাত্রীবেশে নাশকতাকারীরা সহজে ককটেল, বোমাসহ দাহ্য পদার্থ নিয়ে লঞ্চে ভ্রমণ করতে পারে।
গোয়েন্দা সংস্থাটি জানিয়েছে, লঞ্চে যাত্রীরা কী কী পণ্য বহন করতে পারবে এবং কী কী পণ্য পরিবহন করতে পারবে না, তার কোনো নির্দেশনামূলক লিফলেট বা সাইনবোর্ড নেই। যাত্রীরা কী কী মালামাল নিয়ে লঞ্চে প্রবেশ করে, তারও কোনো তদারকি নেই। ফলে মালামাল ঝুঁকিপূর্ণভাবে পরিবহন হচ্ছে।
গোয়েন্দা সংস্থাটি আরও উল্লেখ করেছে, অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালামাল লঞ্চে আনা-নেওয়া করা হয়, যেগুলোর বেশিরভাগই ইঞ্জিন রুম ও তার আশপাশে রাখা হয়। এছাড়া লঞ্চের ইঞ্জিন রুমের পাশে যাত্রীদের মোটরসাইকেল পার্কিং করা হয়, যা বড় ঝুঁকির কারণ।
এছাড়াও প্রতিবেদনে অন্যান্য সেসব ঝুঁকির উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে আছে সিসি ক্যামেরা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপর্যাপ্ততা, ছোট নৌকা দিয়ে লঞ্চে যাত্রী উঠানো, টার্মিনালের পন্টুনে যত্রতত্র হকারদের আধিক্য, শ্রমিকদের দৌরাত্ম্য, টার্মিনাল ও লঞ্চে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ও এগুলো ব্যবহার করতে পারার মতো দক্ষ জনবলের অভাব, যাত্রীদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বর যাচাই না করা, যাত্রী ধারণক্ষমতা অনুযায়ী পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট ও বয়া না থাকা এবং যাচাই-বাছাই ব্যতীত ঈদে অতিরিক্ত লোকবল নিয়োগ।
গোয়েন্দা সংস্থাটি বলেছে, প্রায় প্রতিটি লঞ্চে ইঞ্জিন রুমের পাশে গ্যাস সিলিন্ডার অথবা কেরোসিনের স্টোভ দিয়ে রান্না করতে দেখা যায়, যা অগ্নিনিরাপত্তার বড় ঝুঁকির কারণ। পাশাপাশি লঞ্চের ভেতর মাদক সেবন ও জুয়ার আসর বসে, যা যাত্রীদের বড় নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ।
সুপারিশ
এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় গোয়েন্দা সংস্থাটি বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে আছে নিরাপত্তা জোরদারে লঞ্চ টার্মিনালে নির্দিষ্ট সময়ে যাত্রী প্রবেশ ও বের হওয়ার ক্ষেত্রে আলাদা গেইট ব্যবহার, প্রবেশ গেটগুলোতে আর্চওয়ে স্থাপন এবং প্রতিটি গেটে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত রাখা।
এছাড়াও সংস্থাটি প্রধান প্রধান লঞ্চ টার্মিনালে অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন ও সার্বক্ষণিক টহলের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছে।
অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে যাত্রীদের ওঠার ভিডিও করা ও তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র কার্ড ও মোবাইল নম্বর সংগ্রহ এবং ছবি তুলে রাখা; প্রতিটি লঞ্চে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র স্থাপন ও ব্যবহারের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা।
এছাড়া প্রতিবেদনে টার্মিনাল এলাকা থেকে সব হকারকে উচ্ছেদের ব্যবস্থা করা, অতিরিক্ত লোকবল নিয়োগ করার সময় পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই ও কর্মচারীদের ছবিসংবলিত বায়োডাটা সংরক্ষিত রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে আছে টার্মিনাল ও লঞ্চের প্রবেশ গেটসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা, এবং সন্দেহজনক যাত্রীদের তল্লাশি করা।
ঈদযাত্রায় লঞ্চ টার্মিনাল এলাকায় ছোট ইঞ্জিন ও ডিঙি নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ করা এবং লঞ্চে মোটরসাইকেল ও দাহ্য পদার্থ পরিবহন নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
মন্ত্রণালয় যা বলছে
এসব বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ টিবিএসকে বলেন, তারা সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
তিনি বলেন, 'আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বাড়ানো ও টহল জোরদার করা হয়েছে। তবে ঈদে শত শত যাত্রী একবারে প্রবেশ করার কারণে সবাইকে তল্লাশি করা সম্ভব হবে না।
'আর এখন আর্চওয়ে বাসানো কঠিন আমাদের জন্য। তারপরও এই বিষয়ে আমরা আলাপ করছি।'
ঈদযাত্রা তুলনামূলক স্বস্তিদায়ক
গতকাল (২৭ মার্চ) লঞ্চে যাত্রী অনেক বেড়েছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) যুগ্ম পরিচালক আলমগীর কবির বলেন, '২৪ মার্চ থেকেই লঞ্চে যাত্রী বাড়ছিল। তবে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে যাত্রীর পরিমাণ অনেক বেড়েছে ঘাটে। সব লঞ্চই প্রায় পূর্ণ যত্রী নিয়ে ঘাট ছেড়েছে। আজ রাত পর্যন্ত প্রায় ১৫০টির মতো লঞ্চ বিভিন্ন গন্তব্যে যাবে।'
এবার বাস ও ট্রেন যাত্রা তুলনামূলক স্বস্তিদায়ক হচ্ছে। বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত যাত্রা ছিল বেশ স্বস্তির। পথে নেই উল্লেখযোগ্য কোনো যানজট বা ভোগান্তি। কঠোর নিরাপত্তার কারণে ট্রেনেও হচ্ছে না কোনো ঝক্কি-ঝামেলা; নেই উল্লেখযোগ্য শিডিউল বিপর্যয়।
কমলাপুর রেলস্টেশনের স্টেশন ম্যানেজার শাহাদাত হোসেন জানান, সাধারণত কমলাপুর থেকে সবচেয়ে বেশি ঘরমুখো মানুষ ট্রেনযোগে ঈদযাত্রা করেন। এ কারণে বাড়তি নজর রয়েছে কমলাপুরে। 'যাত্রীদের নিরাপদ যাত্রা সফল করতে আমরা বদ্ধপরিকর।'
দেশ ট্র্যাভেলস-এর ম্যানেজার মো. জানে আলম রাজন বলেন, এবার রাস্তায় কোনো যানজট বা ভোগান্তি নেই।
'আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অনেক তৎপর। আমরা সময়মতো সব বাস ছাড়তে পারছি। আগে থেকে টিকিট কাটায় যাত্রীদেরও হুড়োহুড়ি নাই। বলা যায়, এখন পর্যন্ত ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক হচ্ছে,' বলেন তিনি।
এদিকে গতকাল অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগে বিআরটিএর মোবাইল কোর্টে ৬টি পরিবহনকে—ক্রাউন পরিবহন, একতা ট্রাভেলস, গোল্ডেন লাইন, রয়েল এক্সপ্রেসকে, গ্রীন লাইন পরিবহন ও ইসলাম পরিবহন—২৬ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।