ঈদের ছুটি শেষে ঢাকামুখী মানুষের ঢল, পথে পথে ভোগান্তি

ঈদুল আজহার ১০ দিনের ছুটি শেষে শনিবার (১৪ জুন) থেকে ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। আজ রোববার অফিস-আদালত খুলছে, তাই গতকাল থেকেই কমলাপুর রেলস্টেশন, সদরঘাট ও বিভিন্ন বাস টার্মিনালে ছিল ঢাকা ফেরা মানুষের উপচে পড়া ভিড়।
ভ্যাপসা গরম ও যানবাহনের সংকটে ভোগান্তিতে পড়েন ফিরতি যাত্রীরা। দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থাকা এবং রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার অভিযোগ তুলেছেন যাত্রীরা।
কমলাপুর রেলস্টেশনে উত্তরবঙ্গগামী ট্রেনগুলোতে অতিরিক্ত ভিড় দেখা যায়। অনেক যাত্রী ছাদে চড়ে ঢাকায় ফিরছেন। ট্রেনগুলো সময়সূচির চেয়ে দেরিতে গন্তব্যে পৌঁছানোর কারণে যাত্রীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
সদরঘাটে দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসা লঞ্চগুলোতেও ছিল অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ। লঞ্চে বসার জায়গা না পেয়ে অনেককে দাঁড়িয়ে বা ডেকে বিছানা পেতে বসতে দেখা যায়।
শনিবার ভোর ছয়টার দিকে টিবিএস রিপোর্টার সরেজমিনে গিয়ে দেখতে পান ঢাকা সদর ঘাটে এসে পৌঁছেছে ফারহান-১২, কর্ণফুলী-১৩ সহ বেশ কয়েকটি লঞ্চ। লঞ্চগুলো হাতিয়া থেকে মনপুরা কিংবা বেতুয়া থেকে ভোলার একাধিক ঘাটের যাত্রী নিয়ে ঢাকায় এসে পৌঁছেছে। প্রতিটি লঞ্চের ডেক থেকে শুরু করে ছাদ পর্যন্ত হাজার হাজার যাত্রী।
ভোলার থেকে আসা লঞ্চ ছাড়াও বরিশাল ও চাঁদপুর থেকে বেশ কিছু লঞ্চ ঢাকা সদরঘাটে পৌঁছেছে। ঘাট এলাকায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতি তেমন একটা লক্ষ্য করা যায়নি।
সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে সদরঘাট থেকে রায় সাহেব বাজার পর্যন্ত রাস্তায় পায়ে হেঁটে শত শত যাত্রী ও পুরো রাস্তা জুড়ে যাত্রী নিয়ে বাস দাঁড়িয়ে। এত এত যাত্রীর মধ্যে দু-চারজন ট্রাফিক পুলিশ ছাড়া সদরঘাট থেকে জজকোর্ট পর্যন্ত আর কাউকে চোখে পড়েনি।
এই দিনে ভোরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বরিশাল-ভোলা কিংবা চাঁদপুরসহ অন্যান্য এলাকার যাত্রীরা ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে থেকে বাসে ওঠেন। সেখান থেকে ঢাকার সকল রুটের বাস পাওয়া যায়। কিন্তু প্রায় ৩০ টি বাস নির্দিষ্ট স্টেশন থেকে যাত্রী না তুলে সদরঘাটের কাছ থেকে যাত্রী তোলে। এতে সেখানে জ্যাম তৈরী হয়। এসব সাবে উঠলেই সর্বনিম্ন ভাড়া ১০০ টাকা।
ভিক্টর ও আকাশ বাসের দুজন চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'আমাদের সদরঘাট এরিয়ায় ঢুকতে অতিরিক্ত গাড়ি প্রতি দুই হাজার টাকা দিতে হয়। যার কারণে গাজীপুর, সাভার, যাত্রাবাড়ীসহ কিছুটা রাজধানীর দূরের যাত্রীদের থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নিতে হচ্ছে।'

মানসুর আলম নামে একজন যাত্রী বলেন, সদরঘাট থেকে আকাশ বাসে চড়ে মালিবাগ এসেছি ১০০ টাকা ভাড়া নিয়েছে। যদিও ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকা থেকে বাসে অন্য সময় ভাড়া নিত মাত্র ২০ টাকা। বাসগুলো ঢাকার কাছের এলাকায় যেতে চাওয়া যাত্রীদের গাড়িতে তোলেন না। তুললেও কয়েকগুণ ভাড়া বেশি নেন।
ভোলা থেকে আসা ফারহান-৬ লঞ্চের যাত্রী হাবিবউল্লাহ, রাজিব হোসেন জানান, লঞ্চে উঠে দেখেন কোথাও দাঁড়ানোর মতো সুযোগ নেই। পুরো লঞ্চজুড়ে নারী-শিশুদের চিৎকার-চেঁচামেচি, প্রচণ্ড গরমে শিশুদের ভয়াবহ খারাপ অবস্থা। হুড়োহুড়ি করে লঞ্চের ছাদেই উঠেছে শত শত যাত্রী। ভোররাতের দিকে বৃষ্টিতে কাকভেজা অবস্থা হয়েছে তাদের।
