‘আমার পোশাক নয়, তোমার মানসিকতাই দায়ী’ — যেভাবে এক রিকশাচালকের প্রতিবাদ সামনে এলো

"লেখাডা রিক্সায় লাগানোর পর কিছু মানুষ আমারে গালি দিসে। কইসে, সব নাকি মাইয়াগো দোষ, ওগো কাপড়ের দোষ। আমি খালি একদিন একজনরে কইসি, তাইলে ভাই ছোড ছোড বাচ্চাগো ধর্ষণ করে কেন? ওগোরও কি কাপড়ের দোষ? শুইনা সে ক্ষেইপা গেলো, গালিগালাজ করলো। আমার তাতে সমস্যা নাই। হক কথা কমু না কেন?" — বেশ দৃঢ় কণ্ঠে কথাগুলো বলেছিলেন রিকশাচালক মো: শুক্কুর।
'আমার পোশাক নয়, তোমার মানসিকতাই ধর্ষণের কারণ' — ঠিক এই স্লোগানটিই লেখা ছিল মো: শুক্কুরের রিকশার পেছনে। সে আজ থেকে আরও বছর চারেক আগের কথা। ২০২০ সালে লকডাউনের দিনে এভাবেই নিজের রিকশা সাজিয়েছিলেন শুক্কুর। তারপর নানা জনের নানা নেতিবাচক কথা সহ্য করেও টিকিয়ে রেখেছিলেন সেটি। তবে পাতলা টিন বলে বছর দুইয়ের মধ্যেই জং ধরে ভেঙে গিয়েছিল রিকশার প্লেটটি।
মো: শুক্কুর আমাদের মতোই নিতান্ত সাধারণ মানুষ। বয়স পঞ্চাশের কিছু বেশি। পেশায় রিকশাচালক। এই পেশায় তার হাতেখড়ি হয় জিয়াউর রহমানের শাসনকাল থেকে।
খুব ছোটবেলাতেই পাড়ি জমিয়েছিলেন ঢাকায়। সে সময়ের কোনো কথাই তেমন একটা স্মরণে নেই তার। তবে তার মা তাকে ৪ টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়েছিলেন তা মনে আছে। এখন তার সংসারে দুই ছেলে, এক মেয়ে। সবাইকেই বিয়ে করিয়েছেন। নাতি-নাতনীদের মুখও দেখেছেন। তাদের সাথে বেশ সুন্দর সময় কাটে তার। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নির্মল এই সুখের জীবনে শুক্কুরের ভয় অন্যকিছু নিয়ে।
ছোট ছোট যে নাতনীরা আছে, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে বেশ ভাবেন তিনি। মানুষকে তিনি ভয় পান। এই ভয় পাওয়া আরও বেড়েছিল যখন দেখেছেন এক দুই বছরের বাচ্চারও ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই মেলেনি। তাই বাসায় নাতনীদের একা রেখে যেতে নিষেধ করেন ছেলে-মেয়েদের।
এই ভয় আরও চেপে বসে যখন নিজের রিকশায় ধর্ষণ বিরোধী স্লোগানটি লিখিয়েছিলেন। মানুষের কটু মন্তব্য, বাজে আচরণ দেখে নিজেই বুঝেছিলেন এই দেশে মানুষের মননশীলতা তিনি যেমনটা ভাবতেন তেমনটা নয়। তার ভাষায়- 'উচিত কথার দাম কম, ভালা কামের কদর নাই'।

শুক্কুরের রিকশায় এই প্রতিবাদী আর্ট করেছিলেন মো. হানিফ পাপ্পু, বাংলাদেশের রিকশা আর্টের একজন কিংবদন্তি শিল্পী। তার সহযোগী ছিলেন মো. মনির হোসেন। কিন্তু শুধু শুক্কুরের রিকশাই নয়, তারা আরও প্রায় ১৫-২০টি রিকশায় এমন সচেতনতামূলক বার্তা লিখেছিলেন। এসব রিকশায় লেখা হয়েছিল বাল্যবিবাহ, শব্দদূষণ ও ধর্ষণবিরোধী বিভিন্ন বার্তা।
আর এই পুরো প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করেছিল 'পাশে আছি' নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনের সদস্যদের উদ্যোগ এবং নিজস্ব অর্থায়নেই কাজটি হয়।
লকডাউনের সময় তখন। কর্মহারা হয়ে অনেকেই ভুগছিলেন আর্থিক অভাব অনটনে। হানিফ পাপ্পুদেরও একই অবস্থা। সে সময়ে 'পাশে আছি' সংগঠন থেকে পাপ্পুদের পাশে দাঁড়ান একদল তরুণ। নিজেদের অর্থায়নে ন্যায্যমূল্যে করিয়ে নেন ২০টির মতো রিকশা আর্ট। তাদের লক্ষ্য ছিল দুটি — যাদের দিন চলছে অনাহারে, অভাবে তাদের জন্য কাজের একটা সুবন্দোবস্ত করা; এবং সমাজে চলমান নীতিহীন কাজ নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা।
তবে রিকশা আর্টের মাধ্যমে কেন? সেটির উত্তর জানা গেলো 'পাশে আছি' সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী সমন্বয়ক সাইদুল ইসলামের কাছে।
তিনি বলেন, "রিকশা আর্ট একটা ঐতিহ্য আমাদের। কিন্তু যখন দেখলাম করোনার সময়ে এই আর্টের কাজ একেবারে বন্ধ, আর পাপ্পু ভাইরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন, তখনই আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে রিকশা আর্টের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের কাছে আমাদের বার্তা পৌঁছাব। তাতে তাদের কিছু আয় হলো, আবার আমাদের কাজও হলো।"
সাইদুলের মতে, ঢাকা শহরে মানুষের সিংহভাগ সময় কাটে জ্যামে বসে। সে সময় যদি কারো চোখে এসব স্লোগান পড়ে তবে পাঁচজনের মধ্যে অন্তত একজনের চিন্তার পরিবর্তন ঘটতে পারে।
"ওই যে বলে না, আমাদের চোখের সামনে যা থাকে আমরা সেটা নিয়েই ভাবি, কথা বলি, আলোচনা করি। আমাদের উদ্দেশ্যও ছিল ঠিক তাই," বলেন সাইদুল।