হাসানাইন আহমেদ এসেছেন ভোলা থেকে তিনি বলেন, কর্ণফুলী ১৩ লঞ্চে এসেছি। স্ত্রী, ছেলে ঢাকায় ফিরবেন বলে একদিন আগে হাকিমউদ্দিন ঘাটে কেবিন বুকিং দিয়ে রাখলেও লঞ্চে এসে কেবিন পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে শুনতে পেরেছি প্রতিটি ঘাটে কেবিন বুকিংয়ে বড় রকমের সিন্ডিকেট রয়েছে। প্রতিটি ঘাটে প্রতিটি লঞ্চের স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি কেবিন বুকিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নেন। এর পর বেশি দামে বেগুলোর টিকিট বিক্রি করেন। তিনি আগামীতে যেন অনলাইনে লঞ্চের কেবিনের টিকিট পাওয়া যায় সেই দাবি তোলেন।
এদিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের যমুনা সেতু এলাকায় অতিরিক্ত গাড়ির চাপে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে রাজধানীমুখী যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন।
দায়িত্বরত কর্মকর্তারা জানান, যমুনার সেতুর উপর একটি দুর্ঘটনা ঘটায় এমন যানজটের দেখা দেয়।
যমুনা সেতু পূর্ব থানার ওসি ফয়েজ আহমেদ বলেন, "সেতুতে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে সারা রাত যানবাহন চলাচল ধীর ছিল, যার ফলে যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা আশা করি যানবাহন চলাচল দ্রুত স্বাভাবিক হবে।"
এলেঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মোহাম্মদ শরীফ বলেন, "যমুনা সেতুর সিরাজগঞ্জ অংশে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ এবং যানজট ছিল। এ কারণে টাঙ্গাইল অংশেও যানবাহনের চাপ বেশি। তবে, পুলিশ কর্মকর্তারা যানজট নিরসনে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন।"
ন্যাশনাল ট্রাভেলস পরিবহণের কল্যাণপুরের কাউন্টার ম্যানেজার মোহম্মদ মিনহাজ বলেন, এলেঙ্গার কাছে জ্যাম বেশি। যমুনা সেতুর টোল প্লাজা থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত থেমে থেমে আবার কখনও ধীরগতিতে চলাচল করছে যানবাহন। জ্যামের কারনে আমাদের প্রতিটি গাড়ি কল্যাণপুর আসতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে গড়ে ৪-৫ ঘণ্টা দেরি হয়েছে।
ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুরসহ দক্ষিণাঞ্চল থেকেও ঢাকামুখী মানুষের ঢল নামে। বাস ও লঞ্চে অতিরিক্ত ভাড়া, বিশৃঙ্খলা ও হয়রানির অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত ছিল না বলে অভিযোগ।
বরিশাল জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার রবিউল হাসান ভূঁইয়া বলেন, ঈদ-পরবর্তী নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করতে তদারকি কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
তিনি বলেন, 'নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হাসিবুল হাসান, মাসুমা আহমেদ লুনা এবং শাকিল রোখসাইন বাস ও লঞ্চ টার্মিনালে দায়িত্ব পালন করছেন। গতকাল একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের জন্য তিনটি বাসকে ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছে এবং যাত্রীদের ৭ হাজার টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, ফিরতি ভিড়ের সময় হয়রানি রোধ এবং নির্বিঘ্নে ভ্রমণ নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসন তৎপর রয়েছে।
এমভি শুভরাজ-৯ লঞ্চের যাত্রী ফিরোজ আকন বলেন, 'ডেকে বসার জন্য কোনও জায়গা অবশিষ্ট নেই। সর্বত্র কর্মীরা মেঝেতে গদি বিছিয়ে রেখেছেন এবং প্রতিটির জন্য ৬০০ টাকা দাবি করছেন। এই গদি সিন্ডিকেটের কারণে আমরা কোথাও বসতে পারছি না।'
সুরভী-৭ লঞ্চে ওঠা মানিক হাওলাদার বলেন, তিনি প্রথমে বাসে ঢাকায় যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু বেশি ভাড়ার কারণে লঞ্চে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। তবে যাত্রার কষ্ট থাকলেও ঈদের আনন্দ আর পরিবারের সঙ্গে কাটানো সময়ের স্মৃতি নিয়ে কর্মজীবী মানুষ ঢাকায় ফিরছেন।