তবে শুরুর দিকে উদ্যোগটি যখন নিলেন তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় রিকশাওয়ালাদের রাজি করানো। অনেকের সাথে কথা বলেও রাজি করানো যাচ্ছিলো না সেভাবে। ফলে অন্য পন্থা অবলম্বন করেন তারা। প্রথমে রিকশাওয়ালাদের সাথে মেলামেশা শুরু করেন। সখ্য গড়ে তোলেন৷ কিন্তু এসবের মাধ্যমে যাদের বোঝাতে পেরেছিলেন, তাদেরও অনেকেই অন্যান্য আর্টে ইচ্ছে পোষণ করলেও ধর্ষণবিরোধী স্লোগানটির প্লেট লাগাতে তেমন একটা আগ্রহ প্রকাশ করেননি।
ঠিক সে সময়ে হাজির মো: শুক্কুর। আগ্রহ করে নিজ ইচ্ছায় এই ধর্ষণবিরোধী স্লোগান সংবলিত রিকশা আর্ট নিজের রিকশার পেছনে লাগিয়ে নিতে রাজি হয়েছিলেন তিনি। এরপর কারো কথাকে তোয়াক্কা না করে বছর দেড়েকেরও বেশি সময় ধরে এটি নিয়ে সগর্বে রিকশা চালিয়েছেন পুরো ঢাকাজুড়ে।
মো: শুক্কুরের কাছে জানতে চেয়েছিলাম—"এইটা করার আগে চিন্তা হয়নি মানুষ কী বলবে?"
"কেন হবে মামা? এইডা তো ভুল না। ভালো কথাই লিখছে। সঠিক কথা কইলে কি ডর আছে? তাই অত ভাবি নাই। এর লাইগা অনেকে অনেক কথা কইলেও আমি সরাই নাই," বলেন শুক্কুর।
শুরু থেকেই মানুষের কোনো নেতিবাচক কথা গায়ে লাগাননি। আর যারা তাকে মানসিকভাবে প্রচণ্ড অশান্তি দিয়েছে তাদের কথাও কানে তোলেননি কখনো।
শুক্কুরের ভাষ্যে "আমারে অনেকে বেধর্মীও বলসে। আল্লাহ রে নাকি ভয় করি না আমি। আমার ধর্মে কি এইডা কইছে আপনি কন? ধর্ষকের সাজা দিতে হইবো কইছে। মাইয়ারে দোষ দিতে কয় নাই। কেউ কেউ বলসে এইডা ফালায় দেন। ফালাবো ক্যান? তাগো অসুবিধা আছে, আমার তো কোনো অসুবিধা নাই৷ তয় একটা জিনিস শিখছি মামা, যে যাই বলুক, আপনি রাখতে চাইলে কেউ কিচ্ছু করতে পারে না।"
এই ছিল শুক্কুরের সহজ-সরল স্বীকারোক্তি। তিনি প্রমাণ করলেন নিজের অবস্থানে পাকা হলে সেখান থেকে নাড়ানোর সাধ্য নেই অন্য কারো।
মো: শুক্কুর দেখিয়েছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য কোনো ডিগ্রি প্রয়োজন হয় না। এমনকি তার স্বাক্ষরজ্ঞানও নেই। তবে দেখিয়েছেন সাহস আর নৈতিক অবস্থান থাকলেই একজন রিকশাচালকও সমাজকে সচেতন করতে পারেন। তিনি অক্ষরজ্ঞানহীন হয়েও এমন একটি সত্যকে উপলব্ধি করেছেন, যা অনেক শিক্ষিত মানুষের অনুধাবনেরও বাইরে।
"শোনেন মামা আমি কই, আমার মনে হয় যে এর চাইতে বড় গোনাহ আর নাই। আর যাদের লগে এইডা হয় তাগো দোষ দেওন ও গোনাহ। দোষ শুধু যে খারাপ কাম করছে তার," বলেন শুক্কুর।
শুক্কুরের কাছে শেষ প্রশ্ন ছিল, "আপনাকে যদি আবার এমন একটা আর্ট করে দেওয়া হয়, লাগাবেন?"
হাসিমুখে তার উত্তর, "হ, অবশ্যই লাগামু। সত্য কথা দেখাইতে আমার তো সমস্যা নাই মামা, সমস্যা মাইনষের।"